বহু বছর ধরে নারীবাদীরা পৃথিবীর সর্বত্র সবাইকে বোঝাচ্ছে, এমনকি প্রমাণও দেখাচ্ছে যে, ধর্ষণ (Rape) নারীর পোশাকের কারণে ঘটে না। ধর্ষণের কারণ: ১. বীভৎস কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে পুরুষ তার পৌরুষ প্রমাণ করে, ২. নারীকে নিতান্তই যৌনবস্তু মনে করে পুরুষ। সুতরাং যৌনবস্তুকে ধর্ষণ করা অপরাধ নয় বলেই বিশ্বাস করে।
নারীবাদীদের আন্দোলনের ফলস্বরূপ ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাদের দায়ী করাটা সভ্য এবং শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এখন অনেকটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু যারা এখনও বন্ধ করছে না, তাদের নিশ্চিতই চক্ষুলজ্জা বলতে যে জিনিসটা প্রায় সবার থাকে, নেই।

মেয়েদের শুধু পুরুষের সম্পত্তি নয়, এই সমাজেরও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে বিশ্বাস করা হয়। সে কারণে সমাজের লোকেরা একটা মেয়ে কী পরল, কী করল, কোথায় গেল, কী খেল, কার সঙ্গে কথা বলল, কার সঙ্গে শুলো, কখন বাড়ি ফিরল এসবের খবরাখবর রাখে। লক্ষ্মণরেখা পেরোলেই সর্বনাশ। সমাজের লোকেরাই সিদ্ধান্ত নেবে মেয়েকে একঘরে করতে হবে নাকি পাথর ছুঁড়ে মারতে হবে। মেয়েদের শরীরকে অর্থাৎ মেয়েদের যৌনতাকে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলার আরেক নাম পুরুষতন্ত্র। এই শেকল যতদিন না ভাঙা হবে, ততদিন মেয়েদের সত্যিকার মুক্তি নেই, ততদিন তাদের পোশাক আশাক আর তাদের চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকবে।
নারীবাদীদের শত বছরের আন্দোলনের ফলে পৃথিবীতে নারী-শিক্ষা শুরু হয়েছে, নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে, বাইরে বেরোবার এবং স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার পেয়েছে, কিন্তু এই অধিকারই সব নয়, নারীর যে অধিকারটি নেই এবং যে অধিকারটি সবচেয়ে মূল্যবান, সেটি নারীর শরীরের ওপর নারীর অধিকার। নারীর শরীরকে সমাজের এবং পরিবারের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। নারীর শরীর কোনও সমাজের সম্পত্তি, বা কোনও পরিবারের সম্মানের বস্তু নয়।
যতদিন নারী তার শরীরের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না পাচ্ছে, যতদিন নারীর শরীর নিয়ে নারী কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত নারীর না হবে, যতদিন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পুরুষের, আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের, ততদিন নারীর সত্যিকার মুক্তি সম্ভব নয়। আর যতদিন এই মুক্তি সম্ভব নয়, ততদিন নারীর পরিচয় পুরুষের ‘ভোগের বস্তু’ হয়েই থাকবে– ঘরে, পতিতালয়ে, রাস্তায়, অফিসে, বাসে, ট্রেনে–সবখানে। ভোগের বস্তু নারীকে ভাবা হয় বলেই যৌন হেনস্থা বা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঘটাতে পুরুষের কোনও অসুবিধে হয় না।

পুরুষাঙ্গ মেয়েদের ধর্ষণ করে না, ধর্ষণ করে ঘৃণ্য মানসিকতা। পুরুষাঙ্গ নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র নিরীহ অঙ্গ। পুরুষিক মানসিকতা দূর করলে পুরুষেরা নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে একই প্রজাতির সহযাত্রী সতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখবে। পুরুষের যৌনইচ্ছের চেয়ে নারীর যৌনইচ্ছে কিছু কম নয়। নারী যদি নিজের যৌনইচ্ছে সংযত করতে পারে, পুরুষের বিনা অনুমতিতে পুরুষকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে, পুরুষ কেন পারবে না, পুরুষ কেন চাইলে নারীর বিনা অনুমতিতে নারীকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে পারবে না! মানুষ মাত্রই এই ইচ্ছেকে সংযত করতে পারে, কিন্তু ধর্ষকদের মধ্যে সংযত করার এই চেষ্টাটা নেই, কারণ ধর্ষকদের মস্তিস্কের গভীরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাটা অনেক আগেই ঢুকে গেছে যে নারী যৌনবস্তু আর পুরুষের অধিকার আছে যখন খুশি যেভাবে খুশি যৌনবস্তুকে ভোগ করা।
কিন্তু কে কাকে বোঝাবে যে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যদি খাদ্য ও খাদকের বা শিকার ও শিকারীর হয়, তবে এ কোনও সুস্থ সম্পর্ক নয়! কোনও বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে কখনও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। নারী তার সমানাধিকার না পাওয়া পর্যন্ত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও সত্যিকার সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না।
পুরুষেরা আর কতকাল ধর্ষণ করবে মেয়েদের? তাদের কি এখনও সময় হয়নি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার? পুরুষেরা যেন পুরুষদের সেই ভাবে শিক্ষা দেয়, যে ভাবে শিক্ষা দিলে পুরুষেরা ধর্ষণ করবে না। নারীরা চিৎকার করলে পুরুষেরা কান দেয় না। নারীরা জানে না কী করলে বা কী বললে পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে। পুরুষেরাই জানে পুরুষের মন। সুতরাং পুরুষের শিক্ষক, উপদেষ্টা পুরুষকেই হতে হবে।
ধর্ষণের শিকারকে কেন মুখ লুকোতে হয়! ধর্ষকরা তো দিব্যি নাম ধাম সাকিন জানিয়ে দেয়, ক্যামেরার দিকে তাকাতে তাদের তো লজ্জা হয় না! তাহলে কি ঘটনা এই যে, সমাজের ভয় একজন ধর্ষিতার আছে, কিন্তু একজন ধর্ষকের নেই? কেন নেই? আজকাল তো ধর্ষকদের পুরুষেরাও মেনে নেয় না। তারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে নিজেরা যে ধর্ষক নয়, তা প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, বলতে থাকে ‘সব পুরুষ ধর্ষক নয়’, ‘সব পুরুষ এক নয়’, ধর্ষকের জন্য কঠিন কঠিন শাস্তির প্রস্তাব দিতে থাকে, ফাঁসি, পুরুষাঙ্গ কর্তন, কত কী! তাহলে কেন আজও এই একবিংশ শতাব্দীতেও মেয়েরা নিজের পরিচয় লুকোতে বাধ্য হয়?
কারণ যতই মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলুক, যতই ধর্ষককে গালি দিক, মানুষ আজও মেয়েকেই দোষী বলে মনে করে। মেয়েটি কী পোশাক পরেছিল? কোনও ছোট পোশাক? মেয়েটি যদি কোনও ছোট পোশাক না পরে থাকে, তবেও দোষ, কেন হিজাব পরেনি, যদি হিজাব পরে থাকে, তবে দোষ কেন বোরখা পরেনি। মেয়েটি বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিল, কেন একা যাচ্ছিল, একা গেলে তো এরকম হবেই। কেন কোনও পুরুষ আত্মীয় ছিল না সঙ্গে? কেন সন্ধ্যের পর যাচ্ছিল, দিনের বেলায় তো যেতে পারতো! দোষের শেষ নেই।

ধর্ষণকে পুরুষের অধিকার বলে যারা বিশ্বাস করে, তারা পদে পদে মেয়েদের দোষ খুঁজে বেড়াবে বলার জন্য অন্য মেয়েরা তো ধর্ষণের শিকার হয় না, ও হলো কেন, নিশ্চয়ই ও খারাপ। নিশ্চয়ই ধর্ষিতা হতেই ও চেয়েছে! ধর্ষণের কারণ যে পুরুষের নারীবিদ্বেষ, নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মানসিকতা, নারীকে নির্যাতন করাই যায় বা নারী তো নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু— এই বিশ্বাস, তা অনেকে জানে না। অথবা জানলেও না জানার ভান করে।
ধর্ষণের শিকার যারা, তারা যেন আর মুখ না লুকোয়। যদি এমন হয় যে ধর্ষণের শিকার হলে তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে, তাহলে যারা হেনস্থা করছে, তাদের চিহ্নিত করা হোক। তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা হোক। শুধু ধর্ষণ যে করে, সে-ই দোষী? ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে যারা তার শিকারকে ঘৃণা করে, একঘরে করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, নির্যাতন করে তারাও তো ধর্ষকের মতোই। ধর্ষক করে শারীরিক নির্যাতন, সমাজের ভদ্রলোকেরা করে মানসিক নির্যাতন। এখনও শারীরিক নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে ধরা হয়, মানসিক নির্যাতনকে নয়। ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে পরিবার এবং সমাজ মানসিক নির্যাতন করে, এ কারণেই মেয়ে হতাশায় ভোগে, আত্মহত্যা করে।

শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক নির্যাতন হাজার গুণ ভয়ংকর। ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের উপসর্গ ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ঘোষণা দেয় যে নারী দুর্বল, পুরুষ সবল। পুরুষের জগত বাইরে, নারীর জগত ঘরে। পুরুষ অর্থকড়ি উপার্জন করে, নারী ঘর সংসার করে, শিশু পালন করে। নারীকে তার পিত্রালয় থেকে উঠিয়ে স্বামীগৃহে স্থান দেওয়া হয়। শৈশব কৈশোরে মেয়েরা পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন। স্বামীর সেবা যত্ন করতে হবে নারীকে, সন্তান, বিশেষ করে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে হবে। নারী এবং পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় বেঁধেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাই প্রমাণ করে নারী নিতান্তই পুরুষের দাসী, যৌনদাসী।
যৌনদাসীকে তাই খুব সহজেই রাস্তাঘাটের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতে পারে। কোনও ধর্ষক ভাবে না সে অন্যায় করছে। ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন চলছে, যে নির্যাতনকে বৈধ বলে মনে করে দেশের প্রায় সবাই। ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলছে। স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে স্বামী। আজও স্বামীর ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে মানা হয় না। আজও গণিকালয়ে গিয়ে গণিকাদের পুরুষেরা ধর্ষণ করে এবং যৌন নির্যাতন করে, সেই ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনকেও বৈধ বলে মানা হয়।

ঘরে এবং বাইরে পুরুষেরা ধর্ষণে অভ্যস্ত হয়েছে। তবে কেন একটি মেয়েকে সুযোগ পেলে ধর্ষণ করবে না? পুরুষকে তার পেশি, তার গায়ের জোর, তার দম্ভ, তার উগ্রতা, তার দর্প, তার ঔদ্ধত্ব, তার দুঃসাহস নিয়ে, মোদ্দা কথা তার পৌরুষ নিয়ে গর্ব করতে শেখানো হয়েছে। ধর্ষণ সেই গর্ব থেকেই করে পুরুষ।
ধর্ষকদের কাছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মেয়েই সমান। নারী তাদের কাছে যৌনাঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। প্রচুর পুরুষ, ধর্ষক অথবা ধর্ষক নয়, নারীকে আস্ত একটি যৌনাঙ্গ বলেই বিচার করে।

পুরুষেরা আর কতকাল ধর্ষণ করবে মেয়েদের? তাদের কি এখনও সময় হয়নি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার? পুরুষেরা যেন পুরুষদের সেই ভাবে শিক্ষা দেয়, যে ভাবে শিক্ষা দিলে পুরুষেরা ধর্ষণ করবে না। নারীরা চিৎকার করলে পুরুষেরা কান দেয় না। নারীরা জানে না কী করলে বা কী বললে পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে। পুরুষেরাই জানে পুরুষের মন। সুতরাং পুরুষের শিক্ষক, উপদেষ্টা পুরুষকেই হতে হবে। পুরুষকেই দল বেঁধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ মানব সমাজে বাস করতে হলে, নারীর সঙ্গে এক সমাজে বাস করতে হলে, পুরুষকে নারী নির্যাতন বন্ধ করতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।
ছবি সৌজন্য: NewsBhilai, Womeneye24
____________________________________________________
পড়ুন:
- সব ধর্মের সব জাতের পুরুষই নারীহত্যা করে
- শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয় কি?
- ভ্যালেন্টাইন’স ডে
- ধর্ষণহীন দিন
- নারী দিবসে
- রোজায় আমি কী ভাবছি,
- বাঁধ ভেঙে দাও
- টাঙ্গাইল শাড়ির জি আই বাংলাদেশের প্রাপ্য কেন?
- তারকাময় রাজনীতি ভাল নয়
- ধর্মানুভূতি নয়, এ ধূর্তদের কৌশল
- লিঙ্গসূত্র (১)
- লিঙ্গসূত্র (২)
- হিন্দু-মুসলমানের বিয়ের পরিণতি
- বাংলাদেশ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন
____________________________________________________
*পরবর্তী কলাম প্রকাশ পাবে ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী মুখ তসলিমা নাসরিন। বাঙালি হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক। গদ্য ও কবিতার সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ তসলিমার। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি তাঁকে আমরা চিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও নারীবাদী একজন চিন্তাশীল হিসেবেও। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, মানববাদ, বিজ্ঞান ও সহনশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি তাঁর বিশ্বব্যাপী উদার ও মুক্তচিন্তার জন্য দেশে-বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননায়। 'নির্বাচিত কলাম' ও আত্মজীবনী গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দু'দুবার আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারভ পুরস্কার। ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার, কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। লিখেছেন 'ফেরা', 'লজ্জা', 'ফরাসি প্রেমিক'-এর মতো অসামান্য উপন্যাস; বেশ কিছু ছোটগল্প, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ।