বোম্বের তারদেও অঞ্চলের ফেমাস স্টুডিয়োর রেকর্ডিং রুমে চিন্তামগ্ন অবস্থায় বসে সঙ্গীতকার চিত্রগুপ্ত শ্রীবাস্তব। সময়টা, ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাস। তাঁর করা সুর প্রযোজক মশাইয়ের পছন্দ হয়নি। একটি সোলো গানের দশটি বিভিন্ন সুর করেও ভালো লাগানো যায়নি ওই ছবির পরিচালক পি এল সন্তোষী-কেও। ফিল্মটির নাম ‘অপেরা হাউস’। অবশেষে, সহকারী দিলীপ ঢোলাকিয়া’র সুপরামর্শে মালকোষ রাগে আধারিত সুরটি অনবদ্য কণ্ঠনৈপুণ্যে জীবন্ত রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর।
কাহারবা তালে বাঁধা গানটি – ‘বলমা মানে না ব্যয়রি চুপ না রহে লাগি মন কি কহে’ তৎকালীন সময়ের একটি জনপ্রিয় সংযোজন হয়ে ওঠে, যা আজও সঙ্গীত বোদ্ধাদের মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত রয়েছে সযত্নে। এই ফিল্মে, লতা-মুকেশ পরিবেশিত ডুয়েট ‘দেখো মৌসম কেয়া বাহার হ্যায় সারা আলম বেকরার হ্যয়’… চমৎকার লিখেছিলেন মজরুহ্ সুলতানপুরী। ‘অপেরা হাউস’ ছবিতে চমকপ্রদ অভিনয়ের নিদর্শন রেখেছিলেন অজিত, বি সরোজা দেবী, ললিতা পাওয়ার, কে এন সিং, বেলা বোস, মারুতি প্রমুখ শিল্পীরা।
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সুরকার চিত্রগুপ্তের ছিল গভীর হৃদ্যতা। স্বনামধন্য এই জুটি আমাদের উপহার দিয়েছেন নানা স্বাদের অনবদ্য সব গান, যা আমরা আজও ভুলতে পারিনি। ১৯৬১ সালের কে অমরনাথ প্রোডাকসন্সের ছবি ‘বড়া আদমি’-তে প্রাণকাড়া সুরের ধারা বইয়েছিলেন চিত্রগুপ্ত। লতা-মহেন্দ্র কাপুরের দুটি দ্বৈত গান জনগণের দরবারে সমাদৃত হয়েছিল। গান দুটি– ‘জরা সঁম্ভালিয়ে অদাঁয়ে আপ কি’ ও ‘হমেঁ তেরি নজর নে হ্যয় লুটা’। ওই বছরই আই এস জোহর ও কুমকুম অভিনীত ‘অপলম চপলম’ ছবিতে আমরা পেয়েছিলাম লতাকণ্ঠে পরিবেশিত এক অনুপম গজল, যার রচয়িতা প্রেম ধবন। ‘আ হা, হাম দর পে তেরে যব আ হি গ্যয়ে’ সুরকার চিত্রগুপ্তের এক অনুপম সৃষ্টি। তালাত মেহমুদের সঙ্গে ডুয়েট– ‘তেরে দরবার মেঁ তেরি সরকার মেঁ লেকে আই হুঁ পেয়ার’ উল্লিখিত ছবির কলেবর বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল।
লতা, প্রখ্যাত সুরের কান্ডারি সুধীর ফাড়কের সঙ্গে জুটি বাঁধেন সদাশিব চিত্র প্রযোজিত ‘ভাবী কি চুড়িয়াঁ’ ফিল্মে। ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন মীনাকুমারী, বলরাজ সাহানি, সীমা দেও, ওমপ্রকাশ, দুর্গা খোটে, শৈলেশকুমার ও আরও অনেকে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল কাহারবা তালে আধারিত ও ভূপালী রাগে বাঁধা ‘আ জ্যোতি কলস ছলকে’। কবি নরেন্দ্র শর্মা তাঁর অনন্যসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে এই গানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সৃষ্টিশীলতার এক চরম উৎকর্ষে। অন্তরার কথাগুলো শোনাই–
‘অম্বর কুমকুম কৌন বরসায়ে
ফুল পংখুড়িয়োঁ পর মুস্কায়ে,
বিন্দু তুহিন জল কে
বিন্দু তুহিন জল কে
পাত পাত বিরওয়া হরিয়ালা
ধরতি কা মুখ হুয়া উজালা,
সচ স্বপ্নে কল কে
সচ স্বপ্নে কল কে’
এ গান আজও মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
ষাটের দশকের গোড়ায় তরুণ কম্পোজার রাহুল দেববর্মন সুরের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নানাবিধ পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে। তাঁর প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি ‘ছোটে নবাব’-এ লতা কণ্ঠের অনুপম নিবেদন আজও মনে রেখেছেন সঙ্গীতপ্রেমীরা। ফিল্মে, লতা মঙ্গেশকর পরিবেশিত পাঁচটি মনমাতানো গান তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। গানগুলি– ‘ঘর আজা ঘির আয়ে বদরা সাওঁরিয়া’, ‘আজ হুয়া মেরা দিল মতওয়ালা’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট), ‘ও আয়ে ঘর মেঁ হমারে খুদা কি কুদরত হ্যায়’, ‘জিনেওয়ালে মুস্কুরা কে জি’ (মহম্মদ রফি ও মেহমুদের সঙ্গে ডুয়েট), ‘মতওয়ালি আখোঁওয়ালে হো অলবেলে দিলওয়ালে’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট)।

শেষের গানটির মূ্র্চ্ছনায় ছিল ক্যাস্টানেটস্ ও অ্যাকস্টিক গিটার (বাজানো হয়েছিল ফ্ল্যামেংকো স্টাইলে)-এর এক যুগলবন্দি। এরপর শোনা যায় চল্লিশ সেকেন্ডের এক অনবদ্য হামিং। প্রিলিউডকে ছাপিয়ে গিয়েছিল এক মিনিট সাতাশ সেকেন্ডের অপূর্ব ভায়োলিন অনসম্বল–এর রেশ। হিন্দি ফিল্মসংগীতের ক্ষেত্রে এটি এক যুগান্তকারী সংযোজন বা আবিষ্কার। চিরাচরিত ২/৪ বা ৩/৪ বিট রিদম প্যাটার্ন অনুসরণ করলেন না রাহুলদেব। তালের মূল যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হল সেকেন্ডারি পারকাশন ইনস্ট্রুমেন্ট, রেসো রেসো। দীর্ঘ কোডা মিউজিক, ক্যাস্টানেটস, বেলস, ঘুঙরুর প্রয়োগ, মিশ্র তালের প্যাটার্ন, ব্রাস সেকশনের অভিনব ব্যবহার এ ছবির সঙ্গীতকে তৎকালীন সব ছবির তুলনায় এক অনন্যতা প্রদান করেছিল।

প্রথিতযশা সুরকার, পরিচালক ও অভিনেতা শ্রীনাথ ত্রিপাঠীর অনবদ্য কম্পোজিশন ও লতা কণ্ঠে পরিবেশিত ‘ও পবন বেগ সে উড়নেওয়ালে ঘোড়ে’ (রেকর্ড নং – N 53701) হিন্দি ফিল্মি সংগীতের এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ভরত ব্যাস–এর লেখা ‘জয় চিতোর’ ফিল্মের এই গান সেইসময় রেডিওর গান হিসেবে প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই ছবির আর এক অনবদ্য সংযোজন, দাদরা তালে বাঁধা, ‘সাঁঝ হো গই প্রভু তুমহি প্রকাশ দো’ আজও সঙ্গীতরসিক শ্রোতাকে নস্টালজিয়ার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। শ্রীনাথ ত্রিপাঠীর সুরে লতা মঙ্গেশকর চারটি ভিন্ন স্বাদের গান পরিবেশন করেছিলেন রঞ্জন, বিজয়া চৌধুরী, হেলেন অভিনীত ছায়াছবি ‘জাদু নগরী’–তে। ‘রাত কা খামোশ সন্নাটা না পুছ’ লতাকণ্ঠের এক বিরল সাংগীতিক উপহার।
গুণী কম্পোজার বসন্ত দেশাইয়ের অসাধারণ সুরসৃষ্টি আপামর ভারতবাসীর হৃদয় জয় করে নিয়েছিল ষাটের দশকের গোড়ায়। বাবুভাই মিস্ত্রি নির্দেশিত ‘সম্পূর্ণ রামায়ণ’ ফিল্মে অনবদ্য অভিনয়ের নিদর্শন রেখেছিলেন মহিপাল, অনিতা গুহ, সুলোচনা, অচলা সচদেব, ললিতা পাওয়ার, হেলেন প্রমুখ। লতা কণ্ঠের চমকপ্রদ নিবেদন ‘বাদলো বরসো নয়ন কি কোর সে’ আজও হিন্দি গানের অনুরাগীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।

কবি ভরত ব্যাসের কলমে এই গান কাব্যসঙ্গীতের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে সমাদৃত হয়। গানের মূল ছত্রগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে নায়িকার মর্মব্যাথা। কথাগুলো শোনাই–
‘অ্যায় ঘটায়োঁ গর্জনা কো থাম লো
ও আজ মেরে করুণ স্বর সে কাম লো,
বন্ধ গ্যয়া সাওন নয়ন কি ডোর সে;
জহর কো অমৃত সমঝ কর পি রহি
নীলে জল বিন দিন হো কর জি রহি,
প্রাণ তড়পে ভাগ্য কে ঝকঝোর সে’
লতা মঙ্গেশকর–সলিল চৌধুরী জুটি এক যুগান্তকারী মেলবন্ধন, যা প্রায় চার দশক ধরে সমানভাবে স্বকীয়তা বজায় রেখেছিল। এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে লতা বলেছিলেন তাঁর প্রিয় সলিলদার সাংস্কৃতিক চেতনা ও সুরনির্মাণের অভূতপূর্ব কৌশলের কথা। লতার মতে, সলিল চৌধুরী তাঁর সাংগীতিক ভিত্তি নির্মাণের কাজটি করে দিয়েছিলেন অনেকাংশে। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, কৃষ্ণ চোপড়া পরিচালিত ‘চার দিওয়ারি’ ফিল্মটি বক্স অফিসে সফল না হলেও তার অতুলনীয় সাংগীতিক বিন্যাসের মাধ্যমে সঙ্গীতবোদ্ধাদের হৃদয় জিতে নিয়েছিল। শশী কাপুর, নন্দা, মনমোহন কৃষ্ণ, লীলা চিতনিস্–এর অভিনয় এই ছবিকে পৌঁছে দেয় এক অন্য উচ্চতায়। লতা কণ্ঠে পরিবেশিত, ‘নিঁদ পরি লোরি গায়ে মাঁ ঝুলায় পালনা’, ‘ঝুক ঝুক ঝুক ঝুম ঘটা ছাই রে’, ‘অকেলা তুঝে যানে না দুঙ্গি’ ইত্যাদি গান আজও মনকে সুরধারার এক মিষ্টি আবেশে ভরিয়ে রাখে।

এভিএম প্রোডাকসন্স–এর নবনির্মাণ, হৃষীকেশ মুখার্জি পরিচালিত ফিল্ম ‘ছায়া’ সেইসময়ে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুনীল দত্ত, আশা পারেখ, ললিতা পাওয়ার, নীরূপা রায়, নাজির হুসেন, অসিত সেন প্রমুখ। সলিল চৌধুরীর সুরে, রাজেন্দ্রকৃষ্ণের লেখায় লতা নিবেদন করেছিলেন তিনটি দুর্লভ রত্ন যা আজও সঞ্চিত রয়েছে সঙ্গীতপ্রেমী ভারতীয়দের মনে। গানগুলি হল– ‘ইতনা না মুঝসে তু পেয়ার বঢ়া’ (তালাত মেহমুদের সঙ্গে ডুয়েট), ‘দিল সে দিল কি ডোর বধেঁ’ (মুকেশের সঙ্গে ডুয়েট), ‘ছম ছম নাচত আই বাহার’। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Cinestaan, Businesstoday, Thesiasatdaily
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।
One Response
সন্জু, দারুন লাগল তোমার লেখাটা পড়ে!👏👏👏👏