ভীষ্মের প্রকৃত নাম দেবব্রত। তিনি অষ্টবসুর অন্যতম ‘দ্যু’ নামক বসু। বশিষ্ঠের গাভী চুরি করার অপরাধে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গর্ভধারিণী গঙ্গা, পিতা কুরুবংশীয় রাজা শান্তনু। শৈশব থেকে দেবব্রতর শিক্ষা-দীক্ষার তদারকি করেন গঙ্গা। গঙ্গা স্বামীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। দেবব্রত শাস্ত্রের পাঠ নেন বশিষ্ঠের কাছ থেকে, রাজনীতি শেখেন দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে, অস্ত্রশিক্ষা নেন পরশুরামের নিকট। যথাসময়ে পিতার কাছে পুত্রকে সমর্পণ করেন গঙ্গা। দেবব্রতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন রাজা শান্তনু।
প্রৌঢ় বয়সে রাজা শান্তনু দাশরাজের কন্যা মৎস্যগন্ধার প্রেমে পড়েন। তাঁকে বিবাহ করার বাসনা প্রকাশ করলে দাশরাজ বলেন, তাঁর কন্যার পুত্র রাজা হতে পারলে তবেই তিনি এই বিয়েতে সম্মত হবেন। শান্তনু যুবরাজ দেবব্রতর কথা ভেবে পিছিয়ে যান। দেবব্রত সে কথা জানতে পারলে দাশরাজকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন না, মৎস্যগন্ধার পুত্র রাজা হবে। দাশরাজ তখন জানান, ভবিষ্যতে দেবব্রতর পুত্র সিংহাসনের দাবি করতে পারে। তখন দেবব্রত আজীবন ব্রহ্মচর্যের শপথ নেন। এই সব ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁর নাম হয় ‘ভীষ্ম’। তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর লাভ করেন। শান্তনুর সঙ্গে মৎস্যগন্ধার বিবাহ সম্পন্ন হয়।
কিছু কাল পরে ভীষ্মের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনার সিংহাসনে বসানো হয়। অল্প দিন পর তিনি এক গন্ধর্বের হাতে নিহত হলে অপর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যকে রাজা করলেন ভীষ্ম। বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে বলপূর্বক নিয়ে আসেন ভীষ্ম। তিন কন্যার মধ্যে বড় অম্বা ছিল বাগদত্তা। তাঁকে তাঁর অভীষ্ট সাধনে ব্রতী হতে বললেন ভীষ্ম। শাল্বরাজ সেই কন্যাকে গ্রহণ করেন না। এই কন্যাই পরজন্মে শিখণ্ডী রূপে জন্মলাভ করে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হন। কাশীরাজের অপর দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হয়। অমিতাচারের ফলে বিচিত্রবীর্য মারা যান। দুই স্ত্রী তখন নিঃসন্তান। নিয়োগপ্রথায় তাঁদের সন্তান উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়। ব্যাসের ঔরসে বিধবাদের গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু জন্ম লাভ করেন। বিচিত্রবীর্যের এক দাসীর গর্ভে ব্যাসের ঔরসে বিদুর জন্মান। ভীষ্ম তাঁদের পিতার স্নেহে বড়ো করে তোলেন। তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা, বিবাহ সব কিছুর ভার নেন ভীষ্ম। কালক্রমে পাণ্ডু হস্তিনার রাজা হন। পাণ্ডু বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা করা হয়। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তাঁর ক্ষেত্রে উৎপন্ন পঞ্চপাণ্ডব এবং জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের শতাধিক পুত্রের ভার নেন ভীষ্ম। আচার্য দ্রোণকে তাঁদের অস্ত্রগুরু পদে নিয়োগ করেন।
ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পুত্রদের মধ্যে রাজ্য নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। পাণ্ডবরা অর্ধেক রাজত্ব দাবি করলে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা তা দিতে অস্বীকার করে। শুরু হয় হিংসা। ভীষ্ম শান্তিপূর্ণ উপায়ে সেই দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করেও বিফল হন। অবশেষে ভীষ্মের কথা মেনে দুর্যোধনাদির পিতা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজত্ব দেন। যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণ ইন্দ্রপ্রস্থে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করা হলে ভীষ্মের উপর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ভীষ্ম শ্রীকৃষ্ণকে পূজ্যতম বলে অর্ঘ্য দিতে বলেন। এতে চেদিরাজ শিশুপাল আপত্তি জানান।
শকুনির পরামর্শে পাণ্ডবদের কপট পাশাখেলায় আমন্ত্রণ জানান কৌরব ভ্রাতাগণ। ভীষ্ম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পাশাখেলায় পাণ্ডবরা পরাজিত হওয়ার পর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা হয়। ভীষ্ম তখন নীরব ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম। পাণ্ডবদের বনবাসকালে দুর্যোধনাদির ঘোষযাত্রা বিষয়ে ভীষ্ম কৌরবদের তিরস্কার করেন। তবে বিরাট রাজার ষাট হাজার গরু চুরির সময় ভীষ্ম দুর্যোধনদের সাহায্য করেছেন। কোনও ভাবেই যখন পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে যুদ্ধ আটকানো গেল না তখন ভীষ্ম কৌরবদের সেনাপতি হলেন। তবে তিনি পাণ্ডবদের হত্যা করবেন না এবং তাঁদের সদুপদেশ দেবেন এমন শর্ত দিয়েছিলেন। আরও শর্ত ছল–কর্ণের সঙ্গে এক পক্ষে যুদ্ধ করবেন না, শিখণ্ডীকে হত্যা করবেন না যিনি পূর্বে স্ত্রীলোক ছিলেন। কৌরবদের সেনাপতি হয়েও তিনি প্রতিদিন পাণ্ডবদের জয় কামনা করতেন।
যুদ্ধ আরম্ভ হল। প্রচণ্ড বিক্রমে ভীষ্ম পাণ্ডবসৈন্য নিধন করছেন। মহারণের তৃতীয় দিনে ভীষ্ম এমন রূপ ধারণ করলেন যে অযুধ্যমান কৃষ্ণ অস্ত্রধারণ করে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। ভীষ্ম কৃষ্ণস্তুতি করতে লাগলেন। বহু কষ্টে অর্জুন কৃষ্ণকে নিবারণ করেন। নবম দিনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। ভীষ্মের ইচ্ছা ছিল যেমন করে হোক কৃষ্ণকে অস্ত্রধারণ করাবেন। ভক্তের বাসনা পূরণের জন্য ভগবান শপথ ভঙ্গ করেন। অষ্টম দিনে দুর্যোধন ভীষ্মকে পাণ্ডবদের সংহার করার কথা বলেন। কিন্তু প্রীতিবশত ভীষ্ম তা করবেন না এমন মনে করে দুর্যোধন কর্ণকে যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রধারী হিসাবে চাইলেন। এতে ভীষ্ম দুর্যোধনকে তিরস্কার করেন এবং নিজের পরাধীনতার বিষয় স্মরণ করে অপমানিত বোধ করেন। কিন্তু ঠিক করেন যে তিনি অর্জুনের সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবেন। নবম দিবসে তাঁর সংহারমূর্তি দেখে স্বয়ং যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ভীত হয়ে সমরাঙ্গন ত্যাগ করে বনে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। সেই রাতেই কৌরব শিবিরে গিয়ে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, আপনার বধের উপায় আমাদের বলে দিন। ভীষ্ম তখন বলেন,
অর্জ্জুনঃ সমরে শূর পুরস্কৃত্য শিখণ্ডিনম্।
মামেব বিশিখৈস্তীক্ষ্মৈরভিদ্রবতু দংশিতঃ।।
…মাং পাতয়তু বীভৎসুরেবং তে বিজয়ো ধ্রুবম।।
–অর্জুন শিখণ্ডীর আড়ালে থেকে আমাকে ধারালো বাণের দ্বারা আঘাত করবেন। শিখণ্ডী পূর্বে স্ত্রীলোক ছিলেন বলে আমি তাঁকে আঘাত করব না। এই অবসরে অর্জুন আমাকে ভূপতিত করলে তোমার জয় হবে।
দশম দিবসে ভীষ্মের চিত্রনাট্য অনুযায়ী সব সাজানো হল। শিখণ্ডী অর্জুনের রথের সামনে। পিছন থেকে অর্জুন যুদ্ধ করে ভীষ্মকে আঘাত করতে লাগলেন। ভীষ্ম দুঃশাসনকে বললেন, এগুলো শিখণ্ডীর বাণ নয়, সব অর্জুনের। ভীষ্ম রথ থেকে ভূমিতে পড়ে গেলেন। তাঁর দেহ এতটাই শরবিদ্ধ ছিল যে তা ভূমি স্পর্শ করল না। সূর্যের দক্ষিণায়নে দেহত্যাগ করবেন না বলে ইচ্ছামৃত্যুর বরপ্রাপ্ত ভীষ্ম শরশয্যায় থেকে উত্তরায়ণের অপেক্ষা করতে লাগলেন।
রাজেন্দ্র দুর্যোধন পিতামহের চিকিৎসার জন্য শল্যচিকিৎসকদের নিয়ে এলেন। কিন্তু ভীষ্ম সে সব প্রত্যাখ্যান করলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধ শেষ হোক, তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো। দুর্যোধন সে কথায় কান দিলেন না।
ভীষ্মের পতনের আট দিন পর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়। পাণ্ডবগণ জয়লাভ করেন। যুধিষ্ঠির রাজা হন। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সেই পুরুষ ভীষ্ম মারা গেলে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে, তাঁর জ্ঞানরাশি বিলুপ্ত হবে। হে যুধিষ্ঠির, আপনি ভীষ্মের কাছে গিয়ে রাজধর্ম ও মোক্ষধর্ম বিষয়ে জ্ঞানলাভ করুন। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম, মোক্ষধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে যা বলেন তা শান্তিপর্ব ও অনুশাসনপর্বে বিধৃত রয়েছে। আটান্ন দিন শরশয্যায় থেকে ভীষ্ম মৃত্যুবরণ করেন। যাওয়ার আগে বলে যান, ধর্ম যেখানে জয় সেখানে। সত্যই পরম বল। ভীষ্মের মৃত্যুদিবস হল মাঘের শুক্লাষ্টমী তিথি, তাই একে ভীষ্মাষ্টমী বলা হয়। নিত্য-তর্পণে ভীষ্মতর্পণের ব্যবস্থা রয়েছে।
ভীষ্ম পরমগতিপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে একটি বাসনার কথা বলেছিলেন। সেই ইচ্ছাটি হল, তাঁর শেষকৃত্য যেন সেই স্থানে হয় যেখানে তাঁর পূর্বে কারও শেষকৃত্য হয়নি। ভীষ্মের এই ইচ্ছানুযায়ী তাঁর শরীরটিকে পর্বতশীর্ষের এক দুর্গম জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। পাণ্ডবগণ, বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র যুযুৎসু চিতা সাজালেন। যুধিষ্ঠির ও বিদুর তাঁকে ক্ষৌমবস্ত্র পরিয়ে দিলেন। যুযুৎসু তাঁর শরীরের উপর ছত্র ধারণ করলেন। ভীম ও অর্জুন শুভ্র চামর বীজন করতে লাগলেন। নকুল-সহদেব উষ্ণীষ পরিয়ে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠির তাঁর পাদদেশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কৌরব নারীগণ আপাদমস্তক তালপত্র দিয়ে বীজন করতে লাগলেন। হোম ও সামগান হল। এবার ভীষ্মের দেহ চন্দনকাঠ, অগুরু দিয়ে আচ্ছাদিত করা হল। অগ্নিদানের সময় ভেসে এল ঐশী কন্ঠস্বর
—এক শত ভীষ্মের শেষকৃত্য এখানেই হয়েছে; তিনশো পাণ্ডব, এক হাজার দ্রোণ, অগণিত কর্ণের শেষ কাজও হয়েছে এখানেই।
শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।