পরকীয়া প্রেম, সমকাম, স্ট্যান্ড-আপ কমেডি, ইত্যাদি নানাবিধ ধাষ্টামো যে এদেশে আমেরিকার কুপ্রভাবের ফলাফল, তা সবাই জানে এবং মানে। সত্যি বলতে কি, সবাই যা জানে, সেগুলো সাধারণত যেমন ভিত্তিহীন হয়, স্ট্যান্ড আপ কমেডির ব্যাপারে সেই তুলনায় কথাটা হয়তো পুরোপুরি ভুলও নয়। কিন্তু এই ধাষ্টামোর ব্যাপারে পথিকৃৎ আমেরিকা – এইটে বললে অন্যায় হবে।
অবিশ্যি, এই আলোচনার মূল বিষয়, মানে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির যে আধুনিক রূপ, তার উৎপত্তিস্থল মার্কিন মুলুকই বটে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে এর আবির্ভাব। তবে এর পূর্বসূরি খুঁজতে গেলে যেতে হবে আরও বেশ খানিকটা পিছনে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের মিউজ়িক হলে গানবাজনা ছাড়াও মনোরঞ্জনের যে বিবিধ অনুষ্ঠান হত, সেখানে এ ধরনের উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যায়, যদিও তা ছিল মূল অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গমাত্র।
[the_ad id=”266918″]
তবে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির যা সম্ভবত প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ, তার উদ্ভব ভারতে। কেরলে সতেরো শতকে প্রচলিত ছিল এক ধরনের লোকনৃত্য ‘চক্যর কুথু’। এখানে একক শিল্পীরা নাচের মাধ্যমে দর্শকদের শোনাতেন পৌরাণিক কাহিনি। নামে নাচ হলেও শিল্পীরা মঞ্চে হাঁটাচলা করতেন ন্যূনতম। আসল ছিল নটের অভিব্যক্তি, এবং কোরিওগ্রাফি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। শিল্পীর সঙ্গে দর্শকদের যোগাযোগ ছিল সোজাসুজি।

যাই হোক, এসব পুরোনো কাসুন্দি থাক। আমরা ফিরে আসি আধুনিক স্ট্যান্ড-আপ কমেডির প্রসঙ্গে। বিশ শতকের একদম প্রথমদিকে, ইংল্যান্ডের মিউজ়িক হলের এক আমেরিকান রূপ জন্ম নেয় নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার ও বেতারকেন্দ্রকে ঘিরে। শুধু গানবাজনা নয়, জাগলার, ম্যাজিশিয়ান, অ্যাক্রোব্যাট ইত্যাদি বিভিন্ন মঞ্চশিল্প পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায় — আমেরিকান পপ কালচারে যার নাম ভডেভিল। এখানেই শুরু স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জনপ্রিয়তার। তবে একেবারে গোড়ায় কমেডিয়ানরা পারফর্ম করতেন তিন-চারজন মিলে, নিজেদের মধ্যে। দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি কথা হত না। ব্যতিক্রম ছিলেন ফ্র্যাঙ্ক ফে-র মতো মুষ্টিমেয় কোনও কোনও কমেডিয়ান। তবে এই একক উপস্থাপনা অন্য ধরনগুলির থেকে বেশি জনপ্রিয় করে তোলেন ফে-র পদানুসারী বব হোপ। এতদিন শিল্পীরা যে চুটকিগুলি সাধারণত বলতেন, সেগুলি ছিল কোনও স্থানীয় প্রভাবমুক্ত, যাতে তা যে কোনও শ্রোতৃবর্গের সামনেই বলা চলে। মুশকিল হল, এই জাতীয় রসিকতার সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই খুবই সীমিত। তাই তাঁর সাপ্তাহিক রেডিও অনুষ্ঠানের উপাদান যোগাড় করতে হোপ নিয়োগ করেন এক দল পেশাদার লেখক। এঁদের কাজ ছিল শ্রোতা অনুযায়ী স্থানীয় খবরের কাগজ, বিজ্ঞাপন, রেডিও, ইত্যাদি থেকে মালমশলা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে লেখা সেদিনের চিত্রনাট্য। এর ফলে শ্রোতারা সেগুলির সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করতে শুরু করেন অনেক বেশি এবং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই নতুন শৈলী।

স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে এর পরের মাইলফলক ষাটের দশকে। উঠে আসেন এক ঝাঁক নতুন কমেডিয়ান– যাদের মধ্যে ছিলেন এখনকার স্বনামধন্য পরিচালক উডি অ্যালেন, যাঁরা তাঁদের কমেডির মাধ্যমে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেন বহু প্রচলিত ধ্যানধারণাকে। এঁদের পুরোধা ছিলেন লেনি ব্রুস। তিনি তাঁর অনুষ্ঠানে প্রায় সরাসরি আক্রমণ করতে থাকেন ধর্মীয় গোঁড়ামি, যৌনতা নিয়ে ভিক্টোরীয় মনোভাব, ইত্যাদি তৎকালীন আমেরিকার সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে। দুঃখের বিষয়, অকালমৃত্যুর কারণে ব্রুসের জয়যাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে ১৯৬৬ সালে, তাঁর মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই উঠে আসেন দুই নতুন কমেডিয়ান – ব্রুসের ছাত্র, জর্জ কার্লিন নামে এক শ্বেতাঙ্গ এবং রিচার্ড প্রায়র নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক।

এখনকার দিকপাল কমেডিয়ানরা প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে, স্ট্যান্ড-আপ কমেডির স্বর্ণযুগ, এমনকী প্রায় রেনেসাঁ বলা চলে ১৯৬০-১৯৯০ এই সময়কালকে। এ সময়ে উত্থান ঘটে বহু দিকপাল কমেডিয়ানের, যেমন বব নিউহার্ট, বিল কসবি, জোন রিভারস ও আরও অনেকে। এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে কালজয়ী হয়ে আছেন কমেডির ইতিহাসে। তবে এই রেনেসাঁ-র দা ভিঞ্চি ও মিকেলেঞ্জেলো বলা চলে প্রায়র ও কার্লিনকে। কার্লিনের বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার, সংলাপ-নির্ভর শৈলী স্ট্যান্ড-আপ কমেডিকে চটুল ভাঁড়ামি থেকে উত্তরণের পথ দেখায়। তাকে করে তোলে জীবন দর্শনের এক অপরিহার্য মাধ্যম। উলটো দিকে, প্রায়রের পাগলাটে, প্রায় ক্রুদ্ধ শৈলী হাত ধরে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি হয়ে ওঠে ধর্মীয় গোঁড়ামি বা বর্ণবৈষম্যের মতো স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিষয়ের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদের অস্ত্র।
[the_ad id=”266919″]
এই সময়ে আমেরিকান সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আর একটি ঘটনা ঘটে, স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ইতিহাসে যার প্রভাব বেশ সুদূরপ্রসারী। ১৯৬২ সালে নিউ ইয়র্কে বিখ্যাত টিভি চ্যানেল এনবিসি-র প্রযোজনায় শুরু হয় একটি টক শো, যার নাম ‘দ্য টুনাইট শো — উইথ জনি কার্সন’। এখানে বিনোদন জগতের অন্যান্য বিখ্যাত তারকাদের সঙ্গে কার্সন ডাকতেন স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানদের এবং আড্ডা হত হালকা রসিকতার মেজাজে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই শো যে শুধু আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা লাভ করে তাই নয়, এখানে নিয়মিত নিমন্ত্রিত হওয়টা বিনোদন জগতে কৌলীন্যের একরকম মাপকাঠি হয়ে ওঠে। সেই ঐতিহ্য এই শোয়ের বিভিন্ন উত্তরসূরি, যেমন লেটারম্যান, জে লেনো, কোনান ইত্যাদির হাত ধরে আজও বজায় আছে।

যাই হোক, কার্সন সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন হলিউডের তারকারা। তাই ১৯৭২ সালে এই শো পাকাপাকি পাড়ি জমায় ক্যালিফোর্নিয়ায়, প্রথমে বারব্যাঙ্ক ও তারপরে লস এঞ্জেলেসে। ফলত, তার পিছু পিছু কমেডিয়ানদের একটা বড় অংশও পাড়ি জমান সেদিকে, এখানে নিমন্ত্রিত হওয়ার তাগিদে। এর ফলে দুটো জিনিস হয়। স্ট্যান্ড-আপ কমেডির মূল ঘাঁটি নিউ ইয়র্ক থেকে চলে আসে লস এঞ্জেলেসে, এবং চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে গড়ে ওঠে একটা নিবিড় সম্পর্ক। দ্বিতীয়, এই পটভূমিতেই আবির্ভাব ঘটে এই রেনেসাঁর তৃতীয় নক্ষত্র, স্টিভ মার্টিনের। এঁকে আমরা অন্য়ভাবেও চিনি ‘পিঙ্ক প্যান্থার’ সিনেমাগুলির নায়ক হিসাবে। তবে কমেডির ইতিহাসে ইনি ছিলেন আশি-নব্বইয়ের দশকের এক যুগসন্ধিক্ষণের নায়ক। তাঁর স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে চ্যাপলিনীয় ফিজিক্যাল কমেডির মিশেল জন্ম দেয় এক নতুন ঘরানার। মূলতঃ, এই রেনেসাঁজাত ঘরানাগুলোই বয়ে নিয়ে চলেছেন এখনকার কমেডিয়ানরা। এর পরেও অবশ্য পাশ্চাত্যে এসেছেন ডাকসাইটে কমেডিয়ানরা, যেমন জেরি সেনফিল্ড, জে লেনো, ডেভিড লেটারম্যান, এডি মার্ফি, এলেন ডিজেনারেস এবং আরও অনেকে, যাঁদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
[the_ad id=”270084″]
তবে পাশ্চাত্যকে ছেড়ে এই সময়ে গ্লোবটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে আমরা একটু চোখ ফেরাই ঘরের দিকে। হলিউডের মতোই ভারতীয় সিনেমায় মেহমুদ, টুনটুন প্রমুখ অসম্ভব শক্তিশালী কমেডিয়ান বহুদিন ধরে জনপ্রিয় হলেও, ভারতে সে অর্থে বেশ বড় পর্যায়ে মঞ্চস্থ স্ট্যান্ড-আপ কমেডির প্রথম নিদর্শন আমরা পাই ১৯৮২ সালে। বিখ্যাত কমেডিয়ান জনি লিভার করেন তাঁর প্রথম স্টেজ শো এবং অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠেন প্রবল জনপ্রিয়। তবে তার জন্য এটা ভাবা ভুল হবে যে তার আগে এদেশে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির অস্তিত্ব ছিল না। আশির দশকে মরাঠি লেখক ও হিউম্যারিস্ট পুলা দেশপান্ডের কিছু শো যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মতে অমন কমেডিয়ান এদেশে কমই জন্মেছেন। আবার, প্রোফেসর চিত্তরঞ্জন গোস্বামীর যে উল্লেখ পাই সত্যজিৎ রায়ের ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ, তা বেশ চমকপ্রদ। তিনি লিখছেন, “…সেই সময়ে কলকাতার সবচেয়ে নামকরা কমিক অভিনেতা ছিলেন গোস্বামী মশাই। এই জিনিসটা আজকাল ক্রমে উঠে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক ধরে একজন লোক নানা রংতামাশা করে দর্শক জমিয়ে রাখবে, এমন ক্ষমতা আজ কারো নেই।” (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।
2 Responses
Interesting. Waiting for the next.
বৎসরের শেষ দিনে “নির্ভেজাল বাংলামি” পড়া শুরু। তাও সময়ের সাথে যুক্ত। তাই এখনই কোন কমেন্ট নয়। নতুন বৎসর যেন নতুন করে পাওয়া যায়। সকলকে ধন্যবাদ।