শুনেছিলাম, বসন্তকালে যে দেবীর পুজো হয়, আদিকাল থেকে মায়ের বোধনের সেটিই প্রকৃত সময়। শীতের জীর্ণতা, মলিনতাকে কাটিয়ে প্রকৃতি যখন নব নব আভরণে সাজায় নিজের চিত্রপট, তখনই সেই অনিন্দ্যসুন্দর লাস্যময়ীর আরাধনা সম্ভবপর মননের নিভৃতে, তাই না? কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীন এসব নিয়ে বিশেষ একটা ভাবা বা শোনা হতো না। সেখানে বাসন্তীপুজোর ষষ্ঠী আসা টের পেতাম, মা যখন আমার মঙ্গলকামনা করে অশোকষষ্ঠীর পুজোর নিয়মানুযায়ী গদ গিলতেন সকাল সকাল।
[the_ad id=”266918″]
পুজোর আনন্দ আকাশ-বাতাস ভরে কাশফুলের দোলায় দুলে, শিউলির গন্ধ মেখে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে চারদিক মাতিয়ে এসে পৌঁছত সেই শরতেরই প্রাক্কালে; মায়ের অকালবোধনে। আমি যদিও এতসব বুঝতাম না। আর পাঁচজন বাঙালির মতো শুধু নতুন জামা পরে টানা চারদিন ধরে উৎসবের আমেজ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াতাম প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেলে। আসলে আমাদের কাছে তো শুধু সেই পুজো অসুরবিনাশিনী জগজ্জননীর আরাধনাই নয়,দুর্গাপুজো মানে আমাদের কাছে ঘরের মেয়ে উমার তাঁর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘরে আসার চিরন্তন গল্প লেখার অভিব্যক্তি মাখা এক অনাবিল সুন্দর উৎসব।

তবু, আজ কেন প্রথমে বাসন্তীপুজোর প্রসঙ্গ টেনে শুরু করলাম জানেন আমার লেখা? কারণ, ভারতবর্ষে যে সময়ে শরতের আমেজ গায়ে মেখে শুরু হয় শারদীয়ার প্রস্তুতি, দক্ষিণ গোলার্ধের এই মহাদ্বীপ অস্ট্রেলিয়ায় তখন টানা কয়েক মাসের শীতের রুক্ষতাকে পিছনে ফেলে ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ে বসন্ত। তাই লিখতে বসেই হঠাৎ মনে হল, সত্যি তো, হিসেব মতো তাহলে দেবী তো এখানে চিরকালীন বসন্তের সেই অনির্বচনীয় শোভাকেই উদযাপন করছেন তাঁর বাসন্তী রূপে, নয় কী? থাক বরং এখন সেসব কথা। যে রূপেই আসুন না কেন তিনি, আমাদের দুর্গার গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু একটাই পরিচয়, তিনি মা; সকলের। তাই তাঁর আগমনকে উদযাপন করতে বাদবাকি গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়ে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের মতোই প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে নিঃশ্বাস নেওয়া সিডনি শহরেও চলে বছরভরের প্রস্তুতি।
[the_ad id=”266919″]
প্রায় প্রতিদিনই কাজের সূত্রে ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশ থেকে বহু বাঙালি অভিপ্রায়ন করে হাজির হন সুদূর এই মহাদেশে।বিশেষ করে সিডনি ও মেলবোর্নে কাজের পরিধি বেশি থাকায় বিভিন্ন রঙ বর্ণ ধর্মের মানুষ সব বিভেদ ভুলে এই শহরকেন্দ্রিক লোকালয়ে বাস করেন পাশাপাশিই। প্রবাসে তাই একটা সুবিধা আজও রয়েছে। এখানে আমার বাংলা আজও অভিন্ন। রাস্তাঘাটে বাংলা শুনলেই হাসিমুখে শুধু এগিয়ে যাই সব ভুলে জিগ্যেস করতে, “আপনি বাঙালি?” ব্যাস। বাদবাকি সব পরিচয় এরপর হয়ে পড়ে ভিত্তিহীন। আর এভাবেই যত বাঙালি বাড়তে থাকে, ততই বছর বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে দুর্গাপুজোর সংখ্যারও। গত বছর মনে আছে, গোটা চোদ্দো পুজোর আয়োজন হয়েছিল শুধুমাত্র এই সিডনির বুকেই। বুঝতে পারছেন তো তাহলে, এপাড়া ওপাড়ায় এখানে কত বাঙালি?

অন্যান্য প্রবাসের অনুষ্ঠানের মতো এখানেও ছুটির অভাবে বেশিরভাগ পুজোরই আয়োজন করা হয় সপ্তাহান্তে। ভাড়া নেওয়া হয় কোনও স্কুল বিল্ডিং বা কমিউনিটি হল। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। যেমন গ্লেনফিল্ডের ‘আগমনী’ বা ক্যাম্বেলটাউনের ‘শঙ্খনাদ’ পুজো আয়োজিত হয় পঞ্জিকা দেখেই দিনক্ষণ মেনে। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুজো। যেমন এপার বাংলা গোষ্ঠীর বেঙ্গলি এসোসিয়েশন অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের আয়োজনে কনকর্ডের পুজো। সাধারণত কোনও এক শুক্রবার দেখে শুরু হয়ে যায় উৎসব – সন্ধ্যায় যেখানে উৎসাহী সদস্যেরা নানাধরনের বাঙালি খাবারদাবার বানিয়ে নিয়ে গিয়ে স্টল দেন ‘আনন্দমেলা’য়, পুজো শুরুর প্রাক্কালে। সব আয়োজনের মাঝে বাঙালিরা যে কিছুতেই ভুলতে পারে না তাদের রসনা তৃপ্তির কথাও, তাই না?
[the_ad id=”270084″]
এরপর টানা দুদিন ধরে চলতে থাকে পুজো। সঙ্গে অঞ্জলি, ধুনুচি নাচ, কলকাতা থেকে নিয়ে আসা ঢাকির উত্তাল বোল, দু’বেলা ভোগ এবং পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন, সাংস্কৃতিক বিচিত্রানুষ্ঠান, শেষবেলায় সিঁদুরখেলা, ভাসান নাচ, মেলায় রকমারি ভারতীয় পোশাকআশাক থেকে গয়নার স্টল, আরও কত কী! মেলায় যদিও আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ অবশ্যই,’আনন্দধারা’ র স্টল থেকে পূজাবার্ষিকী সংগ্রহ করা। পুজোর গন্ধ যে ওই শারদীয়া সংখ্যার হাত ধরেই সবার আগে প্রতিবছর ছোটবেলায় আসত আমার ঘরে! আর, ওই যে পেট পুজোর কথা বললাম আগে, ভোজন-রসিক হিসেবে এই মেলার আরেকটি প্রধান লোভনীয় জায়গা। কলকাতার একেবারে নিজস্ব স্বাদের অনবদ্য সব মিষ্টিরও কিন্তু হদিশ মেলে শুধুমাত্র এই কনকর্ডের পুজোর মেলাতেই।

এবার চলে আসি অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুজোর কথায়। বেশিরভাগই এদের মধ্যে হয় শনিবার বা রবিবার দেখে আয়োজন করে থাকে অনুষ্ঠানের। যেমন, স্ট্র্যাথফিল্ডের ‘উৎসব’; কাম্বার্ল্যাণ্ডের ‘উত্তরণ’; নর্থমিডের ‘ভক্তমন্দির’; পেনরিথের ‘স্বাগতম’, সিডনি কালীবাড়ির ‘নবরূপ। সব পুজোর কর্মকর্তাদের মধ্যে আবার এতটাই নিপুণ বোঝাপড়া, যে সবাই যাতে সব পুজোয় অংশ নিতে পারে, তাই দু’তিন সপ্তাহান্ত মিলিয়ে আয়োজন করে থাকে সব পুজোর – দেশের মতো চারদিনেই যে পুজোর আমেজ কিছুতেই তাই ফুরোতে চায় না। বাংলাদেশের আদি বাসিন্দাদের আয়োজনে আরও বেশ কয়েকটি পুজো খুব ধুমধাম করে হয়ে থাকে এছাড়াও। কোগারাহ-এর ‘বাংলাদেশ পূজা এসোসিয়েশন’-এর পুজো বিশেষ করে দাগ কাটে মনে তার রকমারি ভোগের আয়োজন আর আন্তরিকতায়। গ্র্যানভিলের ‘অস্ট্রেলিয়ান বেঙ্গলি হিন্দু এসোসিয়েশন’ বা ওয়েন্টওয়ার্থভিলের ‘বাংলাদেশ সোসাইটি অফ পূজা অ্যাণ্ড কালচার’ আবার তাদের সান্ধ্য অনুষ্ঠানের জন্য বোধহয় বেশি বিখ্যাত। অষ্টমীর অঞ্জলি ও সন্ধিপুজো দেখতে হলে অবশ্য সিডনি বেদান্ত সেন্টারেই যাওয়া ভালো। ভীষণ নিষ্ঠা সহকারে সেখানের আশ্রমের মহারাজেরা পূজার্চনা করে থাকেন মায়ের।

সবচেয়ে যেই ব্যাপারটা ভালো লাগে এখানকার পুজোগুলোর, তা হল, সমস্ত দর্শনার্থীদের জন্যই অবারিত দ্বার ও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। সদস্য-ভিত্তিক আলাদা কোনও বিভেদ এখানে চোখে পড়ে না। উৎসবের দিনগুলি সবাই একসঙ্গে ভোগের লাইনে দাঁড়িয়ে বলে উঠবে “বলো দুর্গা মাইকি জয়!” – একতায় বিলীন হতে থাকা ‘আমি’দের কাছে সত্যিই এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিসেই বা সম্ভব! পুজো তো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে আবদ্ধ সংস্কৃতি নয়, তা তো আসলে সকল মানুষকে সব ভুলে একত্রিত করার আয়োজন মাত্র। তাই তো সে ‘সার্বজনীন’ । সেই হিসেবে দেখতে গেলে সিডনির পুজোর মূল আবেগ শতকরা একশো ভাগ নিখাদ সত্যি।
[the_ad id=”270085″]
এবছর যদিও কোভিডের জন্য সব পুজোই বন্ধ এই মলিন প্রেক্ষাপটে। মা দুর্গা তবু আসছেন এবারও সকল বাঙালির মননে। পেনরিথের যেই ‘স্বাগতম’ পুজোর কথা আগেই বলেছিলাম, তারা অষ্টমীর দিন আয়োজন করেছে ভার্চুয়াল অঞ্জলি ও পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা। এমনকি বিভিন্ন শিল্পীরাও চেষ্টা করছেন ভার্চুয়াল পর্দার হাত ধরেই বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে পুজোর আমেজটাকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে। যাতে, তার উপর ভর দিয়েই বাঙালি আবার জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠতে পারে হাজারও লাখো আলোলিকার মাঝে; “আসছে বছর আবার হবে!”
হবেই। ঠিক হবে!
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির মধ্যে জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পারিজাত। ইতিমধ্যেই তাঁর বহু লেখা নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং সমাদৃত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন, উপন্যাস, কবিতা মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। গত চার বছর বিবাহসূত্রে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের বাসিন্দা।