আমফানের পর বাঙালিদের এ বছর আর আমবিলাস হল না। হয় আচার বিলাস না হলে আমচুর বিলাস!
আম সব কুচি কুচি হয়ে বয়ামে বয়ামে ঢুকে পড়েছে। ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি হয়ে ভিড়ে ঠাসা বনগাঁ লোকালের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মতো। কত রকমের বয়াম। কোনওটা হাতির পায়ের মত গোল, কোনওটা চৌকো, কোনওটা কাচের, কোনওটা প্লাস্টিকের, কোনওটা একটু লম্বাটে। কারও মাথায় রুপোলি টিন, কারও মাথায় নীল প্লাস্টিকের টুপি। মোট কথা গ্রামে, মফসসলে ছাতে কিংবা উঠোনে কটকটে রোদ দেখলেই দেখা যাচ্ছে সারি সারি বয়াম বনগাঁ লোকালের কামরার মত বসে আছে উঁচু প্ল্যাটফর্মে।
[the_ad id=”266918″]
এসব দৃশ্য শহরে মেলে না। কেন মেলে না?
কিছু কারণ আছে। প্রথমত: ফ্ল্যাটবাড়ির নিজস্ব আমগাছ বলে কিছু হয় না। যদিও বা এক আধটা গাছ দৈবপাকে হয়ও, রাস্তার ছেলে ছোকরাদের জন্য বরাদ্দ। দ্বিতীয়ত: উঠোন ভরা রোদ নেই। উঠোনই নেই, তায় আবার রোদ। গরাদের মত একহাত জানালায় আর যাই হোক আচার হয় না। বেশিরভাগ ফ্ল্যাটবাড়িতে সূর্যদেবের রেশনিং চলে। তৃতীয়ত: এজমালি ছাদ আছে। গোটা পঞ্চাশ সিঁড়ি ঠেঙিয়ে, ওইসব বয়াম বয়ে নিয়ে যাওয়া কোনও ক্রেনের পক্ষে সম্ভব নয়। শহরে ক্রেনের হাঁটুতে সব জং। তৃতীয়ত: মশলা ঝাড়াই, পেষাই করে অত আম টুকরো করে রান্নাঘরে ঘাম ঝরানোর মতো এত সময় শ্রীমতীদের নেই। তাঁদের কবজিতে সময় বাঁধা। তাঁরা ছুটছেন। তাঁদের গতি নিয়ন্ত্রিত হয় গোপালের মায়েদের দ্বারা।
[the_ad id=”266919″]
তাই ফ্ল্যাটবাড়ির শেষ পাতে হয় আচার থাকে না, নয়তো আচার আসে হরেক মেলার স্টল থেকে, বা বিভিন্ন স্টোরে বিক্রি হওয়া বোতল থেকে। শহরে ওসবের চাহিদা বেশি। ধাবমান, ঘেঁষাঘেঁষির শহরে যারা ভাগ্যবান তাদের ছাদে, জানালার চৌকাঠে শোভা পায় অমন কিছু বয়াম। নিজেদের গাছ থাকলে ভালো, নয় সবজি বাজারের কাঁচা আম ভরসা।

বড়ি, আচার, আমচুর, আমসত্ত্ব এখনও বেঁচে আছে গ্রাম, মফসসলের দালানে, ছাদে। ঝুড়ি ঝুড়ি আম, গাছ থেকে বা বাজার থেকে এসে উপুড় হয়ে পড়ে জলহস্তির মতো। তারপর বড় বড় বঁটি নিয়ে বাড়ির গিন্নি, বৌমা, ননদ মিলে যত্নে ছাল ছাড়িয়ে শক্ত আঁটি ফেলে চৌকো চৌকো করে সমান সাইজে কেটে ফেলে রাশিকৃত আম। আচারের জন্য এক সাইজ, আমচুরের জন্য আর একরকম। আমসত্ত্ব বানাতে চাইলে সে আম কাটতে হয় আর একভাবে। আমতেলের আম বড় বড়। সাইজে গন্ডগোল হলে স্বাদবদল হয়ে যেতে পারে।
[the_ad id=”270084″]
ছোটবেলায় দেখতাম, দুপুরে স্নান করার আগে, বা খাওয়া দাওয়ার পরে ঠাকুমা-পিসিমাদের পা ছড়িয়ে বসে বসে আম কাটা। গল্প করতে করতে দ্বিপ্রাহরিক আমের কর্তন বেশ জমে যেত। আমরাও একটা বঁটি নিয়ে বসে পড়তাম। তখন বাড়িতে বাড়িতে বঁটিও পাওয়া যেত হরেক রকমের। কোনওটার মাথা ময়ূরপঙ্খির মত, কোনওটা মাথা কাটা, কোনওটার ব্যাঁট মস্ত বড়, কোনওটা ছোট। নারকেল কাঠি তোলার জন্য, আম কাটার জন্য আলাদা আলাদা বঁটি ছিল তখন। বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ভরে উঠত শত শত মেয়েলি গল্পের সঙ্গে সঙ্গে। টুকরোগুলো বৃষ্টিকণার মত টুপটাপ গিয়ে পড়ত চুন গোলা গামলার জলে। সঙ্গে কত রকমের কাসুন্দির মতো জিভে জল আনা সব মুখরোচক গল্প! ঠিকে মেয়ে সর্বাণী শ্বশুরবাড়িতে কেমন করে সতীনের ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘর করে, পেছনের বাড়িতে সপ্তাহ শেষে কর্তামশাই কর্মস্থল থেকে ফিরলে কেন অমন বিকট চেঁচামেচি হয়, পাড়ার নিতাইবাবুর বোনকে দেখতে এসে বরের পিসি নিতাইবাবুর বোনের চুল দেখতে চেয়েছিল কেন– এই সমস্ত গল্পে দুপুরগুলো জমে যেত। মেজপিসি কিছু কিছু আমের টুকরো একটা বাটিতে নিয়ে কয়েকটা কাঁচালঙ্কা, একটু নন আর কয়েক ফোঁটা সরষের তেল দিয়ে এমন জারিয়ে দিত রোদে, যে নোলা বিশ্রাম পাওয়ার সময় পেত না।

সেই সব টুকরো করা আম কুলোর ওপর বিছিয়ে যখন রোদ লাগানো হত, পাড়ার মুদি দোকানে নীল সুলেখা কালিতে লেখা ফর্দ যেত বাড়ির কর্তা বা বাচ্চাদের হাত মারফত।
স তৈল – এক লিটার
জিরা – তিন শত গ্রাম
পাঁচফোড়ন- দুই শত গ্রাম,
কালো সরিষা- দুই শত গ্রাম।
কাগজে মোড়া হয়ে সব মশলা চলে যেত সটান রান্নাঘর। এরপর হামান দিস্তা নয়তো বড় শিল। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত ঘটর ঘটর শব্দ। সে কালে রান্নাঘর খুব একটা বিশ্রাম পেত না। নিরন্তর কর্মযজ্ঞ চলত। সারাবছর হয় গয়না বড়ি, নয় আমচুর-আচার, নয় পিঠে-পুলি। শিল-নোড়া তখন রান্নাঘরের হিরো। এরপর সন্ধে হলে লোহার বড় কড়াইতে সেই মশলার পাকে পাকে মিশত রোদে আংশিক শুকোন আমগুলো। সারা ঘর ম ম করত মশলার গন্ধে। তেলে ডোবানো মশলা মাখা আচার বয়াম ভর্তি হয়ে সারা বছরের জন্য ঢুকে যেত ভাঁড়ারে।
[the_ad id=”270085″]
ওই অন্ধকার অন্ধকার ভাঁড়ার ঘরের কাঠের তাকে যখন হলদেটে মোরব্বা, লালচে-কালচে আচার, আমতেল জাঁকিয়ে বসত, বড় নোলা লকপক করত। পাশের বাড়ির খুকুদের বাড়িতে এর সঙ্গে আর এক মোটাসোটা বয়ামে থাকত হলুদ রঙের তেলতেলে কাসুন্দি। আহা! সে স্বর্গীয় স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। বাড়িতে বাড়িতে মা, জেঠিমা, দিদিমাদের এই সুস্বাদু আচার তৈরির হাতগুলো ছিল সব চমৎকার। একশোয়ে একশো। পেনাল্টির একটা বলও গোলপোস্টের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। ফলে বছর, ফ্যাশন পাল্টে যায়, কিন্তু মা, জেঠিমাদের আচার, কাসুন্দির হাত পাল্টায় না। তাই গরম ভাতে ঘি, বড়িভাজা, শাকের ছ্যাঁচড়া, মাছের মাথা দিয়ে কুমড়োর ঘণ্ট, পাকা রুইয়ের ঝোলের পর অতিথিদের চকচকে বড় কাঁসার থালায় যখন কালচে তেলতেলে আমের আচার এসে পড়ে, সে আপ্যায়ন পৃথিবীর কোনও বড় রেস্তরাঁ দিতে পারে না। অতিথিকে খুশি করার কত না প্রয়াস!
— এই আচারটা মিষ্টি মিষ্টি। এটা দেই? এটা একটু ঝাল মিষ্টি। এ আমার কাকিমার হাতে তৈরি।

অতিথির না বলার হিম্মত বা ইচ্ছে কোনওটাই থাকে না। খাওয়ার পর মুখ ধুতে গিয়ে পুকুর ঘাটের চাতালে বসে আর এক প্রস্ত গল্প করতে করতে আমের শক্ত আঁটির অংশটুকু চুষতে-চুষতে, চিবুতে চিবুতে কখন যে বেলা গড়িয়ে যেত তার হিসেব থাকত না। এই না হলে জীবন!
এ সব বিলাস শহরের জীবন থেকে একেবারে হারিয়েই গেছে। একখানা সপ্তাহান্তের দুপুরে খাসির মাংসের ঝোল আর টমেটোর চাটনি কোনওরকমে গোগ্রাসে গিলে বাঙালি ভাতঘুমের তোড়জোড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আচার বিলাস এ জীবনে অপাংক্তেয়। বিভিন্ন মেলাতে তাক ভর্তি বয়ামে বয়ামে বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যে রগরগে মশলাওয়ালা বস্তু আচার বলে বিক্রি হয় সেগুলোতে আর যাই হোক মা- জেঠিমাদের আস্বাদ কোনওমতেই পাওয়ার কথা নয়। তার রং যতটা অপকারী, স্বাদও পাইকারি। ওগুলোকে ঠিক আচার বলে গণ্য করা যায় না। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে আচারের মধ্যে আমের সঙ্গে মেলে মুরগির পালক, আরশোলার ঠ্যাং-ও।

সভ্যতার চাকা দ্রুত ঘুরছে। সময়, স্বাস্থ্য, পরমাণু পরিবারে সব হারাতে শুরু করেছে দ্রুত। শহর এই বিলাস হারিয়ে ফেলেছে। গ্রাম, মফসসলও হারিয়ে ফেলছে দ্রুত। ভয় হয়, হয়তো বা কিছুদিন পরে আমাদের স্মৃতির বয়ামেই কেবল মা-জেঠিমাদের ওই আচারের স্বাদ থেকে যাবে। আমাদের জীবনে আচার বিলাস হয়ে দাঁড়াবে ডাইনোসরের মতোই অবলুপ্ত।
কর্মসূত্রে কলকাতায় বসবাস। ছোটবেলা কেটেছে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। শখ - বইপড়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং ঘুরে বেড়ানো। ২০১৯ সালে 'সৃষ্টিসুখ' থেকে প্রকাশিত হয়েছে গদ্য সংকলন- 'রোজনামচা'। সম্প্রতি ভূমিকা লিখে পুনঃপ্রকাশ করেছেন ১৮৭৫-৭৬ সালে প্রকাশিত মেয়েদের দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা 'বঙ্গমহিলা'।
6 Responses
বেশ ভালো লাগলো।
চমৎকার লেখা। এক নিমেষে চলে গেলাম সেই সুবর্ণ অতীতে!
আচার শুনলেই জিভের নীচ থেকে সুরসুর করে জল এসে যায়। সেই আচার নিয়ে তত্বতালাশ। এতো সুন্দর লেখা, পড়তে পড়তে কম বেশি সকলেই স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাব আমরা।❤❤😊😊
খুব ভালো লাগল।
Khub mukhorochok bornona.porei jive jol asche.
পড়তে পড়তে কতবার যে ঢোক গিললাম!!😍😍😍
জিভে জল আনা লেখা, ধন্যবাদ