- সব ধর্মের সব জাতের পুরুষই নারীহত্যা করে,
- শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয় কি?
- ভ্যালেন্টাইন’স ডে
- ধর্ষণহীন দিন
- নারী দিবসে
- রোজায় আমি কী ভাবছি, বাঁধ ভেঙে দাও
টাঙ্গাইল (Tangail) থেকে প্রচুর হিন্দু তাঁতি ভারত ভাগের পর পূর্ব বঙ্গ থেকে, বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বা বাংলাদেশ থেকে মুসলমানের অত্যাচারের ভয়ে ভারতে চলে এসেছেন। ভারতেই তাঁরা টাঙ্গাইলে (Tangail) যেভাবে শাড়ি বুনতেন, সেভাবেই শাড়ি (Saree) বুনছেন। কিন্তু প্রচুর তাঁতি তো টাঙ্গাইলে (Tangail) রয়েও গেছেন। তাঁরাও বুনছেন টাঙ্গাইল শাড়ি (Tangail Saree)। আশির দশকে, আমি যখন থেকে শাড়ি পরতে শুরু করেছি, আমার সবচেয়ে প্রিয় শাড়ি ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি (Tangail Saree)। দামে কম, মানে ভাল। আমার বাড়ির কাছে বেইলি রোডে ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। ডাক্তারি চাকরি করতাম, প্রথমে মিটফোর্ডে তারপর ঢাকা মেডিক্যালে।
বেতনটা পেলেই বেইলি রোডের দুটো দোকানে চলে যেতাম। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির থেকে কিনতাম টাঙ্গাইল শাড়ি, আর তার পাশের সাগর পাবলিশার্স নামের বইয়ের দোকান থেকে কিনতাম বিস্তর বই। আমি প্রচুর বই পড়তাম, এবং খুব গুছিয়ে শাড়ি পরতাম। রঙ মিলিয়ে কপালের টিপ পরতাম, রঙ মিলিয়ে হাল্কা কানের দুল বা হাতের চুড়ি পরতাম। আমার যত শাড়ি ছিল, তার সত্তর বা পঁচাত্তর ভাগই ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি। টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি আমার ভালবাসার কথা অনেকেই জানতো। আমার সেই জীবনকে এখন রূপকথা বলে মনে হয়।
এখন টাঙ্গাইল শাড়ির জি আই (GI) অর্থাৎ জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশান (Geographical Indication) ভারত পেয়েছে বলে চারদিকে বিতর্ক চলছে। ভারতের লোকেরা বলছে, কাজটা ভাল হয়েছে, বাংলাদেশের লোকেরা বলছে, কাজটা ভাল হয়নি। প্রশ্ন উঠছে, টাঙ্গাইল থেকে তাঁতিরা ভারতে চলে গিয়ে একই পদ্ধতিতে যদি টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করতে পারেন, তাহলে কি তাঁরা টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব আইনত পেতে পারেন? এ নিয়ে কেউ বলছেন পারেন, কেউ বলছেন পারেন না।
টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব হয়তো ভারতে চলে আসা তাঁতিরা পেতে পারতেন, যদি টাঙ্গাইলে শাড়ি বোনা টাঙ্গাইলে বন্ধ হয়ে যেত। যদি টাঙ্গাইল শাড়ি বোনার কেউ আর বাস না করতো টাঙ্গাইলে। যদি কারখানায় তালা পড়তো। এবং যদি ভবিষ্যতে এই তাঁত শিল্প রক্ষা করার উপায় না থাকতো। তা কিন্তু ঘটনা নয়।
টাঙ্গাইল শাড়ি বোনার তাঁতিদের মধ্যে বসাক বংশ বিখ্যাত। বসাক বংশের সবাই বাংলাদেশ ত্যাগ করেননি। প্রচুর বসাক রয়ে গেছেন টাঙ্গাইলে, এবং বংশ পরম্পরায় তাঁরা আজও শাড়ি বুনছেন। টাঙ্গাইল টাঙ্গাইলেই আছে, থাকবে। যে বসাক তাঁতিরা টাঙ্গাইল থেকে ভারতে চলে গিয়ে শান্তিপুরে স্থায়ী হয়েছেন , সেই শান্তিপুরও শান্তিপুরেই আছে, থাকবে। শান্তিপুরের বসাকরা কিন্তু যে শাড়ি বুনছেন, সেই শাড়িকে শান্তিপুরী শাড়ি না বলে টাঙ্গাইল শাড়ি বলছেন। শান্তিপুরের নাম তাঁরা চাইলেও বদলে দিতে পারেন না, বদলে টাঙ্গাইল রাখতে পারেন না। এই তাঁতিদের একজন পদ্মশ্রী পেলেও, শান্তিপুরে বোনা শাড়ির নাম টাঙ্গাইল হলেও, শান্তিপুরের নাম টাঙ্গাইল হবে না এবং টাঙ্গাইলের নাম টাঙ্গাইলই রয়ে যাবে। এবং টাঙ্গাইলে বোনা শাড়ির নামও টাঙ্গাইল শাড়িই রয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা দু’দেশে ভাগ হয়ে গেছেন। টাঙ্গাইল নামের অঞ্চল তো শাড়ি বানায় না, শাড়ি বানায় মানুষ। মানুষই কারিগর। ঢাকায় যেমন আমার বাড়ির পাশে টাঙ্গাইল শাড়ির দোকান ছিল, আমি যে শহরে এখন বাস করছি, সে শহরেও আমার বাড়ির পাশে রয়েছে একটি টাঙ্গাইল শাড়ির দোকান। এখান থেকেও আমি যখন ইচ্ছে টাঙ্গাইলের শাড়ি কিনতে পারি। দেশের কত কিছু মিস করি, টাঙ্গাইল শাড়ি মিস করি না।
কলকাতায় মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান দেখে একবার চমকে উঠেছিলাম। ঢাকার মরণচাঁদের দই আর মিষ্টি স্পেশাল ছিল। ঠিক যেমন ছিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডা। এখন সেইসব সিক্রেট রেসিপি যদি মিষ্টির ব্যবসায়ীরা ঢাকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসেন, এবং পুরোনো রেসিপি অনুযায়ী মণ্ডা মিঠাই বানান, তবে তাঁদের কেন অধিকার থাকবে না সেসবের স্বত্ব পাওয়ার? একবার তো শুনেছিলাম বাসমতি চালের স্বত্ব দাবি করেছে আমেরিকা। রসগোল্লার স্বত্ব নিয়ে বহুদিন মারামারি চলেছে পশ্চিমবঙ্গ আর উড়িষ্যার মধ্যে।
এখন জরুরি কথা হলো, শাড়ি পরা তো বন্ধ হয়ে গেছে দু’দেশেই, তাহলে শাড়ির মালিকানা নিয়ে কী লাভ কার? আমি খুব চাই মেয়েরা শাড়ি পরুক, ভালবেসে পরুক। টাঙ্গাইল শাড়ি দু’দেশেই পাওয়া যায়। একই কোয়ালিটির, একই স্টাইলের। স্বত্ব নিয়ে যখন লড়াই চলছে, অনেকে হয়তো নামটা প্রথম জানবে শাড়ির। শাড়ি কেমন দেখতে চাইবে, পরতে কেমন তাও জানতে চাইবে। এভাবে আগ্রহ বাড়ুক। টাঙ্গাইল নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। টাঙ্গাইলকে কেউ ধরে বেঁধে কোথাও নিয়ে যায়নি। টাঙ্গাইল শাড়ির নাম টাঙ্গাইলেরই থাকবে। কাঁটাতার পেরিয়ে টাঙ্গাইলের যে তাঁতিরা এপারে অর্থাৎ ভারতে এসেছেন, তাঁরাও বুকের ভেতর জন্মের ভূমি টাঙ্গাইলকে লালন করেন, তাঁদেরও স্বত্ব পাওয়ার অধিকার আছে।
টাঙ্গাইল শাড়ি এবং টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা অনেকটা আমার মতো। বাংলাদেশে জন্ম, কিন্তু অবহেলা উপেক্ষা আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। বাংলাদেশ যতটুকু আমার, ভারতও ঠিক ততটুকু আমার। বাংলাদেশ আর ভারত-- দু'দেশের ক্রেতারা আমাকে ভুলতে বসেছে, এ যেমন ঠিক, আমাকে নিয়ে গর্ব করার লোকও এদেশে ওদেশে কিছু আছে--এও তেমন ঠিক।
সেক্ষেত্রে অন্য কোনও নামে টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব তাঁরা পেতে পারেন, যেমন আদি টাঙ্গাইল শাড়ি বা নিউ টাঙ্গাইল শাড়ি বা বসাক টাঙ্গাইল শাড়ি, এরকম কিছু নামে। টাঙ্গাইল শাড়ি এবং টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা অনেকটা আমার মতো। বাংলাদেশে জন্ম, কিন্তু অবহেলা উপেক্ষা আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। বাংলাদেশ যতটুকু আমার, ভারতও ঠিক ততটুকু আমার। বাংলাদেশ আর ভারত– দু’দেশের ক্রেতারা আমাকে ভুলতে বসেছে, এ যেমন ঠিক, আমাকে নিয়ে গর্ব করার লোকও এদেশে ওদেশে কিছু আছে–এও তেমন ঠিক।
*পরবর্তী কলাম প্রকাশ পাবে ১৩ই মে, ২০২৪
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Shutterstock
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী মুখ তসলিমা নাসরিন। বাঙালি হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক। গদ্য ও কবিতার সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ তসলিমার। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি তাঁকে আমরা চিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও নারীবাদী একজন চিন্তাশীল হিসেবেও। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, মানববাদ, বিজ্ঞান ও সহনশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি তাঁর বিশ্বব্যাপী উদার ও মুক্তচিন্তার জন্য দেশে-বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননায়। 'নির্বাচিত কলাম' ও আত্মজীবনী গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দু'দুবার আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারভ পুরস্কার। ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার, কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। লিখেছেন 'ফেরা', 'লজ্জা', 'ফরাসি প্রেমিক'-এর মতো অসামান্য উপন্যাস; বেশ কিছু ছোটগল্প, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ।