শিশুদের যারা ধর্ষণ করে, তারা কিন্তু সবাই শিশুকামী নয়। শিশুদের ধর্ষণ করার মূল কারণ, শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ধর্ষণে বাধা দিতে পারে না। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে ধর্ষণ করতে গেলে ধর্ষকেরা সব সময় সফল হয় না, কিন্তু শিশু-ধর্ষণ ব্যর্থ হয় না বললেই চলে। কয়েক-মাস আগে কেরালার কোচির পাশেই আলুভা শহরে বিহারের বাসিন্দা অভিবাসী শ্রমিক আসফাক আলম নামের এক লোক ৫ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে। সেই মামলার রায় সবে বেরিয়েছে। আসফাক আলমের যাবজ্জীবন হয়ে গেছে। ওদিকে বিহারের বেগুসরাইয়ে আরও একটি ধর্ষণ ঘটেছে। সকালে গোবর্ধন পুজোর জন্য কলাপাতা আনতে একটি পার্কে গিয়েছিল ৮ বছর বয়সী একটি মেয়ে। কলাপাতা নিয়ে মেয়েটি আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। একপাল পুরুষ তাকে ধর্ষণ করেই শান্ত হয়নি, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে নগ্ন ফেলে রেখে গেছে কলাগাছের কাছে। রাজস্থানের দৌসা এলাকায় এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টর। লোকটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধর্ষকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে,তাদের জেল জরিমানা হচ্ছে। কারও কারও যাবজ্জীবন হচ্ছে, কিছু ধর্ষককে তো মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণ তো বন্ধ হচ্ছে না।

কেরালায়, বিহারে, রাজস্থানে যে ধর্ষণ সম্প্রতি ঘটেছে, তা ঘটিয়েছে পরিবারের বাইরের লোক। কিন্তু জরিপে আমরা বারবারই দেখি মেয়েদের ধর্ষণ, অপমান, মারধোর ইত্যাদি পরিবারের লোক, বা কাছের পুরুষই বেশি করে। যদিও এই কাছের পুরুষদেরই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি আপন ভাবে। তারা কাছে থাকলেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে। পৃথিবীতে যে মেয়েরা এ যাবৎ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাদের ধর্ষকদের তালিকায় অপরিচিত, অচেনা লোক যত আছে, তার চেয়ে বেশি আছে তাদের বাবা, ভাই, মামা, কাকা, প্রেমিক, স্বামী, শ্বশুর, ভাশুর, দেবর, প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক। কী ভয়ঙ্কর রোমহর্ষক এইসব তথ্য!
মেয়েদের সত্যি বলতে কী, কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই। ধর্মীয় আইন তাকে নিরাপত্তা দেয় না, অর্থাৎ রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা দেয় না, বিদ্যালয় দেয় না, রাস্তাঘাট দেয় না অর্থাৎ সমাজ তাকে নিরাপত্তা দেয় না। ঘর তাকে নিরাপত্তা দেয় না অর্থাৎ পরিবারও তাকে নিরাপত্তা দেয় না। কোথায় যাবে একটা মেয়ে? নিজের শরীর নিয়ে সর্বদা তার লজ্জা এবং ভয়। যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গায়— ঘরে অথবা বাইরে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে যে কেউ। প্রতিনিয়ত এই আশঙ্কা একটি মেয়েকে বহন করতে হয়।

পুরুষেরা সাধারণত মেয়েদের যৌনদাসীই মনে করে। শৈশব থেকে তাদের এই ধারণা দিয়েই বড় করা হয়েছে— মেয়েরা পুরুষের চেয়ে বুদ্ধিতে কম, বিদ্যায় কম, শক্তিতে কম, শৌর্যে কম, তাদের কাজ শারীরিক অর্থনৈতিক সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, পুরুষের সেবা করা, পুরুষকে সুখী করা, পুরুষের সন্তান প্রসব করা, সন্তানদের লালন পালন করা। নারী নামের এই ইতর শ্রেণীর প্রাণীকে প্রাণী হিসেবে শ্রদ্ধা করার, বা মানুষ হিসেবে সম্মান করার কোনও কারণ পুরুষেরা দেখে না। সে কারণে ধর্ষণ ঘটায়।
সে কারণে মেয়েদের কাপড় চোপড় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সে কারণে বোরখা হিজাবের ব্যবহার বাড়ে। মেয়েরা কোনও না কোনও পুরুষের সম্পত্তি। সেই পুরুষ চায় না তার সম্পত্তির ওপর লোভ করুক অন্য কোনও পুরুষ, সে কারণেই হিজাব–বোরখা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় শরীর। শরীরটাই মেয়েদের মূলধন। শরীরটা স্বামীর ভোগের জন্য, সুতরাং একে অক্ষত রাখতে চায় স্বামীরা। তাহলে সেই বৃদ্ধাকেও কেন শরীর ঢেকে রাখতে হয়, যার মালিক মরে গেছে? সেই মালিকের সম্মানেই ঢেকে রাখতে হয়। স্বামী মৃত হলেও স্বামী। স্ত্রী সতীত্ব বজায় রাখলে স্বামীর পুণ্য হবে। সুতরাং যা কিছু মেয়েরা করে, সবই স্বামীর আরামের জন্য, আয়েশের জন্য, সুখ-শান্তি আর সুস্থতার জন্য, ভোগের জন্য, মঙ্গলের জন্য।

আসলে আমাদের সংস্কৃতিটাই ধর্ষণের। ধর্ষণের বলেই রাস্তাঘাটে, অলিতে গলিতে, পাহাড়ে সমুদ্রে, ট্রেনে-বোটে, ভিড়ে নির্জনে, রাতের অন্ধকারে একা–মেয়েদের দেখা খুব একটা মেলে না। কারণ মেয়েরা একা যায় না ওসব জায়গায়, যায় না ধর্ষণের ভয়ে। কোনও অচেনা পুরুষকে ঘরে ঢুকতে দেয় না ধর্ষণের ভয়ে। কোনও পুরুষের ঘরে একলা ঢোকে না ধর্ষণের ভয়ে। ছাত্রীনিবাসগুলোকে ছাত্রাবাস থেকে আলাদা করা হয় ধর্ষণের ভয়ে। কিছুটা বড় হওয়ার পর পরিবারের পুরুষ থেকে সরিয়ে আলাদা বিছানায় মেয়েদের ঘুমোতে দেওয়া হয়, ধর্ষণের ভয়ে। এই ধর্ষণের ভয় একটু একটু করে একটি মেয়ে যখন বড় হতে থাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার সমস্ত অস্তিত্বে। স্বাভাবিক জামাকাপড়ের ওপর বাড়তি কাপড়– ওড়না, হিজাব, বোরখা ইত্যাদি পরতে হয় ধর্ষণের ভয়ে। ধর্ষণের ভয়েই যে মেয়েদের চালচলন পুরুষের চেয়ে ভিন্ন, তা, ধর্ষণ যদি সংস্কৃতির অংশ না হত, চোখে পড়ত। সংস্কৃতির অংশ বলেই ধর্ষণের হাত থেকে শরীরকে বাঁচানোর জন্য মেয়েরা যা যা পদক্ষেপ করে, তা স্বাভাবিক বলেই মনে হয় সবার কাছে।
ধর্ষণ কখনও মেয়েদের সমস্যার কারণে ঘটে না। ঘটে পুরুষের সমস্যার কারণে। আজ পর্যন্ত পুরুষেরা এটি বন্ধ করতে পারেনি। অবশ্য বন্ধ করতে চাইলে করতে পারত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা মানুষের সমাজে ‘মেয়ে’ হয়ে জন্মেছি। এর চেয়ে মানবেতর জন্ম বোধ হয় প্রাণীজগতে আর নেই।

ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের পেছনে হাজারো কারণ, সেই কারণগুলো দূর করতে হবে, তা না হলে নারী-নির্যাতন, যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটতেই থাকবে। স্বল্প পোশাক না পরার, সন্ধের পর বাড়ি থেকে বের না হওয়ার, রাতের উৎসবে না যাওয়ার, নির্জন রাস্তায় হাঁটাচলা না করার, ক্লাবে-হোটেলে না ঢোকার যে পরামর্শ অহরহ দেওয়া হয় মেয়েদের, সেটি মেয়েদের না দিয়ে বরং যারা দোষ করে তাদের অর্থাৎ পুরুষদের দেওয়া উচিত। মেয়েদের উপস্থিতি দেশের সর্বত্র, রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে, অফিস আদালতে, ইস্কুল কলেজে, মাঠে ময়দানে, ক্যাফে রেস্তোরাঁয়, ক্ষেতে খামারে, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আরও হওয়া দরকার। যত রাতই হোক মেয়েরা বেরোবে। শেকল ছিঁড়ে মেয়েরা যত বেরোবে, বাইরের দুনিয়াটা তত মেয়েদের হবে। অন্দরমহলে বাস করে বাইরের পৃথিবীকে নিরাপদ করা যায় না।
আমার মনে হয় যারা ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়া, ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করা, ধর্ষককে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা ইত্যাদির জন্য চিৎকার করে, তাদেরও অনেকে খুব গোপনে বিশ্বাস করে ধর্ষণের কারণ মেয়েরাই। মেয়েরা যদি সংযত হয়ে চলাফেরা করত, যদি ঠিকঠাক পোশাক পরত, রাতে একা না বেরত, তাহলে ধর্ষণ হত না। বড় বড় বুদ্ধিজীবীই বিশ্বাস করেন ধর্ষণে। বিশ্বাস করেন মেয়েদের ‘না’ মানে ‘হ্যাঁ’, বিশ্বাস করেন একটু জোর না করলে যৌনতায় আনন্দ নেই। সাধারণ মানুষ ব্যতিক্রম হলে কতটাই বা হবে!

ধর্ষককে কঠোর শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষণ বন্ধ হবে মানুষকে যদি শিক্ষিত আর সচেতন করে গড়ে তোলা হয়, নারীর সমানাধিকারে যদি মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়, যদি তাদের মানবতাবাদী, নারীবাদী হিসেবে বড় করা হয়। সবচেয়ে মূল্যবান হল, অপরাধ যে কারণে হচ্ছে, সেই কারণটি নির্মূল করা। এই কাজটি কেউ করতে চায় না। সবাই সোজা পথটি ধরতে চায়। সোজা পথটি হল, অপরাধীকে মেরে ফেল। চোখের বদলে চোখ নিয়ে নাও, রক্তের বদলে রক্ত। এর নাম কিন্তু বিচার নয়, এর নাম প্রতিশোধ। এটি করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়। জনগণ ভাবে অপরাধ দমনে সরকার বিরাট এক ভূমিকা নিয়েছে।
মূর্খ রাজনীতিবিদরা সমাজকে যত নষ্ট করে, তত নষ্ট সম্ভবত ধর্ষকরাও করে না। ধর্ষকদের দোষ দিয়ে ধর্ষণের মূল কারণকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়। ধর্ষক হয়ে কিন্তু কেউ জন্মায় না। এই পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, সমাজের কুশিক্ষা, ভুল-শিক্ষা, নারী-বিদ্বেষ, নারী-ঘৃণা পুরুষকে ধর্ষক বানায়। ধর্ষিতাকে দোষ দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষককে ফাঁসি দিয়েও ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। আবারও বলছি, ধর্ষণের মূল কারণগুলোকে নির্মূল করতে পারলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে।
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী মুখ তসলিমা নাসরিন। বাঙালি হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক। গদ্য ও কবিতার সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ তসলিমার। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি তাঁকে আমরা চিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও নারীবাদী একজন চিন্তাশীল হিসেবেও। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, মানববাদ, বিজ্ঞান ও সহনশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি তাঁর বিশ্বব্যাপী উদার ও মুক্তচিন্তার জন্য দেশে-বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননায়। 'নির্বাচিত কলাম' ও আত্মজীবনী গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দু'দুবার আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারভ পুরস্কার। ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার, কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। লিখেছেন 'ফেরা', 'লজ্জা', 'ফরাসি প্রেমিক'-এর মতো অসামান্য উপন্যাস; বেশ কিছু ছোটগল্প, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ।
2 Responses
I really liked your site. Do you mind https://zetds.seychellesyoga.com/info
যতক্ষণ না পুরুষদের চেতনার উদ্রেক হবে ততক্ষণ ধর্ষণ চলতেই থাকবে। এরজন্য মায়েদের শিক্ষিত হতে হবে। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। মায়েদের উচিত নিজের মেয়েকে যেভাবে শিক্ষা দেন সেভাবেই নিজের ছেলেকে ও শিক্ষা দেওয়া। শৈশব থেকেই মেয়ে এবং ছেলেকে দুচোখে দুরকমভাবে না দেখে একচোখেই একরমভাবে দেখা এতে নারী পুরুষের বৈষম্যটা দূর হবে, বিদ্বেষভাবটা হবে না। সমান চোখে দেখাটা মাকে রপ্ত করাতে হবে শৈশব থেকে। নারী পুরুষের ভিত থেকেই শুরু করতে হবে। আমি মায়েদেরই এজন্য দায়ী করি। একটা মেয়ের শিক্ষা যদি সর্বতোভাবে গড়ে উঠতে পারে তাহলে একটা ছেলের মধ্যে এই শিক্ষার অভাব দেখা দেয় কেন? এরজন্য মায়ের শিক্ষাই দায়ী। মায়ের মন থেকে আগে নারী পুরুষের ভেদাভেদ দূর করতে হবে, সন্তান হবার আগে মায়েদের কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন আছে। ছোট থেকেই একই বাড়ীতে ভাই বোনেরা মানুষ হওয়ার সময় ভাইয়েরা হয়ে যায় স্বার্থপর, নারীবিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন, নারীদের নীচু চোখে দেখা, হেয় জ্ঞান করা, নিজেকে পুরুষ বলে সর্বেসর্বা ভাবতে শেখা, তার মতামতকে বাড়ীতে গুরুত্ব দেওয়া, নিজের বোনদের কোন অধিকার নেই এই সংসারে এই সমস্ত ভুল ধারণা পোষণ করার জন্য আমি অশিক্ষিত মাকেই দায়ী করি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মায়েরাই তৈরী করে একটা পরিবারের মধ্যে যার জন্য নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অত্যাচার ঘটতেই থাকবে যতক্ষণ না মায়েদের মনোভাব না পাল্টাবে, না চৈতন্যের উদয় হবে ততক্ষন।