১৯৬২ সাল। পদ্মশ্রী পুরস্কারের মঞ্চ। স্বাধীন ভারতের সরকার প্রদত্ত এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিতে বাকি প্রাপকেরা সকলে এসেছেন গলাবাঁধা কোট পরে। সে ভিড়ের ভেতর এক আদ্যোপান্ত বাঙালি, সুঠাম দেহ, চওড়া কাঁধ- শক্ত চোয়াল- ধুতি পাঞ্জাবিতে সেজে এসে দাঁড়িয়েছেন মঞ্চের সামনে। সদর্পে জানালেন এই পোশাকেই তিনি পুরস্কার নেবেন। মোহনবাগান মাঠে ব্রিটিশদের তৈরি গ্যালারিতে এতকাল বসেননি তিনি। এই স্বজাতি ও স্বদেশচেতনা যেন তাঁর মধ্যে দিয়েই ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলা ফুটবলের প্রাঙ্গনে। অথচ, কী আশ্চর্য রেকর্ডবুক বলছে কুচবিহার কাপ ছাড়া তিনি একটিও ট্রফি জেতেননি মোহনবাগান দলের হয়ে ফুটবল খেলে। অথচ, জনপ্রিয়তা এমনই যে ময়দানে পা রাখলে জনতার ভিড়ে লাঠি চালাতে হয় পুলিশকে- মঞ্চে পুরস্কারের সময় তাঁর নাম নেওয়া হল। তবে নামের আগে যে উপাধি উহ্য রাখা হল তা হল – ‘দ্যা চাইনিজ ওয়াল’ (The Chinese Wall), যেটুকু বলা হল তা হল গোষ্ঠ পাল- ব্রিটিশ শাসনে বাঙালির বৃহত্তম ফুটবল আইকন…
কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল ফুটবল আরও বেশি করে। নাগরিকতার সোপান হিসেবে উঠে এল ফুটবল, স্বদেশী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠে এল ফুটবল। ১৯০৭ থেকে ১৯১২, পাঁচ বছর কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলে নজর কাড়লেন গোষ্ঠ।
বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার ভোজেশ্বর গ্রামের গোষ্ঠ বিহারী ছেলেবেলা থেকেই ফুটবল পাগল। ছেলের চেহারা দেখে সকলে প্রথমে বলেছিল কুস্তির আখড়ায় যেতে; যেমন লম্বা তেমনি চওড়া কাঁধ। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলার জন্য প্রাথমিক ভাবে যে বিশাল শারীরিক শক্তির দরকার তা যেন কিছুটা স্বয়ং ফুটবল ঈশ্বরই দিয়েছিলেন গোষ্ঠ পালকে। কলকাতা এসে ঠিক করেন তিনি ফুটবলই খেলবেন, মাত্র ১১ বছর বয়সে ফুটবলের আঁতুরঘর কলকাতায় একটি ক্লাবে সুযোগও পান তিনি আর তার কয়েকবছর পরেই মোহনবাগান আই এফ এ শিল্ড জেতে। গোষ্ঠ পালের আদর্শ হয়ে উঠলেন তৎকালীন মোহনবাগান ক্যাপ্টেন শিবদাস ভাদুড়ি। কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল ফুটবল আরও বেশি করে। নাগরিকতার সোপান হিসেবে উঠে এল ফুটবল, স্বদেশী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠে এল ফুটবল। ১৯০৭ থেকে ১৯১২, পাঁচ বছর কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলে নজর কাড়লেন গোষ্ঠ। গোষ্ঠ পালের ফুটবল নজরে এসেছিল সে সময়ের দুখীরাম মজুমদার, শৈলেন বসু, কালীচরণ মিত্রদের। তাঁর বিশাল চেহারা ও ভয়ংকর ট্যাকল ব্রিটিশদলগুলোর বিপক্ষে যে বড় হাতিয়ার হতে চলেছে তা বুঝতে পারছিলেন কলকাতার ফুটবল কর্তারা। ১৯১২ সালে গোষ্ঠ পালের পা পড়ল মোহনবাগান তাঁবুতে। তাঁকে নিয়ে এলেন শৈলেন বসুই। অমর একাদশের একমাত্র বুট পরা খেলোয়াড় রেভারেন্ড সুধীর চ্যাটার্জির জায়গায় এলেন তিনি। আর আজ ১১২ বছর পর সে মোহনবাগান তাঁবুর সামনের রাস্তাটির নামই গোষ্ঠ পাল সরণী- ইতিহাসের দাগ কী অদ্ভুত, না?
তার চেয়েও অদ্ভুত, ২৩ বছর সবুজমেরুন জার্সি গায়ে কিংবদন্তী হয়ে ওঠার পরেও গোষ্ঠপালের হাত ধরে কোনওদিন বড় ট্রফি জেতেনি মোহনবাগান। অথচ, মোহনবাগানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ই তিনি স্বয়ং। কেন?
১৯১১ সালে পরপর পাঁচটি ইউরোপীয় দলকে হারিয়ে শিল্ড জিতলেও কলকাতার বুকে খেলে বেড়ানো নর্থ স্ট্যাফোর্ড, মিডলসেক্স, লিস্টার্স, হাইল্যান্ড ইনফ্যান্টির মতো বিলিতি দলকে প্রথম কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে গোষ্ঠপালের বাগান। মনে রাখা দরকার এটি কিন্তু কোনও একটি টুর্নামেন্টে না, ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর।
গোষ্ঠ পালের কলকাতা আগমনের পর মোহনবাগান দল ক্রমশই ব্রিটিশদলগুলির বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই দিতে শুরু করে। ১৯১১ সালে পরপর পাঁচটি ইউরোপীয় দলকে হারিয়ে শিল্ড জিতলেও কলকাতার বুকে খেলে বেড়ানো নর্থ স্ট্যাফোর্ড, মিডলসেক্স, লিস্টার্স, হাইল্যান্ড ইনফ্যান্টির মতো বিলিতি দলকে প্রথম কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে গোষ্ঠপালের বাগান। মনে রাখা দরকার এটি কিন্তু কোনও একটি টুর্নামেন্টে না, ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর। কলকাতা ফুটবল লিগে প্রথম নন-মিলিট্যান্ট টিম হিসেবে মোহনবাগানকে প্রথম ডিব্বহিশনে তোলেন গোষ্ঠ পাল। মাঠে নেমে তাঁর বিশাল চেহারা আর অবিশ্বাস্য ট্যাকলের জোরে যেভাবে ব্রিটিশদের নাস্তানাবুদ করতেন সে কিসসা বিপ্লব হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তৎকালীন সমাজেও। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবার আগে, ব্রিটিশ বিরোধী বাংলার আন্দোলনের সামনে বল পায়ে এক ভরসা দিয়ে যাচ্ছিলেন গোষ্ঠ পাল। গোষ্ঠপালের পুত্র নীরাংশু পাল বলছিলেন- বাবা ছিলেন জেল না খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। ফুটবল পায়ে যে ব্রিটিশদের পিছু পা করে দেওয়া যায় এ বিশ্বাস ধারাবাহিকভাবে বাঙালির রক্তে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন গোষ্ঠ পাল। শোনা যায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস গোষ্ঠপালের খেলা দেখতে এসেছিলেন একবার। সুভাষ বোস এবং গোষ্ঠপাল ছিলেন সমবয়সী। তবু প্রত্যক্ষ সখ্য গড়ে ওঠেনি। কিন্তু গোষ্ঠ পাল মোহনবাগানের সভাপতি ভূপেন বসুকে কংগ্রেসের নরম-চরমপন্থার বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। গোষ্ঠ পাল কেবল বিলিতি দলের বিপক্ষে মোহনবাগানের পারফরমেন্সকে ধারাবাহিক ভাল করেছিলেন তাই-ই নয়, গোষ্ঠপালই প্রথম ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে দল নিয়ে সিংহল যাত্রা করেছিলেন যা সেই সময়ে ছিল প্রায় অকল্পনীয়। এই সিংহল থেকে ফেরার পর তাঁর বাড়িতে পা রেখেছিলেন স্বয়ং গান্ধীজি। ১৯২৭-২৮ সাল নাগাদ মোহনবাগান দল যখন শান্তিনিকেতন যাত্রা করে তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ গোষ্ঠ পালকে দেখে আপ্লুত হন।
মার্তা- এক সমান্তরাল ইতিহাসের মূলস্রোতে আসার দস্তান : অর্পণ গুপ্ত
গোষ্ঠ পালের বিয়ে নিয়ে এক মজার ঘটনা অনেকে জানেন না। তাঁর বিয়েতে উপস্থিত হয়ে মোহনবাগানের শৈলেন বসু একটি সোনার মেডেল উপহার দেন তাঁকে। সেই মেডেলটি ছিল ১৯১১ শিল্ড জয়ের মেডেল। শৈলেন জানান অমর একাদশের জন্য যখন তিনি সোনার মেডেল গড়িয়েছিলেন তখন একটি মেডেল বেশি গড়েছিলেন; তিনি চেয়েছিলেন ঐ মেডেল তাঁকেই দিতে যিনি অমর একাদশের লেগ্যাসিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য হবেন। গোষ্ঠ সেই সম্মান, সে ভরসা অর্জন করেছেন। তাই প্রায় কুড়ি বছর আগে বানিয়ে রাখা সেই মেডেলটি তিনি তুলে দেন গোষ্ঠ পালের হাতে।
আগমন সাদামাঠা হলেও বিদায়ই আসলে নির্মাণ করে চরিত্র। গোষ্ঠ পালের মতো কিংবদন্তি এ আপ্তবাক্যকে সত্যি করে দেখিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালের ঘটনা। ক্যালকাটা ক্লাবের সাথে মোহনবাগানের খেলা। ঘেরা মাঠের দুপাশ ভিড়ে ঠাসা।
আগমন সাদামাঠা হলেও বিদায়ই আসলে নির্মাণ করে চরিত্র। গোষ্ঠ পালের মতো কিংবদন্তি এ আপ্তবাক্যকে সত্যি করে দেখিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালের ঘটনা। ক্যালকাটা ক্লাবের সাথে মোহনবাগানের খেলা। ঘেরা মাঠের দুপাশ ভিড়ে ঠাসা। ব্রিটিশ টমটম গাড়ি আর ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে পিছন দিকে। ঘোড়পুলিশের টহল চলছে। কিন্তু খেলাচলাকালীন হঠাৎ-ই মোহনবাগান খেলোয়াড়রা সটান শুয়ে পড়লেন মাঠের মধ্যে। রেফারি অবাক। কিন্তু কেন এমন অদ্ভুত ভঙ্গি?
রেফারি ক্লেইটন ম্যাচের শুরু থেকেই ব্রিটিশ দলের পক্ষে নানা সিদ্ধান্ত দিচ্ছিলেন যা মেনে নিতে পারছিল না মোহনবাগান খেলোয়াড়েরা। এমনই একের পর এক পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন মোহন অধিনায়ক গোষ্ঠ পাল- আপোস শব্দটি ছিল না যার অভিধানে। তাঁরই কথায় এমন অভিনব প্রতিবাদ জানালেন মোহন খেলোয়াড়েরা। ফলস্বরূপ শাস্তির খাঁড়া নেমে এল তাঁর উপর। সাথে সাথে ফুটবলকেই চিরবিদায় জানিয়ে চিরকালের মতো আরও একবার ব্রিটিশ দম্ভকে টলিয়ে দিলেন তিনি। নিজের আজীবনের ডাকাবুকো স্বভাব দিয়ে এমন বিদায়গাঁথা লিখলেন দ্যা চাইনিজ ওয়াল যে তাঁর জন্মের ১২৮ বছর পরেও বাঙালির গল্পগাছা-কিসসায় আজও তিনিই প্রতিরোধ, তিনিই প্রাচীর- দ্যা গ্রেট চাইনিজ ওয়াল…
লেখক অর্পণ গুপ্তের বাড়ি হাওড়ায়। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। শখ লেখা, বই পড়া, খেলা ও সিনেমা দেখা। একাধিক প্রথম সারির বাংলা দৈনিক ও ওয়েব পোর্টালে নিয়মিত লেখালেখি করেন।