বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানেন, জীবনটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে যে ক’টা লোক, তার মধ্যে এক নম্বর ক্রিমিনাল নিউটন। গাছ দিয়ে আপেল পড়ল, প্যান্টে পুঁছে খেয়ে নে, তা না। তাই নিয়ে তত্ত্ব করতে বসে গেল। এবার তার তত্ত্ববাজির ঠ্যালা যুগ-যুগ ধরে সামলে মরছে জনতা। ফিজিক্সের যে চ্যাপ্টারই খোল, বেড়েপাকা কাকা আমার কিছু না কিছু একটা বাঁশ দিয়ে গেছেই। এমন ফালতু লোক, তার কুত্তাটা অবধি শেষে সহ্য করতে না-পেরে, যা পেরেছে কাগজপত্তর তুলে মুখে করে নিয়ে গিয়ে আগুনে দিয়ে দিয়েছে। বাঁচিয়ে গেছে আমাদের। নইলে ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য শারীরশিক্ষাতেও কী না কী আরও পড়তে হত, ভগবান জানে। দিদিকে বলব, সব কলেজের সামনে কুত্তাটার একটা করে স্ট্যাচু করে দিতে। ডায়মন্ড!
বুড়োদা আর বউদি নিউটন জানত কিনা জানি না। কিন্তু আর্কিমিডিস জানত নিশ্চয়ই। তোমার যা আয়তন, সেই পরিমাণ জলের চেয়ে তোমার ওজন বেশি হলেই ব্যস, তুমি আর জলে ভাসবে না। ভাসলেই তো কেলো! রিস্কা উল্টে যাবে, কী তাই তো? এমনিতেই গোলগাল রিস্কাওলা কোনওকালে দ্যাখেনি কেউ। কিন্তু বর্ষার সময়ে তো আরও সচেতন থাকতে হবে! বেছে বেছে সিড়িঙ্গে দেখে রিস্কাওলা নিতে হবে। জল যতই কোমর অবধি উঠুক, রিস্কাওলা উথলে উঠবে না! ছুঁচের মতো বিঁধে থাকবে রাস্তায়… কোনও কেস নেই।
স্বামী-স্ত্রীর চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে যা যা বলতে হবে, তাতে এখনকার পলিটিকাল কারেক্টনেসে ধাক্কা লাগবে জোর! কী একটা বডি-শেমিং না কী উঠেছে, সেইটে হয়ে যাবে। ফেসবুকে খিস্তি খাব খুব। তো এক ছান্তায় দু’দু’খানা ফুলকো লুচি একবারে তুলে পাতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিভা যার আছে, একমাত্র সেই রিস্কাওলাই এ জিনিস কলেজস্ট্রিট মার্কেট দিয়ে তুলে, আদি মহাকালী পাঠশালা অবধি নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। টানা রিস্কা, ঠনঠনিয়ার ঢেউ, পুরোটা ট্রামরাস্তা… ছ্যাবলামো না ভাই। তার মধ্যে, এ যে কালের কথা, কংক্রিটে পাতা মাখম লাইন না। ইটের সাইজে কাটা পাথর। সেই বসিয়ে বসিয়ে ঘ্যাটাং-ঘ্যাটাং ট্রাম। মধ্যে-মধ্যে লাইন ভেঙে ভেঙে এসেছে। এক-মানুষ-সমান কাঠের চাকা সমানে গোঁত্তা খেতে থাকে গাড্ডায়। ছান্তায় ফুলকো দু’টো টলমল করে ওঠে! এই-টপকালো এই-টপকালো, সে এক দৃশ্য।
টানা বৃষ্টি হয়েছে কাল সেই দুপুর দিয়ে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত পেরিয়ে সকাল। গোটা কলকাতা ভাসছে। লোকে বেরোবার চান্স অবধি নিচ্ছে না। চালে-ডালে চাপিয়ে ডিমভাজা মেরে কতক্ষণে একটু দিবানিদ্রা যাবে, সেই স্কিম করছে… আর এঁরা, সাতসকালে মাছ কিনতে বেরিয়েছিলেন মানিকতলা বাজারপানে। সেখেনে মনমতো লক্ষ্মীমন্ত ইলিশ নাকি পাননি। সব খোকা। সব নাকি খয়রা। তার মধ্যে কে বলেছে, কলেজস্ট্রিট মার্কেটে দেড়-দু’কেজি এসছে নাকি কিছু। তাড়াতাড়ি গেলে পাবে। ওমনি তারা সেই মানিকতলা দিয়ে উজিয়ে এই সমুদ্দুরে বড়োমুখ করে চলে এসেছেন মাছ ধরতে। ভাবুন!
রিস্কাওলাকে মানিকতলা দিয়েই ধরেছে, “এই তো সুখে স্টিট যাব” বলে। সে বেচারা ইতিগজ বোঝেনি। তাকে যে গোটা ব্রহ্মাণ্ড ঘুরতে হবে এই জিনিস নিয়ে, শুধু রিস্কা টানলেই যে নিস্তার নেই, তার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে তাকে মুটে বানিয়ে কত্তা-গিন্নি যে শুঁকে-শুঁকে সবজি কিনবে গোটা বাজার ঘুরে-ঘুরে… সে দ্বারভাঙ্গা জিলা… মাছওলাকে ধমক দিয়ে-দিয়ে গাদা-পেটি এক করে মোটা পিসে কেমন করে গোল পিঠের ইলিশ কাটাতে হয় বাপের জম্মে দেখেনি! ‘গরীব আদমি হ্যায়’-ট্যায় বলতে গেছে দু’একবার… “আহ্, ঝামেলা কোরও না, বলেছি তো পুষিয়ে দোবো তোমায়, ব্যাগডা ঠিক করে ধরো, মাটিতে ঠেকিও না! দেখছো না জলে জল…উঁচিয়ে রাখতে হবে না?”
ফিরতি পথে হাঁটুজলে থপথপ করতে-করতে বউদি কাপড়খানা, দাদা লুঙ্গিখানা মালাইচাকির ওপর কুঁচি করে ধরে যখন ফের রিস্কায় চড়ছিল, লোকের কাজ নেই, দেখছিল জমায়েত করে! তার মধ্যে কোন ছোটলোকের বাচ্চা ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ‘টুনটুন’ বলে আওয়াজ দিয়েছে বউদিকে। তাতে এমন চোখ পাকিয়ে ঘ্যাঁক করে উঠল বউদি, সত্য যুগ হলে গোটা বাজারটাই ভস্ম হয়ে যেত। বুড়োদা উঠবার সময়ে আবার কে একটা ‘আমজাদ খান’ বলল। টপাটপ সিটি পড়ল দু’চ্চারখানা। বুড়োদার হেলদোল নেই। হোঁদল কুতকুত বলেনি, মনে মনে তাতেই খুশি। তারপর, সবজির ব্যাগ উঠল। “আহা আহা, দেখে তোলও। আমিষের থলেটা আলাদা রাখো। ওইটেয় ঠেকিও না।” কতগুলো জম্ম ধরে কত কত পাপ করেছে সিয়ারামের কাছে, সেই নিয়ে মাফ চাইতে চাইতে মনে মনে, রিস্কাওলা শেষে তার এত কালের সমস্ত অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা এক করে হাঁটুজল রাস্তা থেকে ছান্তা তুলে ধরল সন্তর্পণে অতি। তাতেও দুটো লুচিই দু’দিকে পড়ে যাচ্ছিল। রিস্কাটাও উল্টে যাচ্ছিল নির্ঘাত। কিন্তু ঈশ্বর আছেন। বজরংবলী আছেন। ‘খানে কা ঠিক নেহি, চার বাজে নাহানা’-র নিষ্ঠায় নিশ্চয়ই কিছু পূণ্য অর্জন হয়েছে অ্যাদ্দিনে। জমায়েতের আরও চাট্টি টিটকিরি, আরও হ্যাহ্যাহিহি-সিটির মাঝে দুলতে দুলতে অকুল পাথারপানে যাত্রা করল অপূর্ব এক ডিঙি, শীর্ণ এক কাণ্ডারীর কাঁধে দায়ভার দিয়ে।
নিজেদের সমস্ত উদ্বেগ শেষ হলে, কলকাতার বাবুদের উদারতা উথলে ওঠে। প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে তখন তার রসিক আত্মীয়-আলাপের কুড়কুড়ুনি জাগে কুঁচকিতে! সুদূর দেহাত দিয়ে রুজিখোঁজে কলকাত্তা আসা মৈথিলীভাষীর সনে সে তখন খোসগপ্প জোড়ে। কোথায় দেশ, কে কে আছে, পয়সা জমিয়ে তার জমি কেনা উচিত একটু একটু করে, ছোট্ট মেয়েটাকে বউয়ের সঙ্গে লোকের বাড়ি কাজ করতে না-পাঠিয়ে পড়াশুনো করানো উচিত, তোমাদের ওখানে তো খুব ভালো লিচু হয়, সে বার দেউঘর গেসলুম, আঁটি-আঁটি লিচু খেয়েছিলুম সস্তায়… আজ তোমার কী রান্না হবে, এই ওয়েদারে রোজ-রোজ রান্নাবাড়ি না-করলেও তো পারও। ফালতু হাঙ্গামা। তোমাদের তো ছাতু আছে, ভালো করে মাখকে আচার দেকে আজ খেয়ে নিও নয়। যেন শ্বশুরবাড়ির পাড়ার লোক…কদ্দিন পরে দেখা হয়েছে!
মাঝে উল্টো দিক দিয়ে ম্যাটাডোর এসে ষাঁড়াষাঁড়ি বান আছড়ে দিয়ে যায়। মাছের ব্যাগ, তরিতরকারির থলে ঠেকিয়ে লেপ্টে দিয়ে যায়। গিন্নি ঘ্যাঁক করে ওঠেন, “দেক্কে চালাও, সব খারাপ হো গেয়া।” আকাশে আবার ঘনিয়ে আসে কালো, বড়ো-বড়ো ফোঁটা একটা দু’টো করে পড়তে শুরু করে। কত্তা হাঁকেন, “তুরন্ত ভাগো, বৃষ্টি আ রাহা হ্যায়, দেখতা নেহি?”
রিস্কাওলা কালা। খালি পথনির্দেশটুকু কানে যায় তার। ঈশ্বর তাকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন আজব এ শহরে শৌখিন বেতো বাবুবিবিদের আয়েশ আর আদিখ্যেতার ভার বইতে, সারভাইভালের তরে। তুম কালা তো জগত ভালা, কী?
জন্ম কলকাতায়। কর্মও মোটের ওপর এখানেই। কারণ, সম্ভবত এ শহরের প্রতি মাত্রারিক্ত মায়া। যৌবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত পড়াশুনোর প্রতি দায়বদ্ধতা ক্রমক্ষীয়মান, উল্টে সিলেবাস-বহির্ভূত নানা বিষয়ে আগ্রহ, বিশেষ করে রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সিনেমা। কর্মজীবনে শুরুর দিকে, বিভিন্ন বিনোদনমূলক বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে বেশ কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পরিচালক। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সিনেমার দুনিয়ায় সম্মানিত কয়েকটি ফিল্মের সম্পাদক। এরই মধ্যে, প্রথম সারির কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি। বর্তমানে স্বাধীন ভাবে তথ্যচিত্র ও প্রচারমূলক ছবি নির্মাণ, বিভিন্ন অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। আর, ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শদাতা একটি সংস্থার অংশীদার। প্রথম প্রকাশিত গদ্য ২০০৬, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘রোববার’ পত্রিকায় (সংবাদ প্রতিদিন)। পরে, আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময় ও অন্যত্র। প্রবন্ধ বা ফিচারধর্মী লেখার পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পও।