‘ওয়েলস পূজা কমিটি ‘ একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল ভারতীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে আমাদের আশেপাশের সকালের চেতনা বৃদ্ধি করা| সংগঠনের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনার ভার আমাদের কার্যনির্বাহক কমিটির উপরে থাকে এবং একান্ত প্রয়োজন হলেই ট্রাস্টিরা মধ্যস্থতা ক’রে থাকেন| প্রথম থেকেই সব অনুষ্ঠানে আমরা একটা পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টা করেছি যেখানে উপস্থিত সকলেই, বিশেষ করে যারা প্রথম অনুষ্ঠানে এসেছেন, যেন অনুভব করতে পারেন ‘ এটা আমাদের অনুষ্ঠান’| ‘আপন করে নেয়া’ -র ভাবনাটা আমাদের আদর্শ এবং সেটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি সবসময়ে|

আমাদের পুজোর ইতিহাস : কয়েকটা বছর পুজো না দেখা কার্ডিফের বাঙালিরা ১৯৭৩ সালে চিন্তা করলো ‘ আর পারছি না, পুজো করতেই হ’বে ‘| বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজো কী, এখানে সকলেই সেটা জানেন | কয়েক জনের চেষ্টাতেই শুরু হ’ল ওয়েলস-এ প্রথম দুর্গাপুজো, এক জনের বাড়িতে | পরের বছর সবার সহযোগিতায় বদলে যায় সাম্প্রদায়িক পুজোতে| কিছু পরে সরস্বতী পুজোর শুরু, ধীরে ধীরে যোগ হয়েছে কালী পূজো, দেওয়ালি ইত্যাদি| আমাদের কর্মসূচিতে পুজোগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই, কিন্তু আমরা তার বাইরে অন্যান্য অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে থাকি| যেমন ধরুন নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভারতীয় মেলা, সেমিনার, নানা বিষয়ের উপরে আলোচনা সভা এবং মাটি বা অন্যান্য উপকরণ থেকে দুর্গামূর্তি তৈরী করার প্রকল্প ইত্যাদি| এ ছাড়া স্থানীয় কোনও গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে থাকি |
মা দুর্গার ছবি দিয়ে ওয়েলস-এ প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হ’ল ১৯৭৪ সালে| প্রথমে পাতলা
কাপড়ের উপর এবং পরে কার্ড বোর্ডের উপরে কলকাতার শিল্পীর হাতে আঁকা চালচিত্র সহ মা দুর্গা ও
আর সকলের ছবিতে আমরা পুজো করি ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত| ১৯৮৬ সালে আমাদের এক সদস্য নিজের
হাতে তৈরি করলেন দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গনেশের মূর্তি| ৪ বছর সেই মুর্তিদের আমরা
পুজো করলাম |

১৯৯০ সালে প্রথম মাটির মূর্তি এল, সোজা কুমারটুলি থেকে| সকলের সে যে কি আনন্দ কী করে বোঝাই। ৫ বছর পরে যখন সে মূর্তিগুলোতে ফাটল দেখা দেয়, আবার এল নতুন মূর্তি, ১৯৯৬-এ| তাদের গায়ে
আবার ফাটলের চিহ্ন দেখে ২০০২ সালে ওয়েলস-এ প্রথম এবং যুক্তরাজ্যেও সম্ভবত প্রথম আমরা
দুজন ভাস্কর বা মৃৎশিল্পীকে কলকাতা ও বিষ্ণুপুর থেকে কার্ডিফে এনে মা দুর্গা ও আর সকলের মাটির
মূর্তি তৈরি করার ৪ সপ্তাহের একটা প্রকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি| এর পরে ২০০৯ ও ২০১৬
সালে একই ভাবে দেশের শিল্পীদের এনে মাটি ও কাগজের মন্ড দিয়ে পাঁচটি আলাদা আলাদা মূর্তি তৈরি
করার আরও দুটি পরিকল্পনাকে সফল করতে পেরেছিলাম|

আমাদের পুজো এত কাল পাঁচদিন ধরেই হয়েছে, ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত| কিন্তু এ বছর আমরা প্রথম
তিন দিনের পুজো করছি| ২৬ বছর ধরে যে জায়গায় আমরা পুজো করছি, তারা এই প্রথম পাঁচ দিনের জন্য
জায়গাটা দিতে পারার অক্ষমতা জানিয়েছে এবং আমরা ঠিক মতো কোনও জায়গা খুঁজে পাইনি|
দু ‘এক বারের ব্যতিক্রম ছাড়া, শুরু থেকেই আমাদের পুজো করে এসেছেন আমাদেরই কোনও না কোনও
সদস্যরা, বিনা পারিশ্রমিকে| আমাদের পুজো সাধ্যমত নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গেই করার চেষ্টা করা হয়| প্রথম দিন সন্ধ্যেতে ষষ্ঠীর বোধন থেকে শুরু করে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী প্রত্যেক দিন সকালে এবং সন্ধ্যায় নিষ্ঠা সহকারে আমাদের পুজো, অঞ্জলি, ভোগ ইত্যাদি সবই করা হয়| শেষ দিন সকালে দশমীর পুজো, মায়ের বিদায়, সিঁদুর খেলা ইত্যাদির শেষে পাঁচটি প্রতিমাকে যথারীতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে পরে বছরের জন্য, কাপড় দিয়ে ঢেকে, সংরক্ষণ করে রাখা হয়|

সময় সীমার জন্য এ বার প্রথম আমরা নিয়ম থেকে খানিকটা বিচ্যুত হয়ে যাব| এ বারে হবে ষষ্ঠী ও সপ্তমী প্রথম দিনে, অষ্টমী দ্বিতীয় দিনে এবং নবমী ও দশমী তৃতীয় দিনে| আশা করি মা আমাদের ক্ষমা করবেন| প্রতি দিন দুপুরে পুজোর পরে প্রসাদ আর দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়| রাতে সন্ধ্যারতি, সাধ্যমতো আনন্দানুষ্ঠান ও খাওয়ার ব্যবস্থা একটু বিশেষ ভাবে করার চেষ্টা করা হয়| সমস্ত রান্নাবান্না আমাদের সদস্যরাই মিলেমিশে করেন| বেশির ভাগ বিনোদন পরিবেশন করেন আমাদের সদস্যরা এবং তাদের ছেলেমেয়েরা| কখনও কখনও দেশ থেকে আসা নামী শিল্পীরাও তাদের নাচ,গান, বাদ্যযন্ত্র বা অন্যান্য শিল্পের পরিবেশন করেন |

দুর্গা পুজোকে এখানে বোধহয় ধর্মের অল্প আচ্ছাদনে মোড়া একটা সামাজিক আনন্দানুষ্ঠান হিসেবেই
দেখি আমরা| পুজো আসছে এই আনন্দে আমরা সকালে উত্তাল হই| পুজোর কটা দিন এখানে দারুণ
হইচই, আনন্দ, চেঁচামেচি, আড্ডা ইত্যাদিতে একান্তই মশগুল হয়ে পড়ি সবাই| সকালে মিলে হাতে হাতে
সব কাজ ঠিকঠাক করে ফেলি, ছোটখাটো বাধা বা বিপত্তিগুলো পাশ কাটিয়ে যাই, মনের অমিলগুলো
ক’দিনের জন্য ভুলে যাওয়া হয়| পুজোর এ ক’টা দিন কী করে চালে যায় টের পাই না| শেষ দিনের অনুষ্ঠান
শেষে, আর সব বাঙালিদের মতই, খানিকটা দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরি পরের বছরের দিকে তাকিয়ে থেকে|
গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সকালে বা দুপুরে আমরা ৭০-৮০ টি পরিবার এবং
সন্ধ্যেবেলায় ১০০-১২৫ টি পরিবার আমাদের পুজোতে পেয়েছি| সপ্তাহান্তে পুজো হলে কিছু বেশি লোক
হয়ে থাকে | কোনও বিশেষ বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও বেশি লোক আশা করতে পারি | তিন দিনের পুজো
হওয়াতে এ বছর তার কিছুটা ব্যতিক্রম হয়তো হবে।