পড়ুন:
- সব ধর্মের সব জাতের পুরুষই নারীহত্যা করে
- শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয় কি?
- ভ্যালেন্টাইন’স ডে
- ধর্ষণহীন দিন
- নারী দিবসে
- রোজায় আমি কী ভাবছি,
- বাঁধ ভেঙে দাও
- টাঙ্গাইল শাড়ির জি আই বাংলাদেশের প্রাপ্য কেন?
- তারকাময় রাজনীতি ভাল নয়
- ধর্মানুভূতি নয়, এ ধূর্তদের কৌশল
- লিঙ্গসূত্র (১)
________________________________________________________________
জীবন একটাই, এই একটা মাত্র জীবনকে যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার সবার। লিঙ্গ যারা অক্ষত রাখতে চায় রাখুক, যারা একে কেটে বাদ দিতে চায় দিক, যে লিঙ্গকে তাদের মন বা মস্তিষ্ক নিজের লিঙ্গ বলে বিশ্বাস করে- সেই লিঙ্গকে যদি শরীরে স্থাপন করতে চায় করুক। অনাকাঙ্খিত অবাঞ্ছিত লিঙ্গের বোঝা শরীরে বহন করে জীবনভর ভোগা থেকে বাঁচুক। নারীর শরীরটাকে পুরুষের শরীর করে ফেলা, অথবা পুরুষের শরীরকে নারীর করে ফেলা যদি সম্ভব হয় তবে করবে না কেন? আমার শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করব, এতে অন্যের আপত্তি হবে কেন? শরীরটা আমার নাকি অন্যের?
লিঙ্গান্তর (Transgender) করে যদিও একশো ভাগ পুরুষ বা একশ ভাগ নারী হওয়া যায় না, কিন্তু যতটুকুই হওয়া যায়, তাতে যদি সুখ পায় মানুষ, সুখ পাওয়ার অধিকার তাদের একশো ভাগ।
নাতালি নামে আমার এক বন্ধু এখন আপাদমস্তক মেয়ে। ক’দিন আগে তার গোটা শরীরটাই ছিল পুরুষের। তার মন তার শরীরকে কখনও মেনে নেয়নি। শুধু নারীর পোশাক পরে নাতালির নারী হওয়ার সাধ মেটেনি, লিঙ্গ বদলে ফেলে সে তার সাধ মিটিয়েছে। নিজের শরীর নিয়ে যা কিছু করার অধিকার তার আছে। কাউকে কৈফিয়তই বা দিতে হবে কেন সে কী করেছে বা যা করেছে কেন করেছে? নাতালিকে মেয়ে বলে না মানা মানে নাতালিকে অশ্রদ্ধা করা, নাতালির মানবাধিকার, ট্রান্সঅধিকার লঙ্ঘন করা। পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছিল, সেই পুরুষাঙ্গটির কারণে লিঙ্গান্তরিত নাতালিকে এখন পুরুষ বলে সম্বোধন করলে তাকে ঘোরতর অপমান করা হয়। ওই কাজটা আমি অন্তত করিনি। তাকে মিস্টার এক্স বলিনি, মিস নাতালি বলেই ডেকেছি। যারা লিঙ্গ বদলেছে, শুধু তাদেরই কেন, শরীরে আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের নারী বলে মনে করছে, বিশ্বাস করছে, তাদেরও নারী হিসেবেই সম্বোধন করা উচিত সবার।

পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অথবা পুরুষ ও নারী, এ নিয়েই যদি মানুষের দুনিয়াটা হত, তাহলে দুনিয়াটা নিতান্তই বেরসিক, বিদঘুটে আর বোরিং কিছু একটা হত। ভালো যে দুনিয়াটা বিচিত্র। ভালো যে দুনিয়াতে দুটো লিঙ্গের বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গ আছে। উভলিঙ্গের কথাই ধরি না কেন, পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ এক শরীরেই জড়াজড়ি করে থাকে। প্রকৃতি যদি সবাইকে নারী ও পুরুষ হিসেবে চাইতো, তাহলে উভলিঙ্গ বলে কিছু থাকতো না দুনিয়ায়।
প্রচুর মেয়ে ওয়াই ক্রোমোজম নিয়ে দিব্যি জীপন যাপন করছে। জিনটা পুরুষের, কিন্তু ‘অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম’ থাকার কারণে অ্যান্ড্রাজেন রিসেপটর কম, ফলে পুরুষ হরমোন বেরিয়ে যে ভ্রুণকে পুরোপুরি পুরুষের ভ্রুণ করে গড়ে তুলবে, তা হয় না। কলকাতার পিংকি প্রামাণিক সম্ভবত এই সিনড্রামের শিকার। আবার ওদিকে অনেকে আছে, জিনটা মেয়েদের, কিন্তু ‘কনজেনিটাল অ্যাডরেনাল হাইপারপ্লাসিয়া’ হওয়াতে মেয়েদের হরমোন জোটে না, সে কারণে তারা মেয়ে হয়েও ঠিক মেয়ে নয়।
প্রাণীজগতে মানুষ ছাড়াও শত শত প্রজাতির মধ্যে আছে বিচিত্র যৌনপ্রবৃত্তি; সমকামিতা, উভকামিতা, রূপান্তরকামিতা। সমকামিতা আগাগোড়া বাস্তব, এ কোনও ব্যতিক্রমী কাম নয়, বিকল্প যৌনতা নয়। সমকামিতা বিষমকামিতার বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতোই স্বাভাবিক। ভেড়া, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সিংহ, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ফাঁক পেলেই সমকামে মেতে ওঠে।
নারীর যৌন আকর্ষণ পুরুষের জন্য, আর পুরুষের যৌন আকর্ষণ নারীর জন্য, এটাই ন্যাচারাল, বা প্রাকৃতিক, বাকি সব অপ্রাকৃতিক, প্রকৃতিবিরুদ্ধ—এরকম ভাবাটা সম্পূর্ণ ভুল। সমকামীর সংখ্যা দুনিয়াতে যে কম নয়, তা মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সব সমকামীকেই এক বাক্সে ফেলা যায় না। সমকামীরা যে সবাই একশভাগ সমকামী তা নয়। বাইজেণ্ডার বা উভকামীর সংখ্যাও প্রচুর। সব উভকামীও একশ ভাগ উভকামী নয়। পুরুষ আর নারীর প্রতি কোনও কোনও উভকামী একই রকম যৌন আকর্ষণ বোধ করে, কেউ কেউ আবার ভিন্ন রকম।
বিচিত্র সব কাম চারদিকে। কেউ কেউ বহুকামী বা পলিজেণ্ডার। কেউ আবার সর্বকামী বা প্যানজেণ্ডার। কেউ কিন্তু নিস্কামী, কোনওরকম কামের বালাই নেই। খাঁটি অ্যাজেন্ডার বা জেন্ডার-নিউট্রাল যাকে বলে। আবার জেণ্ডারকুইয়ারও আছে, যারা নিজেদের নারীও মনে করে না, পুরুষও মনে করে না, বা দুটোই মনে করে, দুটোতেই সাঁতার কাটে, তাদের যৌনপরিচয়-যৌনবোধ-যৌনতা সব একাকার হয়ে যায়। সব কামই, সব যৌন আচরণই–যত কম সংখ্যক লোকই সে আচরণ করুক না কেন–প্রাকৃতিক, যেহেতু প্রকৃতিতেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বেশি সংখ্যক লোক যে আচরণটা করে, সেটাকেই ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তা ধরলেও ভিন্নতাকে আর ভ্যারিয়শনকে স্বাভাবিক বলে না মানার কোনও যুক্তি নেই। সংখ্যালঘুরা প্রকৃতির বাইরের কোনও ঘটনা নয়।

প্রাণীজগতে মানুষ ছাড়াও শত শত প্রজাতির মধ্যে আছে বিচিত্র যৌনপ্রবৃত্তি; সমকামিতা, উভকামিতা, রূপান্তরকামিতা। সমকামিতা আগাগোড়া বাস্তব, এ কোনও ব্যতিক্রমী কাম নয়, বিকল্প যৌনতা নয়। সমকামিতা বিষমকামিতার বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতোই স্বাভাবিক। ভেড়া, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সিংহ, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ফাঁক পেলেই সমকামে মেতে ওঠে। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, বনোবো, যাদের ডিএনএ-র সঙ্গে আমাদের ডিএনএ-র মিল শতকরা আটানব্বই ভাগ, ভীষণই উভকামী। প্রকৃতি শুধু ‘প্রজনন করো, প্রজাতি টেকাও’ মন্ত্র জপে না। প্রকৃতি আরও অনেক কিছু করে। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলেও সমকামিরা সমাজে অপ্রয়োজনীয় নয়। যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য বংশ বিস্তার করা নয়।
সামাজিকতাও যৌনতার উদ্দেশ্য। বনোবোরা হাতের কাছে স্ব-প্রজাতির যাকেই পায়, তার সঙ্গেই যৌনসঙ্গম করে, এর ফলে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুতা গড়ে ওঠে, একজনের বিপদে-বিপর্যয়ে আরেকজন দাঁড়ায়, সকলে মিলে নিজেদের প্রজাতিকে নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচায়। যদি বংশ বিস্তারই প্রজাতির টিকে থাকার পেছনে একমাত্র পদ্ধতি হত, তাহলে পিঁপড়ে, মৌমাছি, বোলতাদের জগতে এত বন্ধ্যা সৈন্য থাকতো না, যাদের কাজ বংশ বিস্তার করা নয়, বরং প্রজাতিকে বাইরের শত্রু থেকে রক্ষা করা।

সমকামীদের এককালে মানসিক রোগী বলা হত। ভয়াবহ নির্যাতন করা হত সমকামীদের। সমকামকে জেনেটিক রোগও একসময় বলা হয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, এ জেনেটিক ভেরিয়েশন বা জেনেটিক প্রকারণ হতে পারে, জেনেটিক রোগ নয়। আর, সমকামিতা কোনও অ্যাণ্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম নয়, কোনও মানসিক রোগ তো নয়ই।
রূপান্তরকামীরা ভুগছে সব দেশেই। তবে সব রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেণ্ডারদের সমস্যা এক নয়। ট্রান্স মেয়েদের সমস্যা ট্রান্স পুরুষের সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি। ট্রান্স মেয়েরা নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা বা মিসোজিনির শিকার। সিস মেয়েরা মেয়ে হওয়ার অপরাধে জন্মের পর থেকে ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলা, হেনস্থা, উৎপাত, উপদ্রব, অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হয়, ট্রান্স মেয়েরা সেসব তো আছেই, আরও দ্বিগুণ লাঞ্ছনার শিকার হয়, কারণ পুরুষের মতো একটা উন্নততর লিঙ্গকে অস্বীকার করে নিম্নলিঙ্গ নারী বনতে যাওয়া যে নিতান্তই বোকামো, পাগলামো, আর ধৃষ্টতা —তা বিরতিহীন বিদ্রুপে লিঙ্গান্তরিত মেয়েদের জীবন জর্জরিত করে জানিয়ে দেয় পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষীরা।

দুনিয়াতে দুষ্ট ধর্মান্ধরা যেমন অন্যের ওপর নিজের ধর্ম চাপিয়ে দিয়ে ঘোর অন্যায় করে, দুষ্ট বিষমকামীরাও ঠিক তেমন অন্যকে বিষমকামী হওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে ঘোর অন্যায় করে । ধর্মান্ধরা ধর্ম-না-মানা মানুষদের আজ শত শত বছর ধরে অত্যাচার করছে, বিষমকামীরাও ঠিক তাই করছে, তাদের হেনস্থা করছে, যারা বিষমকামী বা হেটারোসেক্সুয়াল নয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যাদের যৌন আকর্ষণ নেই। ধর্মীয় আর বিষমকামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে আজ মানববাদী, নাস্তিক্যবাদী, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত, লিঙ্গান্তরিতরা সিঁটিয়ে থাকে।
বিবর্তনের ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ বিবর্তনে না বিশ্বাস করে ভগবানে করছে, যে ভগবানের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ মেলেনি। যুক্তি বুদ্ধির সমুদ্রে মানুষকে ডুবিয়ে রাখলেও মানুষ অনড় মূর্খতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। প্রকৃতি থেকে তুলে যত প্রমাণই চোখের সামনে রাখি না কেন, রূপান্তরকাম, সমকাম, উভকাম –কোনওটাই ন্যাচারাল নয়, এমন কথা বলবেই কিছু লোক। ধরা যাক, ন্যাচারাল নয়। তাতে কী? সবাইকে ন্যাচারাল হতেই বা হবে কেন, শুনি? ন্যাচারাল ব্যাপারগুলো বরাবরই বড় পানসে। ন্যাচারাল হওয়ার জন্য স্বাধীনতা বা অধিকারের দরকার হয় না, আন-ন্যাচারাল হওয়ার জন্য দরকার। আন-ন্যাচারাল হওয়ার জন্য বুকের পাটারও বেশ দরকার।

‘প্রকৃতি’কে হাতিয়ার করে মূর্খ আর দুষ্ট লোকেরা কি আজ থেকে মানুষকে ভোগাচ্ছে! একসময় মেয়েদের লেখাপড়া করা, ঘরের বার হওয়া, চাকরি বাকরি করা, সব কিছুকেই এরা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বলেছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় এসব। প্রকৃতির কিছই না জেনে প্রকৃতি-বিশেষজ্ঞ সাজার লোক চারদিকে প্রচুর।
প্রকৃতি চিরকালই বিস্ময়কর, বৈচিত্রময়, বর্ণময়। যৌনতার মতো। আবার, আরও একটা প্রশ্নও এখানে করা যায়, কে বলেছে প্রকৃতির সবকিছু সবসময় ভালো এবং গ্রহণযোগ্য, কে বলেছে প্রকৃতিকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ? প্রকৃতিকে দিনরাত আমরা অস্বীকার করছি না? অস্বীকার করে নির্মাণ করছি না প্রকৃতি যা দিতে পারে, তার চেয়েও চমৎকার কিছু? পঙ্গু শিশু জন্ম নিলে তার পঙ্গুত্ব সারাচ্ছি, নকল হিপ লাগাচ্ছি, পা লাগাচ্ছি, ফুটো হৃদপিণ্ড নিয়ে জন্মাচ্ছে, নকল হৃদপিণ্ড অবধি লাগিয়ে নিচ্ছি। আমাদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা সারাতে কাগজ-কলম-কম্পিউটার ব্যবহার করছি। নানা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রকৃতির ভুল ভ্রান্তি, প্রকৃতির অপারগতা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা সংশোধন করছি প্রতিদিন, আমাদের ডানা নেই, বিমান বানিয়েছি ওড়ার জন্য, প্রকৃতি আমাদের যে চোখ দিয়েছে, তার ক্ষমতা যথেষ্ট নয় বলে টেলেস্কোপ বানিয়েছি, মাইক্রোসকোপ ব্যবহার করছি।

সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের সমান। পুরুষ লিঙ্গের যেমন অধিকার, নারী লিঙ্গেরও একই অধিকার, উভলিঙ্গেরও একই। হেটারোসেক্সুয়াল বা বিষমকামীদের অধিকার যতটুকু, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদেরও ততটুকুই। এতে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের মানবাধিকারে বিশ্বাস নেই। যারা সমকামী আর রূপান্তরকামীদের নিগ্রহ করছে, যারা সিসজেণ্ডার আর বিষমকামী ছাড়া, অর্থাৎ পুংলিঙ্গের পুরুষ ও নারী-লিঙ্গের নারী ছাড়া আর সবাইকে, পুরুষ আর নারীর কাম ছাড়া আর সব কামকে অস্বাভাবিক আর প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করছে—তাদের শিক্ষিত করা, সচেতন করা, মানুষ করা অত্যন্ত জরুরি। আকাটমূর্খের সংখ্যা বেশি বলেই তাদের মূর্খামি মেনে নিতে হবে, গণতন্ত্রও বলে না। গণতন্ত্র মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে। সমকামী বলে বা রূপান্তরকামী বলে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়, অধিকার কিছু কম জোটে কোথাও, তবে তা নিতান্তই বিষমতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়।
বিবর্তনের ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ বিবর্তনে না বিশ্বাস করে ভগবানে করছে, যে ভগবানের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ মেলেনি। যুক্তি বুদ্ধির সমুদ্রে মানুষকে ডুবিয়ে রাখলেও মানুষ অনড় মূর্খতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। প্রকৃতি থেকে তুলে যত প্রমাণই চোখের সামনে রাখি না কেন, রূপান্তরকাম, সমকাম, উভকাম –কোনওটাই ন্যাচারাল নয়, এমন কথা বলবেই কিছু লোক। ধরা যাক, ন্যাচারাল নয়। তাতে কী? সবাইকে ন্যাচারাল হতেই বা হবে কেন, শুনি?
রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চলছে চারদিকে। ওরা চাইছে নিজের জেণ্ডার নিজের নির্ণয়ের অধিকার এবং সেই জেণ্ডারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার অধিকার, রূপান্তরকামী বলে নিগৃহীত না হওয়ার অধিকার, নিজের জৈবলিঙ্গকে পরিবর্তন করার অধিকার, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার অধিকার, যৌনসঙ্গমের অধিকার, বিয়ে করার অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার। যে সমাজে আজও নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে লাঞ্ছিত হতে হয়, সে সমাজে সমকামী আর রূপান্তরকামীদের অধিকারের জন্য আরও দীর্ঘ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হবে, অনুমান করতে পারি। মানুষ প্রজাতি সেদিন সত্যিকার সভ্য হবে, যেদিন কোনও মানুষকেই নিজের মৌলিক অধিকারের জন্য আর লড়াই করতে হবে না।
সমকামী আর রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘন না হয়, তা লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব সমকামী আর রূপান্তরকামীদেরই শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামীদেরও। মানবতার জন্য সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। সবাই যদি এগিয়ে নাও আসে, তাহলেও ক্ষতি নেই। লক্ষ লক্ষ লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। ইতিহাস বলে, হাতে গোণা কিছু সাহসী আর স্বপ্নবান মানুষই সমাজ বদলায়।

একবিংশ শতাব্দি চলছে। মানুষ আর কবে সভ্য হবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনও বুঝি গুহায় বাস করছে মানুষ। হাজার বছর ধরে খেটে খুটে যা একখানা সমাজ বানিয়েছে, মূর্খতার জাঁকালো উৎসবই চলে এখানে প্রতিদিন। সমাজের চেহারা চরিত্র দেখলে মনে হয়, এগুলো আর কিছু নয়, এক একটা অন্ধকার গুহা। মানুষগুলো চোখ কান বন্ধ করে অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গুহা থেকে বেরোচ্ছে না, চোখে আলো লাগবে এই ভয়ে আলোর দিকেও তাকাচ্ছে না।
*পরবর্তী কলাম প্রকাশ পাবে ৯ই জুলাই, ২০২৪
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী মুখ তসলিমা নাসরিন। বাঙালি হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক। গদ্য ও কবিতার সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ তসলিমার। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি তাঁকে আমরা চিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও নারীবাদী একজন চিন্তাশীল হিসেবেও। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, মানববাদ, বিজ্ঞান ও সহনশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি তাঁর বিশ্বব্যাপী উদার ও মুক্তচিন্তার জন্য দেশে-বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননায়। 'নির্বাচিত কলাম' ও আত্মজীবনী গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দু'দুবার আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারভ পুরস্কার। ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার, কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। লিখেছেন 'ফেরা', 'লজ্জা', 'ফরাসি প্রেমিক'-এর মতো অসামান্য উপন্যাস; বেশ কিছু ছোটগল্প, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ।
One Response
বাহ কি দারুন কথা সত্যিই মন ছুঁয়ে গেল