ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ মানেই যেন দূরপাল্লার বাঁশির ভোঁ।
সন্ধ্যায় বা রাতের দিকে তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে দ্রুত। পার্ক স্ট্রিট বা বো ব্যারাকে দিনমান কলেজ ক্যান্টিনের আমেজ। সারাদিন ফুর্তি। যেন সকালে উঠেই কোনও বন্ধুর সঙ্গে ওদিকে একবার যাওয়াটা বাধ্যতামূলক। যেমন শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা হোক বা দার্জিলিংয়ের ম্যাল বা মন্দারমণি বা টাকি-যেন মা বাবা বা বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়াই এখন একমাত্র কাজ। (Winter)
আগে কী হয়েছিল জানতে ক্লিক করুন
কী সুন্দর রোদ উঠেছে আজ সকালে। ছোট মেয়েরা দলবেঁধে কোথায় যাচ্ছে যেন। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে একজন আর একজনকে প্রশ্ন করছেন, “কী, ভাল তো?”। উল বুনছেন এক দিদা। বারান্দার রোদে শরীর সেঁকে নিচ্ছেন একটু। কুকুর ছানারাও এ-ওর গায়ে। লুটোপুটি। ওম নিচ্ছে। গাছে জল দিচ্ছেন কেউ। কেউ রাংতা লাগাচ্ছেন রাস্তাজুড়ে। মা মেরি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন সব। সেন্ট পলসের চূড়া পেরিয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। পায়রা উড়ছে দালান জুড়ে। (Winter)
জল কী ভীষণ ঠান্ডা! তবু দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছেন অনেকে! কীভাবে! হালকা চাদরের ভেতর থেকে বেরোতে ইচ্ছা করছে না। বার বি কিউ-এর ব্যবস্থা থাকবে সান্ধ্য পার্টিতে। আমরা হালকা পান করব। রাত হয়ে যাবে। পান করতে করতে ওয়াল্টজ় নাচবে কেউ কেউ। স্যাক্সোফোন বাজবে পার্ক স্ট্রিট জুড়ে। সদর স্ট্রিটের দোকানে বই পড়তে পড়তে অবাক চোখে দেখবে এক সাহেব। তার চামড়া কুঁচকে গেছে। (Winter)
আরও পড়ুন: সুমন মুখোপাধ্যায়ের সাথে ‘আমার থিয়েটারের ভাষা’
এ হেন সাহেব পাড়ার শীত প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল প্রখ্যাত চিত্রকর হিরণ মিত্রের সঙ্গে। এইসব চত্বরে দামাল যৌবনের দিন কাটিয়েছেন তাঁরা অর্থাৎ তিনি ও তাঁর বন্ধুদল মহীনের ঘোড়াগুলি। বললেন, ‘হেঁটে যেতাম সারারাত। আমাদের রাত্রি ভ্রমণ ছিল। তখন মোকাম্বোতে সন্ধায় জ্যাম সেশন হত। একটা ডান্স ফ্লোর ছিল… আমি সেখানে ছবি আঁকতাম… সদর স্ট্রিট ছিল আমাদের সেন্টার… সেখানে চার্চে দীপকদারা বিসর্জনের রিহার্সাল করতেন। সেখানে আমি পুরোপুরি ইনভলভড। (Winter)

তখন পার্ক স্ট্রিটে চায়ের দাম ছিল ১০ টাকা। তখন ১০ টাকায় মাস চলে যেত। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে নরেশদার দোকানে আমাদের একটা বিরাট আড্ডা হত। সেখানে কুমার রায়, দেবতোষ ঘোষরা আসতেন। সত্যজিৎ, মৃণাল সেনদের দেখেছি পার্ক স্ট্রিটে। ঢোলা পায়জামা পরে সত্যজিৎবাবু বই খুঁজতেন… আমাদের আরও সেন্টার ছিল কার্জন পার্ক-গড়ের মাঠেও… সন্ধ্যার পর পার্ক স্ট্রিটের মেজাজ ছিল আলাদা… (Winter)
আরও পড়ুন: হরিদ্বার-হৃষিকেশ-মুসৌরিতে দেড় হপ্তা
মুলাঁ রুজে ডাচ উইন্ড মিল ঘুরত… একটু পয়সা পেলেই আমরা মদ খেতে যাচ্ছি বন্ধুরা। নানা ঠেকে ঢুকে পড়ছি। ট্রিঙ্কাসে, কোয়ালিটিতে বা মোকাম্বোতে ঢুকে পড়ছি। মিস শেফালি তখন পার্ক স্ট্রিটে তুমুল জনপ্রিয়। ৩১ ডিসেম্বর রাতে আমার এক বন্ধু স্পন্সর করল ক্যাবারে শো, দলবেঁধে দেখতে গেলাম। গৌতম নেশায় মত্ত হয়ে বোতল মাটিতে ফেলে ভেঙে দিল। এবারে তার পাশেই চলছে নাচ… আমি সবটা এঁকে যাচ্ছি…’ (Winter)

সদর স্ট্রিটে মহিনের ঘোড়াগুলি গান গাইছে, ‘আমার দক্ষিণ খোলা জানালায়/ মাঘের এই অন্তরঙ্গ দুপুরবেলায়/ না-শোনা গল্প পুরনো মনে পড়ে যায়/ এক দমকা হাওয়ায়…’ রডন স্ট্রিট-রয়েড স্ট্রিট-উড স্ট্রিট-লাউডন স্ট্রিট যেন দার্জিলিংয়ের শ্যাওলাভেজা গলি। গলিতে জীর্ণ পুরনো বাড়ির ছাদে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, চিলছাতের নড়বড়ে তিন- চারখানা ঘরে শেষবিকেলের মরা আলো, জানলা দিয়ে দেখা যায়… নোনা দেওয়াল। তাতে টুনির আলোয় কে যেন জানলার পাশে রেখে গেছে ক্রিসমাস-ট্রি। শুকনো কেক। (Winter)
এ হেন সাহেব পাড়ার শীত প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল প্রখ্যাত চিত্রকর হিরণ মিত্রের সঙ্গে। এইসব চত্বরে দামাল যৌবনের দিন কাটিয়েছেন তাঁরা অর্থাৎ তিনি ও তাঁর বন্ধুদল মহীনের ঘোড়াগুলি।
রোদ চলে গেছে তাও ছাতের আচার সরায় না কেউ। ভূতুড়ে গা-ছমছমে বাড়ি থেকে দেওয়ালে অশ্বত্থগাছ ঝুলবে। আশপাশে বন্ধ কারখানার জানলায় ভাঙা কাচ থাকবে ঝুল জমে। গঙ্গাকল দিয়ে জল অনর্গল বেরিয়ে যাবে। সন্ধ্যা হলে গুমরে উঠবে একরাশ আত্মা এসব বাড়িজুড়ে গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায়। এলিয়ট রোড-রয়েড স্ট্রিট-শেক্সপিয়ার সরণি-রবিনসন স্ট্রিট জুড়ে এমন কত বাড়িতে পাহাড়ি ফুলের মতো একটি মেয়ে থাকবেই চিলছাতে, যার এক প্রেমিকের সঙ্গে কান্নাকাটির একটা প্রেম হবে, তারা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে একবার কেঁদে ফেলবে লং-শটে, চুমু খাবে। তারপর মেয়েটি ছেলেটিকে চোখ মুছতে মুছতে বলবে, ‘আমরা কিন্তু বন্ধু। জাস্ট ফ্রেন্ডস। প্রমিস?’ (Winter)

হিরণদার পার্ক স্ট্রিটের অভিজ্ঞতার সমান্তরাল আরেক পার্ক স্ট্রিটের আখ্যান শোনালেন চিত্র পরিচালক শেখর দাশ। বললেন তাঁর যৌবনের বন্ধু অঞ্জন দত্তর সঙ্গে কিছু স্মৃতির কথা৷ তাঁর কথায়, ‘ভারতের অন্যতম পুরোনো শপিং মল কিন্তু নিউ মার্কেট। তাকে ঘিরে প্রায় বারো-চোদ্দটা সিনেমা হল। সে চিত্রটা আজ অনেকটাই হারিয়ে গেলেও, পার্ক স্ট্রিটের ইথস থেকে গেছে। খুব বদলায়নি এ রাস্তা। কুইন্স ম্যানসানের মতো বিরাট বাড়ি বা জীবনদীপ পেরিয়ে সুবিশাল বাজার-সে সব ভেঙে গেছে। তবু কিছু রেস্তোরাঁ আছে। (Winter)
তরুণ বয়সে ট্রিঙ্কাসে গান শুনতে যেতাম। তখন পুরোনো আমলের গানই হত সেখানে। ডিলান তখন অতটা ঢোকেনি এ পাড়ায়। আমি ৭০-৭১ এর কথা বলছি। তখন রাজনৈতিক কারণে বাইরে ছিল গৌতম (চট্টোপাধ্যায়)। নাহলে এ রাস্তা ওঁর সাথেও একাত্ম হয়ে যায় বারবার। আমাদের জীবনে তখন গান আর গান। ব্লু ফক্সের আগেই ছিল মোলাঁ রুজ। প্যারিসেও আছে এই মোলাঁ রুজ। সেখানে হিন্দি গান হত। ব্লু ফক্স এখন নেই। এসব জায়গায় গানের একটা নিয়মিত চর্চা ছিল। কিন্তু এখনও পার্ক স্ট্রিটের মেজাজটা থেকেই গেছে। কারণ, তার স্থাপত্য হারায়নি, থেকে গেছে। দুটো প্রধান স্তম্ভ এই স্থাপত্যর। একদিকে কুইন্স ম্যানসন, অন্যদিকে পার্ক হোটেল আর আরেকটু এগিয়ে পার্ক ম্যানসনের বাড়িটা। ফরাসি দূতাবাস আজ সেখানে। এককালে এই দূতাবাসেই ফরাসি ভাষা শিখতে যেতাম। (Winter)

এখানে বলা দরকার, আগে কলেজস্ট্রিটেই আমাদের আড্ডা ছিল। সেখান থেকে রাজনৈতিক ডামাডোলে আমরা চলে এসেছিলাম পার্ক স্ট্রিটে। সিনেমা চর্চায় ক্রমশ অবগাহন করছি আমরা। আমি থিয়েটার রোডে চাকরি করতে ঢুকছি… শীত পড়লে রাতে আমরা হইচই করতে বেরিয়ে পড়তাম, আমি, অঞ্জন, আরও অনেকে। অঞ্জন নানা আইডিয়ার কথা বলত অক্লান্তভাবে। ওঁর বাড়িটাই আমাদের সাংস্কৃতিক আখড়া ছিল। আমাদের বন্ধু রবি ওঝা থাকতেন পার্ক লেনে। আমরা ছিলাম ফাদার রোবের্জের ছাত্র। ওরা পরে কেউ কেউ পুনায় পড়তে চলে গেলেন। ফাদার যদিও মনে করতেন, ভারতীয় শিক্ষার চিরায়ত পরম্পরাতেই ছবি তৈরি হবে। ফিল্ম স্কুলে হবে না এই শিক্ষা। সেই কারণেই একটা এফেক্টিভ সংগঠন হিসেবে চিত্রবাণীকে বানান তিনি। আমাদের তখন দিনভর আড্ডা চলত কফি হাউসে। (Winter)
রোদ চলে গেছে তাও ছাতের আচার সরায় না কেউ। ভূতুড়ে গা-ছমছমে বাড়ি থেকে দেওয়ালে অশ্বত্থগাছ ঝুলবে।
দুপুরে একটু খেয়ে নিলাম। সারাদিন তর্ক তারপর। একদম সার্ত্রেদের মতোই আরকি (হাসি)… হ্যারিংটন স্ট্রিটে অফিসের গেস্ট হাউস ছিল। প্রায় সময়েই আমি সেখানে থেকে যেতাম বা অঞ্জনের বাড়িতে থেকে যেতাম। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চলত। মাঝে মাঝে ভুলেই যেতাম আমরা সাহেব না বাঙালি! আমাদের দমদমের পাড়াটাও এয়ারপোর্টের কারণে খুব কসমোপলিটন ছিল। সেটাই আবার পার্ক স্ট্রিটে ফিরে পাচ্ছিলাম। নর্থ ক্যালকাটার লিংক কেটে যাচ্ছিল এভাবেই…’ (Winter)
মিলেনিয়ালদের (নব্বই দশকে জন্মানো প্রজন্ম) পার্ক স্ট্রিট মানেই শুধু ফ্লুরিস-অলিপাব আর মোক্যাম্বো না কিন্তু। আমাদের মধ্যবিত্ত ছোটবেলা জুড়ে আছে পিপিং রেস্তোরাঁ। আছে মিউজিক ওয়ার্ল্ড। দুটোরই এখন আর অস্তিত্ব নেই। আমাদের যৌবনের বিশেষ ডেটগুলো কেটেছে তুলনামূলক সস্তা কিন্তু সম্ভ্রান্ত চিনে রেস্তোরাঁ ‘গোল্ডেন ড্র্যাগন’ আর ‘সিলভার গ্রিল’ বারে। কখনও সখনও ‘স্যামস পাব’-এ। কত প্রেম কত বিচ্ছেদের স্মৃতি এসব রাস্তায়…। আজও এসব রাস্তায় একলা হাঁটলে অবাক হয়ে দেখি আর্মেনিয়ান বাড়িগুলো… কী অপার স্থাপত্যসৌন্দর্য! অথচ কেউ দেখভালের নেই… (Winter)

পার্ক স্ট্রিটের পানশালার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় জানালেন, ‘আমরা পার্ক স্ট্রিট যেতাম না। সময় থাকত না রিহার্সালের পর। ধর্মতলাতেই ম্যাজিস্টিক বারে যেতাম। আমাদের বন্ধু প্রখ্যাত অভিনেতা সুপ্রিয়(দত্ত), বার বন্ধ হওয়ার আগেই ঢুকে বলত, ‘চারটে চারটে করে সবাইকে দিয়ে দাও…'(হাসি) কখনও কখনও ওই রিহার্সালের বাড়িটাতেই নিউ মার্কেট থেকে গ্লাস কিনে এনে বসে পড়তাম… ম্যাজিস্টিকে সবার শেষে আমরা উঠতাম, কর্মচারীরা টেবিলজুড়ে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়তেন প্রায়ই, দরজা ফাঁক রেখে। আমাদের ওটাই মোটামুটি ঠেক ছিল। শ বারে সুপ্রিয় বলত, গ্লাস ধরে বসে থাকতে, নাহলে পাশের লোক আমারটা খেয়ে নেবে(হাসি)… (Winter)
অবশ্যই। টাকা কমে গেলে যেতাম। ওখানে আবার নানা শিল্পীরা ছবি তুলে বা কবিতা পড়ে বলতেন, এর বিনিময়ে আমাদের এক পেগ খাওয়াবেন! কত বিচিত্র যে ব্যপার ঘটত। প্রেস ক্লাবেও যেতাম। সুপ্রিয়র চেনা লোকেরা ছিল।’
দেখতে দেখতে ক্রিসমাস পেরিয়ে এলাম সদ্য আমরা৷ দিনগুলো বড় হয়ে যাবে আবার আর রাতগুলো ছোট। দুনিয়া, এই ভেজাল আর নোংরা দুনিয়া ঘুরে যাবে নিজের নিয়মে। শীত আসবে আবারও নিয়ম করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই তাতে বেঁচে উঠবে, বেজে উঠবে, হালকা পা কাঁপলেও সামলে নেবে ঠিক।
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।