‘সবার উপরে বাজার’ সত্য তাহার উপরে আর নাই। আমরা সবাই জানি চণ্ডীদাস-এর গানের লব্জ এমনটা কখনোই নয়; তবে উদার অর্থনীতির তিন দশক পরে বাজারের সর্বাঙ্গীণ হা রে রে রে দেখে অন্য কোনও শব্দ মাথায় আসা ক্রমশই মুশকিল। (Mobile Recharge)
বিরানব্বইয়ের খোলা বাজারের পালে যে কজন সর্দার জোরতর হাওয়া লাগিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্রী অরুণ শৌরি। বাজপেয়ী জমানার বিকেন্দ্রীকরণ মন্ত্রী। হঠাৎ তাঁর কথাই প্রথম মনে পড়ল বিএসএনএল কর্মীদের করুণ চিঠি দেখে। মোবাইল ট্যারিফের অসামান্য উর্দ্ধমুখী পারদ দেখে এরা সরকারকে লিখেছেন বিএসএনএল এই বাকবিতণ্ডার বাজারে গ্রাহকদের তুলনামূলক কম দামে পরিষেবা দিতে পারে কিন্তু তার জন্য ফোর জি ফাইভ জির যে পরিকাঠামো তাঁদের প্রয়োজন তা এখনও টাটা কর্তৃপক্ষ বানিয়ে দেয়নি। ঢিলেতালে চলছে সেই কাজ। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। ভেবে দেখার বিষয় বই কী। দারুণ অনটনে চলা সরকারি বিএসএনএল চাইছে পরিষেবা দিতে কিন্তু বেসরকারি উদ্যমী টাটার গাড়ি চলছে ঢিমেতালে। আসলে এই হচ্ছে বাজারের মজা।
এঁদের উপস্থিতিতে যা হয় তার টের জনগন হাড়ে হাড়ে পান। গুদামঘরে আটকে রেখে আলুর দাম হয় পঁচিশ টাকা কেজি। সর্বব্যাধি দূরকারি গোবর হয় মহামূল্য। আর এমন এয়ারপোর্ট পাওয়া দুষ্কর যেখানকার সমস্ত উর্ধ্বমুখী সারচার্জ একজন বা দুজনের অ্যাকাউন্টে ঢোকে না।
অর্থনীতির সোজাসাপ্টা হিসেবে বাজার একটি আদর্শ ব্যবস্থা যা আনন্দমধুর পরিশ্রমমুখী সমাজের চাবিকাঠি। যতক্ষণ সেখানে চলছে নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতা, মানে যে বাজারে ঘুষ নেই, চুরি নেই ঠকানো বিজ্ঞাপন বা রাজসূয় কিকব্যক নেই, গুণ্ডা নেতাদের গুদাম নেই, লুকোনো সুইস ব্যাঙ্ক নেই, ঠকবাজি, দাদাগিরি হাওলা নেই, মানে সেই বাজার যেখানে আদানী, আম্বানি থেকে সুইগি, জ্যোমাটো রামদেব কেউ নেই! কারণ প্রকৃত বা নিরপেক্ষ প্রতিযগিতার কোনও না কোনওভাবে পরিপন্থী এঁরা। এঁদের উপস্থিতিতে যা হয় তার টের জনগণ হাড়ে হাড়ে পান। গুদামঘরে আটকে রেখে আলুর দাম হয় পঁচিশ টাকা কেজি। সর্বব্যাধি দূরকারি গোবর হয় মহামূল্য। আর এমন এয়ারপোর্ট পাওয়া দুষ্কর যেখানকার সমস্ত উর্ধ্বমুখী সারচার্জ একজন বা দুজনের অ্যাকাউন্টে ঢোকে না।
ডায়াল ঘোরানো টেলিফোনের কৌলিন্য থেকে পিসিও বুথের সার্বজনীনতা পেরিয়ে হাচের কুকুর আর নোকিয়া ৩৩২০ এর স্মৃতি আজ শুধু পুরনো ছায়াছবির গানেই সতেজ। বড় স্ক্রিন জোরে আওয়াজ। বেশি পিক্সেল আর অনেক অনেক মেমোরিময় বর্তমানে স্মার্টফোন, শৈশবের কান্না ভোলানোর খেলনা। বাল্যের অত্যুৎসাহের সঙ্গী, কৈশোরের প্রেম ও যৌনতার শিক্ষক, যৌবনের জীবিকা ও পরিবার পরিচালনার প্রাথমিক অঙ্গ ও বার্ধ্যক্যের গুড মর্নিং পাঠানোর হাতিয়ার। রসগোল্লা বা চিকেন রোল বা হাওড়া ব্রিজ ছাড়া জীবন কাটতে পারে কিন্তু মোবাইল থুড়ি ইন্টারনেট থুড়ি ডাটা ছাড়া জীবন অচল।
এয়ারটেল, ভোডাফোন, রিল্যায়েন্স একযোগে তিনহাজার কোটি টাকার বেশি লাভ করেছে ২০২৩ এ কিন্তু তার ভাগ আপনার প্রাপ্য নয়। শেয়ার বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেওয়াই যেকোনও বাজারি সংস্থার লক্ষ্য আর আপনার অবিশ্রান্ত রিল, ক্লিপ, লাইভ দেখার তাড়না সেই লক্ষ্যের নিবিড় সহকারী।
গত মাসে একযোগে রিল্যায়েন্স, এয়ারটেল ও ভোডাফোন প্রিপেড ও পোষ্টপেড এর ট্যারিফ বাড়ানোর পরে যাঁদের বিস্ময় কাটেনি তাঁরা বোধহয় জানতেন না আম্বানি আবাসনের ঠিক পাশেই এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি। এয়ারটেল, ভোডাফোন, রিল্যায়েন্স একযোগে তিনহাজার কোটি টাকার বেশি লাভ করেছে ২০২৩ এ কিন্তু তার ভাগ আপনার প্রাপ্য নয়। শেয়ার বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেওয়াই যেকোনও বাজারি সংস্থার লক্ষ্য আর আপনার অবিশ্রান্ত রিল, ক্লিপ, লাইভ দেখার তাড়না সেই লক্ষ্যের নিবিড় সহকারী।
সারা পৃথিবীর নিরিখে ভারতে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক সংখ্যা বেশ বেশি, আর সত্য কথা বলতে ডাটার খরচও অনেকটাই কম, জনপ্রতি ডাটা ব্যবহারে ভারত কুয়েত(৮৪ জিবি/মাস) বা সৌদি(৪৪ জিবি/মাস) এর থেকে পিছিয়ে থাকলেও (ভারত- ২৯জিবি/মাস) আমরা কিন্তু আমেরিকার (২১জিবি/মাস) থেকে এগিয়ে। মোটের উপর চালে ডালে রিচার্জে আমাদের আহ্লাদ কম নয়। সমস্ত গ্রাহক মুখী ইন্টারনেট কোম্পানি যেমন ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এদের সবার জন্য ভারতীয় বাজার একশো চল্লিশ কোটি জনতার সমস্বর।
নেট-এ খেলে তো পিঠে সইতেই হবে। অথবা যারা হাডকো মোড়ের বিএসএনএলের কর্মচারীদের উঠতে বসতে খোরাক করেছি। অকর্মণ্য বলে আর শাইনিং ইন্ডিয়ার চপ্পলে পেরেক মেরেছি তারা ট্যারিফ বাড়ার গুঁতোয় কাহিল হতে পারি না।
তা নেট-এ খেলে তো পিঠে সইতেই হবে। অথবা যারা হাডকো মোড়ের বিএসএনএলের কর্মচারীদের উঠতে বসতে খোরাক করেছি। অকর্মণ্য বলে আর শাইনিং ইন্ডিয়ার চপ্পলে পেরেক মেরেছি তারা ট্যারিফ বাড়ার গুঁতোয় কাহিল হতে পারি না। উদার, বাণিজ্য বন্ধু অনিয়ন্ত্রিত বাজার প্রতিযোগিতার পরিপন্থী। প্রায় একচেটিয়া বাজারে গ্রাহক অসহায়। আর সেই গ্রাহকের এমএমএস নেশা থাকলে তো সর্বনাশ। টাকা আগে না বাজার আগে!

সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় আদতে বাগবাজারবাসী; অধুনা ক্যালিফর্নিয়া প্রবাসী। ঘুরতে, খেতে, পড়তে, ছবি তুলতে ভালোবাসেন। লেখালিখি করেন অনিয়মিতভাবে।