নতুন বছর শুরু হয়ে গেল। বড়দিনের পর থেকেই ঠান্ডা ধীরে ধীরে কমতে থাকে শহরে। যদিও এখন ঠান্ডার আমেজ ভরপুর। ভোর কুয়াশা আর মাঝরাতের লেপমুড়ি বহাল। ভরপুর ইতিউতি পিকনিক। পার্ক স্ট্রিটের সান্ধ্যবারে কাছের বন্ধুর সঙ্গে মদ্যপান লাগাতার। জানুয়ারির শেষ হপ্তার ছুটিতে ক’দিনের পুরুলিয়া বা শান্তিনিকেতনের টিকিটও অনেকেরই কাটা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। (Winter Series)
গড়ে তাপমাত্রা এখনও ২০ থেকে ২২ ডিগ্রি বড়জোর দিনে। জ্যাকেট বা হুডি ছাড়া রাস্তায় বেরনো যাচ্ছে না। পার্ক স্ট্রিটে দুনিয়ার মানুষ এখনও একত্র হচ্ছেন। অক্সফোর্ডে ঢুকতে গিয়েও বেগ পেতে হচ্ছে কখনও কখনও। এত ভিড়! কুয়াশা। খুব দূর দেখা যাচ্ছে না সন্ধায়। ব্লেজার চাপালে ঠান্ডা লাগছে। সিগারেট ধরাব। সস্তায় পান করা যায় কোথায়? হালকা? উল্টোদিকে সিলভার গ্রিল। ঢুকে পড়ব। কোনওরকমে ঠাঁই হবে আমাদের। বন্ধুদের।
ভিড়ে গিজগিজ পানশালা। লাল দেওয়াল। সেকেলে চিনে গন্ধ। মেঝেতে পোড়া পোড়া দাগ। মরচে ধরেছে কেতার দরজার হাতলে। বাইরের ফুটপাতে শীতের টুপি, মাফলার। হরেক পণ্য শীতের। ফ্লুরিজে সপরিবার মানুষ। কত কত আড্ডা।
ভিড়ে গিজগিজ পানশালা। লাল দেওয়াল। সেকেলে চিনে গন্ধ। মেঝেতে পোড়া পোড়া দাগ। মরচে ধরেছে কেতার দরজার হাতলে। বাইরের ফুটপাতে শীতের টুপি, মাফলার। হরেক পণ্য শীতের। ফ্লুরিজে সপরিবার মানুষ। কত কত আড্ডা। কত একার টেবিলও। হয়তো কারও আসার অপেক্ষা। আস্তে আস্তে ওল্ড মঙ্কে চুমুক। শান্ত হব। উষ্ণ হব। হালকা টলে যাবে পা। জিভ জড়াবে। একটু নেশা, এলোমেলো কথা… বেরোতেই ফের ভিড়। মাথার উপর স্টিফেন কোর্টের আলোর ঝালর। দগ্ধ বাড়িটা আজ আবার সেজেছে যেন। নতুন করে। ভেতরে কত কত পরিবার আজও ভিনদেশি। আমরা ফাঁকা রাস্তা খুঁজব। তাই অ্যালেন পার্কের দিকে হাঁটব। ফুড কার্নিভ্যাল চলে এ সময়ে ওখানে৷ বন্ধু বলছিল। বিদেশি ব্যান্ড বাজাবে। কিন্তু বিচ্ছিরি একটা ভিড়ও। সঙ্গে হুল্লোড়।

শীতের দার্জিলিং বাঙালির অতি প্রিয় ডেস্টিনেশন। দার্জিলিং নিয়ে বই লিখেছেন পরিমল ভট্টাচার্য কিছু বছর আগে। বড় মায়াবি সে বই। কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। বলছিলেন, ‘ডিসেম্বরে সেজে ওঠে দার্জিলিং। বড় সুন্দর লাগে এ সময়টা। চার্চের গায়ে টুনি জ্বলে। দোকানগুলো- জিমখানা ক্লাব সেজে ওঠে। সেজে ওঠে ম্যাল চত্বর। আস্তাবল রোড। সোনাদা-ঘুম-জলাপাহাড়ের একাধিক বাড়ির বারান্দায় আলো জ্বলে। অনেক হোটেল যদিও বন্ধ হয়ে যেত। কিছু বাঙালি কর্মচারি ছুটিতে চলে যেত। চকবাজার বা এ-ধরণের অঞ্চল খালি-খালি হয়ে যেত। প্রচণ্ড ঠান্ডায় দার্জিলিংয়ের অনেক মানুষও শিলিগুড়িতে নেমে আসত। ফলে নির্জন হয়ে যেত দার্জিলিং। তবে এসময়ে এলিট ট্যুরিস্টরাই বেশি আসত। সারাদিন সূর্যের তাপ মাথার উপর সেখানে দুর্লভ। তাই এমন মুহূর্ত তৈরি হলেই স্থানীয়রা মেতে ওঠেন এ সময়ে।
ভিড় পেরিয়ে অ্যালেন পার্ক যেন আজ কলেজ ফেস্ট। সুন্দরী কত মেয়ে। গাছের গায়ে সবুজ আলো। সারি সারি খাওয়ার স্টল। টুনি লাইট আর কেক। ক্যারল বাজছে। কিন্তু ভিড়টা ভাল লাগবে না। তাই আমরা হাঁটা দেব জ়েভিয়ার্সের ব্যাক গেটে।
নির্জন রাস্তায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে চেপে বসে- সারাদিন ধরে আকাশের গায়ে কাঞ্চনজংঘা-বেকারিগুলোয় এসময়ে বেশি বেশি করে কেক-পেস্ট্রি সাজানো- তার গন্ধে মন কেমন করে আজও। দোকানগুলো রাংতা দিয়ে সাজানো। সেখানেও আলো জ্বলে। আমার আবার মনে পড়ছে সেসব গন্ধ…’
ফিরে আসি পার্ক স্ট্রিটে। ভিড় পেরিয়ে অ্যালেন পার্ক যেন আজ কলেজ ফেস্ট। সুন্দরী কত মেয়ে। গাছের গায়ে সবুজ আলো। সারি সারি খাওয়ার স্টল। টুনি লাইট আর কেক। ক্যারল বাজছে। কিন্তু ভিড়টা ভাল লাগবে না। তাই আমরা হাঁটা দেব জ়েভিয়ার্সের ব্যাক গেটে। অনেক স্মৃতি এ রাস্তায়। প্রথম গাঁজা টু প্রথম লিপ-লক। ফুটপাথে বসে কত সাড়ে সব্বোনাশ… ভাবতে ভাবতে হাঁটব আমরা ভেতরের রাস্তাগুলোয়। ডিনার করবি? প্রশ্ন করবে বন্ধু। আমি রাজি হব।
একটু খরচ হবে। তা হোক। আজই তো আমাদের ক্রিসমাস… ক’দিন আগেই। ২৫-এ তো এ রাস্তায় পা ফেলা যাবে না! হাঁটব সিরাজের দিকে। ঠান্ডায় মাথা বনবন করবে। কুয়াশায় ভাল দেখা যাবে না কিছুই। সিরাজে ঢুকে একটু আরাম লাগবে। ঘরের উষ্ণতা। তন্দুরের গন্ধ।

কথা হচ্ছিল চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁদের ‘অফিস টাইম’ গানে সরাসরি এসেছে পার্ক স্ট্রিটের কথা। বলছিলেন, পার্ক স্ট্রিটে ছেলেবেলায় বাড়ির সাথে অবশ্যই গিয়েছি, কিন্তু রাস্তাটা চেনা ছিল না। কোনও একটা ক্রিসমাস উদযাপনে গিয়ে মনে হয়েছিল, এ-রাস্তাটা আমার বাড়ির থেকে অনেক দূর। এটা কেবল দূরত্বের হিসেবে বলছি না, কালচারের হিসেবেও সেই দূরত্ব অনেক। পার্ক স্ট্রিট তাই আমার জীবনে আবার যখন ফিরে এল, আমি চিনতে শুরু করলাম রাস্তাটা আমার চাকরি জীবনে। প্রথম চাকরি ছিল যুগান্তর পত্রিকায়… সেখানে ট্রেনি জার্নালিস্ট হিসেবে আমি জয়েন করি… এটা ছিল নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর কাছে… তখন যুগান্তরের বাড়িটা অসমাপ্ত ছিল… বাড়িটার মাথায় একটা বড় গাছ ছিল, যার শেকড় ছড়িয়ে ছিল ছাতজুড়ে… বাড়িটা ভারী অদ্ভুত… পিছনের রাস্তাটা এলিয়ট রোড…
এই মোড়ের বাঁদিকে হেঁটে গেলেই পার্ক স্ট্রিট… আমরাও হেঁটেই চলে যেতাম। আমার প্রথম বস ছিলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী। তাঁর হাত ধরেই আমার প্রথম পার্ক স্ট্রিট চেনা, রাত্রি মাতন, বারে মারামারি দেখা।
সেখানে ট্রামলাইনটা উঁচু, ঢালু পথ পেরিয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিটের দিকে চলে যায়… এই মোড়ের বাঁদিকে হেঁটে গেলেই পার্ক স্ট্রিট… আমরাও হেঁটেই চলে যেতাম। আমার প্রথম বস ছিলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী। তাঁর হাত ধরেই আমার প্রথম পার্ক স্ট্রিট চেনা, রাত্রি মাতন, বারে মারামারি দেখা। দীপঙ্করদাও অদ্ভুত মানুষ! সেই রাস্তায় একটা বার ছিল ‘রেখা’ নামের। মল্লিক বাজার ক্রসিংয়ে আরও কিছু বার ছিল। এলিয়ট রোডের মুখে ছিল ‘গালিব’ বার, সেখানে গজল হত। কোনও বড় কাজ করতে করতে চাপে পড়ে গেলে, আমরা এই বারগুলোয় যেতাম।

‘অফিস টাইম’ গানে যুগান্তর পর্বের এই জীবনটা ধরা আছে। এই যুগান্তরের জীবনটা আমায় অনেক গান দিয়েছে। এখানে কাজ করতে গিয়েই বুঝেছি, চাকরির প্রথম শর্ত তোমায় বিকেল জমা দিতে হবে, বিকেলটা আর তোমার থাকবে না। বন্ধুরা যখন বিকেলে বসে কাউন্টার বদল করছে, আড্ডা মারছে, বিভিন্ন সিনেমা নিয়ে আলোচনা করছে, তখন আমি অফিসে বসে কপি লিখছি… তো, এই বিকেল চলে যাওয়া নিয়েই কিন্তু ‘বন্ধু তোমায় এোগান শোনাব বিকেলবেলা’। ‘অফিস টাইম’ গানটাতেও আসলে আমি আমার প্রেম জীবনের থেকে আস্তে আস্তে আটকা পড়ে যাচ্ছি একটা ব্যস্ততার মধ্যে, যে ব্যস্ততায় যাকে আমার দেখতে পাওয়ার কথা ছিল, তার মুখ আর কোনওদিন দেখতে পাব না… যেখানে ফেরার কথা, যতবার সেখানে পৌঁছতে যাচ্ছি, আমি একটা অন্য জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি… একটা অচেনা দরজায় ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ, যেটা আমার চেনা নয়… যেখান থেকে আর ফেরার রাস্তা নেই, যার কাছে আমার ফেরার কথা ছিল ফেরা হবে না… কিছুটা হোটেল ক্যালিফোর্নিয়ার মতোই, যেখানে ঢোকা যায় কিন্তু বেরনো যায় না…
এই ব্যস্ততা আস্তে আস্তে তোমাকে গিলে নেবে… প্রতিনিয়ত খেয়ে নেবে তোমাকে… আমার একটা জীবন জমা রেখে অন্য একটা জীবনে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হচ্ছি, সেই জীবনটায় পার্ক স্ট্রিটও খুব জরুরি আমার কাছে…
এই ব্যস্ততা আস্তে আস্তে তোমাকে গিলে নেবে… প্রতিনিয়ত খেয়ে নেবে তোমাকে… আমার একটা জীবন জমা রেখে অন্য একটা জীবনে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হচ্ছি, সেই জীবনটায় পার্ক স্ট্রিটও খুব জরুরি আমার কাছে… তার অলিপাব-অকশান হাউস-ফ্লুরিস-সবটা নিয়েই জরুরি… রাত্রে একা হেঁটে যাওয়া অচেনা রাস্তাগুলো নিয়েই জরুরি… এরপর কিছুদিন এসব রাস্তা থেকে দূরে চলে যাই। বরাবর স্বপ্নের রাস্তা হয়েই থেকেছে আমার কাছে… সেই রাস্তায় এখনও ট্রিঙ্কাস আছে। এই ট্রিঙ্কাস যখন আবার খুলল, তখন এক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে চন্দ্রবিন্দুও গান গেয়েছিল, অবশ্যই ছিলেন ঊষা উত্থুপও।
ছবি – লেখকের সংগ্রহ
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।