

ইয়োর অ্যাটেনশন প্লিজ! (রম্যরচনা)
স্টেইনলেস স্টিলের স্পুন আর ফর্ক দিয়ে সেরামিকের প্লেটে ঠুংঠাং হাল্কা ঠুংঠাং আওয়াজ করার মধ্যে একটা দৈব আনন্দ আছে, এটা আমরা বুঝি। তবে করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে এমন আওয়াজ এখন করবেন না।…
স্টেইনলেস স্টিলের স্পুন আর ফর্ক দিয়ে সেরামিকের প্লেটে ঠুংঠাং হাল্কা ঠুংঠাং আওয়াজ করার মধ্যে একটা দৈব আনন্দ আছে, এটা আমরা বুঝি। তবে করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে এমন আওয়াজ এখন করবেন না।…
এই অতিমারী প্রকৃতি এবং পরিবেশের জন্য ভালো না খারাপ, সেটা ভাইরাসের উপরে নিশ্চিত ভাবে নির্ভর করবে না, নির্ভর করবে মানুষের উপরে।… এই যুদ্ধ দুর্যোগ নয়, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আজ মানুষের কাছে এক বিরাট সুযোগ।…
কিন্তু এখন একটা অজানা টেনশন কাজ করছে লীনার মনে। কই একটু আগেও তো এমন মনে হচ্ছিল না। ফোনটা ধরল না সে। সঙ্গেসঙ্গেই কেকার ফোন। নাহ! এবার স্নানে অব্যাহতি দিতেই হবে। গা মুছতে মুছতেই আবার দূর্বার ফোন।
এপিডেমিক শব্দটার উত্থান ইউরোপে, গ্রিসে। এপি অর্থে উপর (upon/above) আর ডেমস অর্থে মানুষ (সেখান থেকেই ডেমক্রেসি বা গণতন্ত্র)। কোনও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস-জনিত মারণ রোগ যখন একই দেশের অনেক মানুষকে সংক্রামিত করে, তখন তাকে এপিডেমিক বা মহামারী বলে। আবার সেই এপিডেমিক যখন এক দেশের সীমান্ত পার করে পড়শি দেশ, মহাদেশ, বা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারই নাম হয় প্যানডেমিক বা অতিমারী।…
পরিবারের সব লোকজন আজ একঘরে। ভাবা যায়! যে বাড়ির চরম দুর্দিনেও ঘরের সব ব্যাটা একমুখো হয় না, তারা আজ এক সঙ্গে এক ভাবে এক জায়গায় ঘুম থেকে উঠছে ও ঘুমোতে যাচ্ছে। সকালের কচুরি কালচারে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েদের শিরে সংক্রান্তি। যদিও শোনা গেল কিছু কিছু মিষ্টির দোকান এবার থেকে খোলা থাকবে।…
হঠাৎ করে চায়ের দোকানে আয়রন ম্যানকে দেখে সবাই চমকে চোদ্দো! ট্যাঁপা তো চায়ের ভাঁড় উল্টে ফেলে নিজের বারমুডাটাই ভিজিয়ে ফেলল! দত্তবাড়ির বুড়োদাদু আস্তে করে আয়রন ম্যানকে জিজ্ঞেস করলেন, “ও বাবা টোনি, এই অসময়ে তুই আবার কশটিউম পরে চায়ের দোকানে উড়ে এলি কেন? কিচু হইয়েচে নাকি?” আয়রন ম্যান রেগে মেগে বলল, “বলি আক্কেলবুদ্ধি কি সব আলমারিতে তালা দিয়ে রেখে বেরিয়েছ? সবাইকে বার বার টিভিতে-রেডিয়োতে-কাগজে-ফেসবুকে বারণ করা হচ্ছে অকারণে ঘর থেকে বেরতে!
কে রুখবে অপ্রতিরোধ্য বসন্তের হাওয়া? চারিদিকের এই মহেঞ্জোদাড়োর শূন্যতার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুরন্ত ম্যাগনোলিয়া। দু’মিটারের দূরত্ব বজায় রেখে সন্তর্পণে পাড়ায় হাঁটছি আলেকজান্দ্রা প্যালেসের দিকে। মার্চের প্রথম বাসন্তী রোদ গায়ে মেখে। মনে পড়ে যাচ্ছে বোকাচ্চিওর দশ বন্ধুর কথকতা। মহামারী প্রবল অন্ধকারের বুক থেকে ড্যাফোডিল আলো ছিনিয়ে এনে হালকা হাসিতে তারা ছড়িয়ে দিয়েছে বিংশ শতাব্দির করোনার কলোনিতে। এ সময় ভয়ের। এ সময় নির্ভীকতার। এ সময় সামাজিক দূরত্বে দাঁড়াবার। এ সময় ভীতিপ্রদ রক্তচক্ষুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকবার।
ভিরান্দিয়ারা থেকে কিছুদূর গিয়ে গাড়ি বাঁ দিকের রাস্তা ধরল। সামনে পুলিশের চেকপোস্ট। সেখানে নিজের পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হবে শুনে কিছুটা অস্বস্তি হল। এর আগে যেখানেই চাকরি করেছি, পুলিশের খাতায় নাম ওঠেনি কখনও। গাড়ি ফের রওনা দিল। বেশ কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে এক ধূ-ধূ মাঠে পৌঁছলাম। শুনলাম সেটার অপর প্রান্তে রিসর্ট। পাশে একটা বিএসএফ ক্যাম্প। পরে জেনেছিলাম সেটাই শেষ ক্যাম্প, কারণ আমাদের রিসর্টের সামনে থেকেই শুরু হচ্ছে দিগন্তবিস্তৃত সাদা প্রান্তর– যাকে লোকে সল্ট ডেসার্ট বা রান বলে জানে।
২৬শে মার্চ রাত ৮টায় সমস্ত মানুষ নিজেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেন স্বাস্থ্যকর্মীদের — এই যুদ্ধের সেনানীকে| ওই সময় গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম| সামনে ফাঁকা রাস্তা – তার দুধারে দাঁড়িয়ে মানুষ হাততালি দিচ্ছেন| আমি গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত নাড়তে থাকায় হাততালি দ্বিগুণ হলো| ভালো লাগছিল খুব এই সম্ভাষণ মানুষ জানিয়ে থাকেন তারকা ফুটবলারদের, রকস্টারদের| একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে খুব ভালো লাগছিল|
সাধারণ দিন হলে এই সময়টায় দাপিয়ে বেড়াই। তোয়ালে ও অন্তর্বাস আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। আমি চার্চিলের মতো চিৎকার করে বাথরুমে প্রবেশ করি এবং পরিবার লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা না করলে ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসার হুমকি দিই। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতি। ওয়র্ক ফ্রম হোম, মানে ডব্লিউ-এফ-এইচ। নিয়ম মেনে আগে কুড়ি সেকেন্ড সাবান জলে হাত কচলাই। তারপর হালকা করে ওঁকে বলি, ব্রেকফাস্ট-এ পাঁউরুটি হলেই চলবে, বাড়িতেই তো আছি। টুকটাক খেতেই থাকব। আজ চান নয়, দাড়ি কামানো নয়। পুরো বেনিয়ম। কিন্তু বিধির বিধান হল করপোরেট পদে পদে পরীক্ষায় ফেলবে তার বিশ্বস্ত কর্মচারিকে।
এখনও অবধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোন ধাপেই কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। অতি মারাত্মক ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে সার্স, এইচআইভি-তে ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ এবং ক্লোরোকুইন বা ক্লোরামফেনিকলের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত প্রয়োগে ফল দিচ্ছে। কিন্তু ১৮ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত ট্রায়াল রিপোর্ট (র্যান্ডমাইজড, কন্ট্রোলড, ওপেন লেবেল ট্রায়াল) “ট্রায়াল অফ লোপিনাভির-রিটোনাভির ইন অ্যাডাল্টস হসপিটালাইসড উইথ সিভিয়ার কোভিড-১৯” জানাচ্ছে – “হাসপাতালে ভর্তি প্রাপ্তবয়স্ক তীব্র করোনা আক্রান্তদের ওপর লোপিনাভির-রিটোনাভির-এর কোনও প্রভাব দেখা যাচ্ছে না”।
আপনি বাঁচলে বাপের নাম— এখন আর নয়। এখন সবাই বাঁচলে নিজের বাঁচার একটা সম্ভবনা আছে। সুতরাং বাধ্য হয়ে সবার কথা ভাবতে হবে। কেবল নিজের হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা পাকা করলেই হবে না। অন্যের জন্য হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক ডজন স্যানিটাইজ়ার কিনে ঘরে মজুত রাখলে বাঁচা যাবে না। অন্যের জন্য দোকানে স্যানিটাইজার ছাড়তে হবে। আবেগে ভেসে গিয়ে থালা বাজিয়ে মিছিল করলে হবে না। মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জানলায় বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাজাতে। যে ভাবে অন্যান্য দেশ নিজের মতো করে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছে। রাস্তায় বেরিয়ে নয়। ঘরে থেকে।
আচ্ছা এতে রাখঢাকের কী আছে মশাই? রোগ হলে হবে, হয়েছে। স্বীকার করুন। সবার বাড়িতে আমাদের বুড়োমানুষেরা আছেন, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসে ভোগা প্রচুর মানুষ রয়েছেন। আমাদের লিফট ইত্যাদি পরিষ্কার করা হচ্ছে সর্বক্ষণ। কিন্তু সেই ছেলেগুলি গায়ের জোরে আবার ঢুকে পড়বে না তো? সারাক্ষণ স্যানিটাইজেশন চলছে। পেপারওয়ালা, পুজোর ফুল, দোকান থেকে কয়েন ফেরত নেওয়া, স্যুইপার, মালি, ড্রাইভার সব বন্ধ করে আমরা হোম কোয়ারান্টাইনে রয়েছি। কিন্তু অবোধ এই বালকেরা? এরা এত অবাধ্য? প্লিজ কথা শুনুন সবাই। রোগ লুকোবেন না। রোগ ছড়াবেন না।
করোনাভাইরাসের দৌলতে এই শব্দটা দিব্যি শিখে গিয়েছি আমরা। ডব্লুএফএইচ। মানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কথা শোনও, হাত ধোও, অফিসেতে যেও না। করোনায় প্রথম করণীয় কী, আঁচ করতে পেরেই একের পর পর এক অফিসে দিন পনেরোর ছুটি হয়ে গিয়েছে দেশের বেশ কয়েকটা শহরে। নামী কোম্পানির দামি সিইও বড় মুখ করে মিডিয়ায় বলছেন, প্রেস নোট দিচ্ছেন, ‘আমরা আমাদের কর্মীদের উপরে পূর্ণ ভরসা রাখি। আমরা জানি, অফিসে বসে তাঁরা দিন রাত এক করে যে কাজ করেন, একই উদ্যমে তাঁরা কাজ করে যাবেন বাড়িতে বসেও।’
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী – ৯২০০-এর বেশি নতুন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চিনে ১৩২ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চিনের বাইরে ৬৮টা কেসের কথা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে।