আজকের কথা যাদের নিয়ে তারা কিছু বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ – তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ সম্প্রদায়ের। না তারা তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত, বিশ্ববিদিত দরিদ্র, অবহেলিত, পরিশ্রমী, ও ক্ষুধার্ত সম্প্রদায় নয় – বরং বলা যেতে পারে তারা এক অর্থে সমৃদ্ধিশালী সম্প্রদায়।
কিন্তু তারা আক্রান্ত প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায়। বলা যায় তারা প্রকৃতির সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুরতার
শিকার। প্রকৃতি তাদের বঞ্চিত করেছে অতি প্রয়োজনীয়, মূল্যবান এক উপাদান থেকে যা অন্যদের মধ্যে সাধারণভাবে সহজেই পাওয়া যায়। এই উপাদানের নাম ‘বোধ’।
‘বোধ’ হচ্ছে মানুষের জীবনীশক্তি, চালিকাশক্তি; প্রতিদিনের নিজেকে প্রমাণিত করার
অস্ত্র, জীবনে এগিয়ে চলার অক্সিজেন। যা অতীতের, বর্তমানের, ভবিষ্যতের তুমিকে রূপ দেয়, প্রতিষ্ঠিত করে, মনুষ্যজীবনের অর্থ অনুভব করায়। এই বোধের অভাবে তৈরি হয় এক বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতা যাকে ইংরেজিতে বলা হয় অটিজম আর বাংলায় স্বমগ্নতা।
অটিজম এক বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতা, যা বর্ণিত হয়েছে একটি রূপকের মাধ্যমে এই ভাবে – ‘কাচের ঘরের ভিতর এক সুন্দর শিশু স্বকেন্দ্রিক অবস্থায়’। এই কাচের দেওয়াল হচ্ছে বাধা আর দেওয়াতের ওপারে সমাজ অথবা বহির্বিশ্ব। অর্থাৎ এই শিশুকে দেখতে পায় কিন্তু স্পর্শ করতে পারে না। আবার শিশুও ‘স্বকেন্দ্রিক’ অর্থাৎ নিজের মধ্যে মগ্ন থাকে, বাইরের জগত ও সমাজকে সে দেখতে চায় না এবং পায় না। অপটু হাতে এই কাচের দেওয়াল ভাঙতে গেলে শিশু আহত হতে পারে। তাই কাচের দেওয়াল ভেঙে এই স্বমগ্নতা থেকে তাকে সামাজিক মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাই বিশেষজ্ঞের চ্যালেঞ্জ।

এই প্রতিবন্ধকতার কিছু বৈশিষ্ট্য হল –
দুই/আড়াই বছর বয়স থেকেই এর লক্ষণগুলি দেখা/বোঝা যায়। শারীরিক ভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সক্ষম/স্বাভাবিক থাকে কিন্তু সেগুলিকে চালনা করার জন্য বোধ অপ্রতুল। তাই অন্যের কথা কান দিয়ে শুনতে পেলেও মস্তিষ্কের শ্রবণস্থান সেটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। ফলস্বরূপ শিশু অন্যের কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারে মাত্র, উত্তর দিতে পারে না। নিজের প্রয়োজন বোঝায় কিছু বিশেষ শব্দ বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যা অন্যের বোধগম্য নাও হতে পারে।
সামাজিক বোধ কম থাকার ফলে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা, মেলামেশা করতে পারে না/চায় না, তাই এইসব শিশু অনেকের মাঝে থেকেও একা। চোখে চোখে রাখতে না পারাও এর একটি প্রধান লক্ষণ।
নমনীয়তার অর্থাৎ অ্যাডাপ্টেবিলিটির অভাব অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে – পরিবর্তন নিতে না পারার কিংবা পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার অক্ষমতা। এই ‘নমনীয়তার অভাব’ শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নতুনের সঙ্গে নিজেকে/ নিজের চাহিদাগুলিকে মানিয়ে নিতে পারে না বলেই খেলাধুলা ও আবেগের প্রকাশভভঙ্গীও সাধারণের থেকে একটু আলাদা হয়।
এই প্রতিবন্ধকতায় বুদ্ধিমত্তা সাধারণ বা সাধারণের থেকে বেশিও হতে পারে। কিন্তু সঠিক ভাবে ও সঠিক স্থানে প্রয়োগ করতে পারে না বলেই বুদ্ধির বিকাশও সাধারণ বিকাশমাত্রার মাপকাঠিতে করা যায় না।
শিশুকালে এই সূক্ষ্ম লক্ষণগুলি সব সময়ে বোঝা যায় না বলেই এই প্রতিবন্ধকতার চিকিৎসা এবং সঠিক পরিচালন শুরু করতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায় যার ফলে লক্ষণগুলির মাত্রাও বেড়ে যায়।
অটিজম – এই প্রতিবন্ধকতাটি সারাবিশ্বে বিজ্ঞানসম্মত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অন্য প্রতিবন্ধকতার তুলনায় অনেক পরে এবং বলা বাহুল্য পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতবর্ষে আরও অনেক দেরীতে। বর্তমানে সরকারী ভাবে স্বীকৃতি পেলেও সঠিক পরিচালনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পরিকাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

এই পটভূমিতে ২০০০সালে শুরু হয়েছিল প্রদীপ সেন্টার ফর অটিজম ম্যানেজমেন্ট। পশ্চিমবঙ্গে – বলা যেতে পারে পূর্ব ভারতে প্রথম প্রচেষ্টা অটিজম প্রতিবন্ধকতায়ুক্ত শিশু, কিশোরদের বিশেষ পরিকাঠামোতে বিশেষ পরিচালন পদ্ধতি অবলম্বন করে একটি বিশেষ বিদ্যালয়ের। ২০০০সালে ছোট দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে অটিজম প্রতিবন্ধকতায়ুক্ত সন্তানের দুই মায়ের এই যুদ্ধের শুরু।
এদের পরিবারেও নতুন সদস্যের আগমনের আনন্দ ছিল। শিশুর প্রতিটি নড়াচড়া, ছোটখাটো আচরণ, ক্রমবিকাশ, অগ্রগতি, উত্তরণ নিয়ে গর্বিত বাবা মায়ের উচ্ছাসও ছিল। ভবিষ্যতের নানা পরিকল্পনাও ব্যস্ত রেখেছিল তাদের। কিন্তু ক্রমে সময়ের পথ মসৃণ থেকে বন্ধুর হল। হ্যাঁ – শিশু হাসে, ছোটাছুটি করে, আধোবুলিতে কিছু কথাও বলে,
কিন্তু ডাকলে কেন সাড়া দেয় না? ওর খেলার বিষয়বস্তুও যেন আলাদা। তারপর শুরু হয় আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীর অন্য শিশুদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা। আসতে থাকে নানান উপদেশ – যার প্রধান উপজীব্যই ছিল মাতৃত্বের – গর্ভাবস্থায় বা জন্মের পরে, কোন
কোন ভুলের ফলেই শিশুর এই বিসদৃশ ক্রমবিকাশ। অবশেষে সময়ের সঙ্গে, তিক্ততার শেষ সীমায় পৌঁছে গ্রহণ করতে হল সেই নিষ্ঠুর সত্যকে – শিশু এক
বিশেষ ধরণের প্রতিবন্ধকতা শিকার যার পোষাকি নাম নিউরোডেভালপমেন্টাল ডিসঅর্ডার।
তারপর শুরু হল কঠিন বাস্তবের সঙ্গে যুদ্ধ। আর তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের উপেক্ষা, অপমান আর অন্তহীন উপদেশে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পরীক্ষা। ঠিক কী কী কারণে এইরকম হয়, কী কী করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অমুক মন্দিরের ঠাকুর জাগ্রত, তমুক বাবাজী/মাতাজি সব ভবিষ্যৎ বলে দেয়, বড় করে যজ্ঞ কর –
এমন নানা উপদেশ/দোষারোপ বর্ষণ চলতে থাকে এই উচ্চশিক্ষিত দুই মায়ের উপর।
তবে কোনও আঘাতই নির্মূল করতে পারে নি তাদের বিজ্ঞান চেতনাকে। বরং আরও দৃঢ় করেছে তাদের সংকল্পকে – সংকল্প কিছু বিজ্ঞানসম্মত সৃষ্টির – যা এই প্রতিবন্ধকতাকে আ্লোর পথ দেখাবে। এদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির চুম্বক টেনে আনল আরও অনেক অভিভাবককে যারা একই সমস্যায় জর্জরিত। প্রমাণিত হল যে শুভ ইছাশক্তি দৃঢ় হলে অপমান বা বাধা কোনও কিছুই পথ আটকে দাঁড়াতে পারে না। খুব বড় ঝুঁকি নিয়ে, প্রায় জীবনকে বাজী রেখে শহরের এক উন্নত এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনা হল। তারপর দেখা মিলল সমাজের আর এক দিকের। সমানুভুতি সম্পন্ন বহু মানুষ নিঃস্বার্থে সাহায্যের দুহাত বাড়িয়ে দিলেন কোনও প্রতিদানের আশা ছাড়াই।
মাত্র চারজন ছাত্র-ছাত্রী, দুইজন বিশেষ শিক্ষিকা, দুইজন মনোবিজ্ঞান–এর গবেষনারত
ছাত্রী আর একজন অফিস স্টাফ নিয়ে শুরু হল প্রদীপের পথ চলা। শুধুমাত্র
অটিজম-চিহ্নিত ছেলেমেয়েদের জন্য। এক বছরের মধ্যে ছাত্রছাত্রী এবং বিশেষ
শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা লক্ষনীয় ভাবে বাড়ল। এদিকে স্থান অকুলান। তাই একটু বড়
জায়গায় যেতে হল প্রদীপকে।
প্রথম বড় স্বীকৃতি এল ২০১৩ সালে। পশ্চিমবঙ্গে অটিজম নিয়ে বিশেষ কর্মযজ্ঞের জন্য প্রদীপ পেল সরকারী পুরষ্কার। এভাবে চলতে চলতেই একদিন সরকারী সাহায্যে ১০কাঠা জমি পাওয়া গেল স্বল্পমূল্যে। আবার নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। জমি দখলকারীর রক্তচক্ষু, ঠিকাদারের হুমকি সবকিছুকে সঙ্গে নিয়েই শুরু হল প্রদীপের নিজের বাড়ি। সেই
কাজেও অভাবনীয় সাহায্য পাওয়া গেল সরকারী এবং বেসরকারী স্বেছাসেবী সংস্থাদের থেকে। অবশেষে ২০১৫-তে প্রদীপ উঠে এল তার নিজের বাড়িতে। দশ কাঠা জমিতে পাঁচতলা বাড়ি।
প্রদীপ এখন অনেক বড় হয়েছে। নিয়মিত বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এখন ২০০।
শিক্ষক, অশিক্ষক, অফিস ইত্যাদি মিলিয়ে কর্মী সংখ্যা ৮০। সমাজের নানা স্তরে অটিজম নিয়ে যেমন সচেতনতার অভাব আছে, তেমনই অভাব আছে এই বাচ্চাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরও। সেই ঘাটতি খানিকটা পূরণ করতেই বর্তমানে প্রদীপে ‘মানব- সম্পদ’ বিভাগে দুটো ট্রেনিং কোর্স চলে (বি এড মেন্টাল রিটারডেশন এবং ডি এড অটিজম) যাতে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিশেষ শিক্ষক-শিক্ষিকা তৈরি
করতে পারি।
শিক্ষাপ্রদান ছাড়াও, অটিজম আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্য যা বিশেষভাবে জরুরি তা হল নানারকমের থেরাপি। পাঁচটা বিশেষ থেরাপি ইউনিট যথা – সেন্সরি থেরাপি, স্পিচ থেরাপি,
মিউজিক থেরাপি, ড্যান্স থেরাপি, ফিজিও থেরাপি-এর মাধ্যমে বাচ্চাদের থেরাপি
করা হয়। ভোকেশনাল ক্লাসে তাদের ভবিষ্যতের জন্য রোজগারের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া
হয়। এছাড়া আছে ইন্টিগ্রেশন ক্লাস যেখানে ক্ষমতা অনুয়ায়ী ক্লাস ওয়ান থেকে এইট
অবধি সাধারণ স্কুলের সিলেবাস পড়ান হয় এবং মাল্টি-মিডিয়া ইউনিট – যেখানে ক্ষমতা
অনুযায়ী উন্নতমানের রোজগারের জন্য তাদের প্রস্তুত করা হয়।
প্রদীপ এখন স্বাবলম্বী। সেই দুই মায়ের স্বপ্ন খানিকটা সফল হলেও, এখনও অনেক পথ চলা বাকি। এর পরের লক্ষ্য একটা আদর্শ হোম তৈরি করার। ‘আমরা চলে গেলে আমাদের সন্তানের কী হবে’ এই চিন্তা অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অভিভাকদের প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায়। সেই দুশ্চিন্তা থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারলে তবেই প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে এই লড়াই সফল হবে।
মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ও প্রদীপ সেন্টার ফর অটিজম ম্যানেজমেন্টের মূল কর্ণধারদের একজন। প্রদীপ-এর দায়িত্ব সামলে যতটা সময় পান তা অটিজম বিষয়ের ওপর পড়াশোনা ও লেখালেখি করেই কাটে।