মা আসছেন বছর ঘুরে
পুজোর হাওয়া জগৎ জুড়ে!
পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালি থাকুক না কেন, শরতের এই হিমেল হাওয়ায় মন যেন হারিয়ে যায় কাশফুল আর ঢাকের তালে। অজান্তেই আকাশে-বাতাসে ধুনোর এক মাতাল করা গন্ধের আবেশে মন ভরে ওঠে আনন্দে। ইংল্যান্ডের লিড্স শহরের বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়।
[the_ad id=”266918″]
আজ থেকে ৩৮ বছর আগে এপার ওপার বাংলার কিছু প্রবাসী বাঙালী পরিবারের উদ্যোগে ইংল্যান্ডের লিড্স শহরে স্বল্পপরিসরে দুর্গাপূজো পালনের সূচনা করা হল। ইংল্যান্ডের বুকে এসে এপার-ওপার বাংলা মিলেমিশে এক। তাই আজও আমরা গর্বের সঙ্গে বলি – ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’। তবে প্রতিষ্ঠালগ্নের তুলনায় এখন বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের বিপুল বিস্তার ঘটেছে। ফলে বর্তমানে অনেকটাই বৃহত্তর পরিসরে পূজার আয়োজন করা হয়। পূজার দিনগুলোতে প্রতিষ্ঠানের শতাধিক সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবীর নিরলস ও কঠোর পরিশ্রম শারদোৎসবের ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে এবং তার সুনাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

লিড্স-এর পুজোর কিছু বিশেষত্বের কথা আপনাদের কাছে তুলে ধরা যাক। প্রথম বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গেলে বলা যায় বাঙালির প্রথম ভালোবাসা হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মহালয়া অর্থাৎ পিতৃপক্ষের পরিসমাপ্তিতে যখন বেজে ওঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, তখন আমরাও মেতে উঠি মহালয়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে, বহু বছর প্রবাসে থেকেও আমরা নিপুণভাবে পরিবেশন করে আসছি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতিনাট্য। আমাদের পূজা কমিটির সদস্য এবং স্বেছাসেবীদের পরিবারের লোকজনই অনুষ্ঠান করি। ঐতিহ্য পরম্পরায় আমাদের কোনও রকম ব্যত্যয় ঘটে না শাস্ত্রমতে পূজা অর্চনার নিয়মনীতিতে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনায়। ইংল্যান্ডের লিড্স হচ্ছে মাল্টিকালচারাল সামাজিক ভিত্তিসম্পন্ন একটি শহর। আশার বিষয়, এই পরিবেশে আমাদের ছেলেমেয়েরা, যারা বড় হচ্ছে, তারা প্রায় সম্পূর্ণ মাত্রায় ধরে রেখেছে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য। এই প্রবাসে আমরা প্রতি বছর আনন্দ করে দুর্গাপূজা পালন করি। বিভেদ কষ্ট দূরে ঠেলে নিজেদের মধ্যে এক আত্মিক সৌহার্দ্য ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হই।

লিড্সে পূজা শুরু হয়েছিল মাটির প্রতিমা দিয়ে। প্রথম মাটির প্রতিমা আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। তারপর দিল্লি এবং পরবর্তীকালে স্বর্গীয় শ্রী পূর্ণেন্দুকুমার দাসের উদ্যোগে এবং তাঁর অর্থানুকূল্যে ফাইবারগ্লাসের তৈরি মূর্তি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সহযোগিতায় সরাসরি কুমারটুলি থেকে আনা সম্ভব হয়েছিল এই লিড্স শহরে। এখন বাঙালি সংগঠনের চেয়ারপার্সন ডঃ শিখা সাহা এবং সামাজিক সম্পাদক বিপ্রদাস রাজবংশী এই আয়োজনের মুখ্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম।
[the_ad id=”270086″]
তবে এই প্রবাসে সপ্তাহান্ত ছাড়া পূজার আয়োজন করা কঠিন। কাজের দিনগুলোতে পূজায় দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কম হয়। তাই বহু শহরেই সপ্তাহান্তে পূজার আয়োজন করা হয়। আমাদের লিড্সের পূজার আরও একটি বিশেষত্ব হল, বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মেনে নির্দিষ্ট দিনে শারদীয় পূজার মতো লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা এবং সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। পঞ্জিকা মতে শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী প্রতিদিন পূজা হয়। লিড্সের দুর্গাপূজার পাঁচ দিন দিনেরাতে ভোগ এবং পূজা শেষে দর্শনার্থীদের প্রসাদ বিতরণে উৎসবের আর একটি মাত্রা যোগ হয়।

প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেরা মন্দিরের রান্নাঘরে আধুনিক চুল্লিতে বাঙালির প্রিয় নিরামিষ ভোগ রান্না করেন, পরিবেশন করেন। শুধুমাত্র ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ছাড়াও আশপাশের এলাকা, এমনকি বহু দূরের শহরগুলো থেকেও পরিবার পরিজন নিয়ে পূজার প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনের মতো বাঙালিরা আসেন পূজায় অংশ নিতে। পুজো হয় লিড্স শহরের হিন্দু মন্দিরে। একদিকে দুর্গাপূজার প্রাঙ্গণে অবিরাম ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খ, উলুধ্বনি, ধূপধুনো, মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে পূজার আবেশে মুখরিত হয়ে উঠে চারিদিক, তখন ঠিক মন্দিরের আর এক প্রান্তে তালে তালে উত্তর ভারতীয় গরবার ছন্দে মেতে ওঠে তরুণ-তরুণীর দল। সে যেন এক আশ্চর্য মিলনোৎসব!লিড্সের পুজোতে পুষ্পাঞ্জলি অনুষ্ঠিত হয় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সুশৃঙ্খল ভাবে। আরতিও হয় খুব ধুমধামে। ধূপধুনোয় ঢাক কাঁসরের তালে সকলে দল বেঁধে নেচে পুজোর আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। দশমীর দিনে যে সিঁদুর খেলা হয়, আশপাশের কোথাও এমন আনন্দ হয় না।
[the_ad id=”266919″]
প্রতি বছরের মতো ২০২০ সালেও আমাদের পরিকল্পনা ছিলো উৎসাহ উদ্দীপনায় দূর্গাপূজা পালন করা হবে। কিন্তু অদৃশ্য এক অতিমারির কবলে মানবজাতি আজ ত্রস্ত। করোনার ভয়াল থাবা থেকে এই প্রবাসে আমরাও মুক্ত নই। আমাদের সব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা কোভিডের কারণে বাতিল করতে হয়েছে। তবে আমরা নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেবার আয়োজন করেছি। ই-ব্রশিওর তৈরি করা, অনলাইন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং ঘরে থেকে পূজা-প্রার্থনা। এবার দেবীর আগমন দোলায়। শাস্ত্রমতে, তাই মহামারীর কবলে আজ মানবজাতি। এ বছর পূজা শেষে দেবীর হবে গজে গমন, তাই শস্যপূর্ণ হবে বসুন্ধরা। আশা রাখি আমরা ভক্তের দল আগামীতে পূজা করব করোনা মুক্ত পরিবেশে। মায়ের কাছেও এই প্রার্থনা জানাই!
অভ্র পেশাগত ভাবে আইটি-র সঙ্গে যুক্ত। ইয়র্কশায়ার কাউন্টির লিডস শহরে রয়েছেন বছর দশেক। লিডস দুর্গাপুজো অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা। এছাড়া গানের প্রতি ওঁর অফুরন্ত টান ও ভালোবাসা। সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। এখন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিকালের তালিম নিচ্ছেন। লিড্সে বহু অনুষ্ঠান করেছেন।