Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বসন্ত বিদায়? 

অনুপম রায়

ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০

Basanta biday Chiranjit Samanta বসন্ত বিদায় চিরঞ্জিত সামন্ত
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ক্ষমা করো আমি ভালো নেই
এলোমেলো হয়ে গেছি,
যেন সব হারিয়েছি,
এ বসন্ত বিদায়। 

ভেবেছিলাম জনপ্রিয় হবে এই গান। কিন্তু হল না। যাঁরা পড়ছেন, আমি ধরে নিচ্ছি ৮০% কেউ শোনেইনি। তাই সবার সুবিধার্থে বলে দিই, “সাঁঝবাতি” ছবির জন্য বানিয়েছিলাম এই গান। ২০১৯-এর শীতে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি, এখন চলছে হলে। হয়তো কিসুই নতুন নেই এই গানে, একদম বোগাস গান অথবা হয়ত প্রমোশন হয়নি… কিন্তু গান কেন চলল না, সে বিষয়ে এই লেখা নয়। এ লেখা বসন্ত বিদায় নিয়ে। 

আমাদের শহরের বয়স বাড়ছে। আক্ষরিক অর্থেই বয়স বাড়ছে। বসন্তরা স্কুল, কলেজ করে সাঁই সাঁই করে কেটে পড়ছে বম্বে, বেঙ্গালুরু, বিলেত, আমেরিকা। আর পড়ে রইছে ৫০+ জেনারেশন। আর এই যে একটা ক্রমে বাড়তে থাকা বয়স্ক জনগণ এই শহরের, তাঁদের জন্যই তৈরি হচ্ছে গান, লেখা, ফিল্ম সবকিছু। দেখা যাবে তাঁরাই বাংলাটা পড়েন, শোনেন বা দেখেন। বাকি সব টাটকা বসন্ত, হিন্দি ইংরিজিতে চালিয়ে নিচ্ছে। বাংলা পড়ে তো চিড়িয়াখানার ভল্লুক হতে হয়। বাংলার অবক্ষয়? তা তো হবেই। কিছু তো বানাতে হবে রে বাবা! বসন্তকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেব কেন? অর্থ নেই, এটাই মূল রোগ আর এই রোগের উপসর্গ হলো – চালাক বসন্ত অর্থের লোভে অন্যদিকে পাড়ি দিয়েছে। ব্রেন বসন্ত কমে গেছে। ঢ্যাঁড়শ বসন্তে ভরে যাচ্ছে বাজার। 

মানুষ নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনে নিজের আলসেমির জন্য। ৯০-এর দশকে যখন কম্পিউটার ঢুকছে বাঙালির জীবনে, আমরা প্রথমেই ‘না’ বলেছি। জাম্প কাট, শূন্য দশকের শুরু থেকেই পালে পালে সব বসন্ত চলেছে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে। দ্রুত পালটি খাওয়া, সে একদিক থেকে ভালো। কিন্তু শুধু বসন্তরাই শিখল। তাদের মা-বাবা, কাকা, দিদা কেউ শেখার চেষ্টা করল না। এই যে এক দল পোস্টবসন্ত জেনারাশেন, যাঁরা ধরেই নিলেন যে ত্রিশের পর তাঁদের জীবন শেষ, সেটা যে সত্যিই এ ভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে, তাঁরা বুঝতে পারেননি। মানুষের মন, নতুন কিছু শেখার মন, যে কেন মরে যায় সে বিষয়ে আমি আলোকপাত করতে পারব না। কিন্তু এটা ঘটে।

এই নিয়ে গান লিখেছিলাম “ইস দেবাশিস!” দেবাশিস এরকমই একজন পোস্টবসন্ত মানুষ, যে আটকে আছে তার ফেলে আসা বসন্তের দিনগুলিতে। বন্ধুদের মধ্যে আলোচনায় প্রায়ই শোনা যায় “আরে আমাদের সময় যে গানগুলো চলত …।” আমার প্রশ্ন “আমাদের সময়” মানে কী? সেটা কি মরে গেছে নাকি? যদি মরে না গিয়ে থাকে, তাহলে এখন কার সময়? এখানে বুঝে নিতে হবে “আমাদের সময়” মানে হলো বসন্ত। বসন্ত ভেগে গেছে, মনটাও মরে গেছে। 

এরপর এল মোবাইল ফোন। আবার প্রথমেই ‘না’। এক দল দেখাল ক্যান্সারের ভয়। আর অন্য দল বিলাসিতা মনে করে অপমান করল। তারপর যথারীতি আবার পালটি। ল্যান্ডলাইন উঠে যেতে বসেছে প্রায় এমন অবস্থা! এখন তো দেখি গুন্ডা-স্মাগলারদের মতো সবার দু’তিনটে করে সিম! সকাল বিকেল পরমানন্দে গুড মর্নিং আর গুড নাইট পাঠাচ্ছে। তা মোবাইল তো এল, বসন্ত কি এল? হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে মিথ্যে খবর আর ভুল তথ্য ফরোয়ার্ড করে কেটে যাচ্ছে দিন। অনেক পরিশ্রম করে উবর বুক করতে করতে চালিয়ে তো যাচ্ছে? তা নিশ্চয় যাচ্ছে। কিন্তু কোয়ালিটি অব লাইফ বলে একটা জিনিস হয়। সেটা কি খুব একটা ভালো? তার জন্যই “দিনগত পাপক্ষয়”, “এই চলে যাচ্ছে” এইসব উত্তরগুলো তৈরি হয়েছে। কারণ নতুনের প্রতি আগ্রহ চলে গেছে। মনের ভেতর বসন্ত মৃতপ্রায়। এখন শুধু বাজতে থাকে, “প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন।”

গানের কথা যখন উঠলই, তাহলে আর একটা কথা বলি। সঙ্গীত ডিজিটাইজেশানের পর, পোস্টবসন্ত বাঙালি এখন কী করে গান  শুনতে হয় তা জানে না। শুধু সাধারণ মানুষের কথা বলছি না। বহু সঙ্গীতশিল্পীই জানে না, কারণ তাঁদের আগ্রহই নেই। এখনও বাংলা সংবাদপত্রে, ফেসবুকে লেখা পড়তে হয় ‘সিডি, ক্যাসেট উঠে গেল – হায় হায়’ ন্যাকা কান্না। গেছে তো গেছে, গান তো উঠে যায়নি রে বাবা! ক্যাসেটের দোকান বন্ধ হয়ে সব মিউজিক অ্যাপে চলে এসেছে, এ এখন বোঝাতেই মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আরও সস্তা, আরও সহজ হয়ে গেছে গান শোনা। 

ওদিকে সারেগামা-র কী বুদ্ধি! বুঝে গেছে মানুষ হলো অলস। আর এই যে একদল মানুষ যারা বুঝতেই পারছে না কী ভাবে গান শুনবে তাদের জন্য নিয়ে এলো ক্যারাভ্যান। রেডিয়োর মতো কিউট দেখতে গাদা গুচ্ছের পুরনো গান ভরা ক্যারাভ্যান। চালিয়ে দিয়ে চিল করো। যা বাজবে তাই শুনবে, ভাবতেই হবে না। আর যে মানুষ যত কম ভাববে, বসন্ত থেকে সে তত দূরে চলে যাবে। ওদিকে বসন্তদের দেখো, তারা কিন্তু গানা, সাভন, অ্যামাজন, অ্যাপল, স্পটিফাই সব জায়গায় ঢুকে পড়েছে। কানে হেডফোন আর পকেটে মোবাইল গুঁজে হেলে দুলে চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। পাইরেসির দিন শেষ। বিশ্বের সব গান যদি হয় বিনামূল্যে অথবা খুব সামান্য খরচায় এসে যায় হাতের মুঠোয়, তাহলে কী হবে পাইরেসি করে? (ইন্টারনেট ব্যান করে দিলে অবশ্য সেগুড়ে বালি)। 

বসন্তরাই গান শুনে হিট করায়। একটা নতুন গানের অপেক্ষা বসন্তরাই করে। বাকিরা তো ব্যস্ত নিজেদের জীবন নিয়ে। সেটাই স্বাভাবিক। এই যে নতুনের সব কিছুর প্রতি আগ্রহ এটাই বসন্তের আসল পরিচয়। এক সময় রেডিও ছিল নতুন গান শোনার জায়গা। বাংলার ক্ষেত্রে সেটা সম্পূর্ণ ঘেঁটে গেছে। এখন বাংলা গান বাজেই না রেডিয়োতে। সে অন্য প্রসঙ্গ। বাজে না তো বাজে না। তা বলে কি মানুষ শোনে না? ইউটিউবে দেখে। ১০ রকম অ্যাপ আছে, সেখানে শোনে। তারা এবার ভেবে নেবে, গানটা তাদের কেমন লাগল। তাদের ভালো লাগলে, দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু উপর মহলের সম্মতির জন্য তখন অপেক্ষা করতে হয় গানটাকে। সেই গান, যা হয়ত দশ দিন আগে বেরিয়ে গিয়ে হৈহৈ ফেলে দিয়েছে, এখন আস্তে সুস্থে শোনানো হবে পোস্টবসন্তদের। তাদেরও যদি কিছু শতাংশের ভালো লেগে যায় তখন আর দেখে কে? 

বিশ্বজুড়ে ইয়ুথ আইকনদের বয়স কমছে প্রতিদিন। মানে বলতে চাইছি এখন যারা আন্তর্জাতিক বাজার কাঁপাচ্ছে তারা সবাই কাঁচা বসন্ত আর যারা বাজারে টিঁকে আছে তাদের বুকেও বসন্ত উৎসব। এবার বছরের সেরা অ্যালবাম গ্র্যামি (পুরস্কার দিয়ে আমি ট্যালেন্ট মাপছি না, তুলনার জন্য উল্লেখ করছি মাত্র) পেয়েছে বিলি ইলিশ, বয়স ১৮। আমরা পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্ব। রিয়ালিটি শো-তে আদ্যিকালের কণ্ঠীদের গান শুনি আর কোন পুরনো গান, কে কত ভালো গাইল তার সমালোচনা করি। সৃজনশীলতা আসবে কোত্থেকে? বসন্তকে তো ওখানেই মেরে ফেলা হচ্ছে! একটা নস্টালজিয়ার কুয়োয় আটকে থাকা বিনোদন ছাড়া কিছু নয় এটা। বসন্তের কাজ নতুন প্রাণ নিয়ে আসা, মরা গাছে নতুন পাতা নিয়ে আসা। নিজেই যদি পুরনো পাতা ঝরা ডাল হতে চায়, তাহলে আর কিছু বলার নেই। অন্যদিকে সিনেমার জগতে ঋদ্ধি, ঋতব্রতদের দেখে ভালো লাগে, যারা প্রোডাকশন হাউজ খোলার কথাও ভাবছে। এটাই তো হওয়ার কথা! নতুন কাজ হোক! বাঙালির গর্ব করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু গর্বটা আসবে কোত্থেকে? কিছু তো হতে হবে, তাই না? একটা নতুন গান, একটা নতুন ব্যান্ড, একটা নতুন স্বপ্ন, বসন্তকে যে আসতেই হবে! 

বসন্ত ইজ আ স্টেট অব মাইন্ড। এটা শুধুমাত্র বয়সের ব্যাপার নয়। বসন্তকে বাঁচিয়ে রাখা যায় মনের ভেতর। একটা ছোট্ট আগুন জ্বলতে থাকবে ভেতরে, তবেই না বেঁচে থাকার আনন্দ। দীর্ঘদিনের চলতে থাকা কোনও রীতিকে প্রশ্ন করাই বসন্তের ধর্ম। বসন্ত মানে নিয়ম ভাঙা, বসন্ত মানে নতুন রাস্তায় হাঁটা। ভুল থাকতেই পারে তাতে। ভুল করাটা বসন্তের একটা চরিত্রগত অধিকার। আবার যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে জমে থাকা পশ্চাদমুখী বিশ্বাসগুলোর ভুল ধরিয়ে দেওয়াটাও বসন্তের একটা স্টাইল। 

অনুপম রায় পূর্বজন্মে মুকুল নয়, ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। এখন প্রধান পরিচয় গায়ক। সঙ্গে গীতিকার এবং সুরকারও বটেন। তবে তাঁর সৃষ্টির বিস্তৃতি কেবল সংগীতের দুনিয়ায় থেমে থাকেনি। তিনি সমান দক্ষতায় গদ্য ও পদ্য লিখে যেতে পারেন। ভবিষ্যতে আঁকাআঁকির ইচ্ছেও আছে।

Picture of অনুপম রায়

অনুপম রায়

অনুপম রায় পূর্বজন্মে মুকুল নয়, ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। এখন প্রধান পরিচয় গায়ক। সঙ্গে গীতিকার এবং সুরকারও বটেন। তবে তাঁর সৃষ্টির বিস্তৃতি কেবল সংগীতের দুনিয়ায় থেমে থাকেনি। তিনি সমান দক্ষতায় গদ্য ও পদ্য লিখে যেতে পারেন। ভবিষ্যতে আঁকাআঁকির ইচ্ছেও আছে।
Picture of অনুপম রায়

অনুপম রায়

অনুপম রায় পূর্বজন্মে মুকুল নয়, ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। এখন প্রধান পরিচয় গায়ক। সঙ্গে গীতিকার এবং সুরকারও বটেন। তবে তাঁর সৃষ্টির বিস্তৃতি কেবল সংগীতের দুনিয়ায় থেমে থাকেনি। তিনি সমান দক্ষতায় গদ্য ও পদ্য লিখে যেতে পারেন। ভবিষ্যতে আঁকাআঁকির ইচ্ছেও আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস