বুদ্ধদেব বসু তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ইলিশ’-এ এই মাছটিকে ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, আর সেই কোন প্রাচীন কালেই তো বামুনের দল তাঁদের প্রিয় যে পাঁচটি মাছকে নিরামিষ তকমা দিয়েছিলেন তার মধ্যে প্রথমেই স্থান পেয়েছিল ইলিশ। হাড়ে মজ্জায় ইলিশবিলাসি জাত হিসেবে বাঙ্গালির দুর্নামটা চিরকালের। স্রেফ এক টুকরো সর্ষে ইলিশের লোভে জনৈক বিলেতবাসী বঙ্গসন্তান পাক্কা দেড়শ মাইল গাড়ি

চালিয়ে এসেছে এমন ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। মৎস কূলের এ হেন শাহেনশাকে নিয়ে বত্রিশ পাতার ছোটখাটো একটা বই লিখে ফেলেছেন খাদ্যবিশারদ রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ‘তোমার ইলিশ, আমার ইলিশ’ (প্রকাশক-ইতিকথা) যার প্রকাশ অনুষ্ঠান হয়ে গেল গত ১৪ তারিখ, অবনীন্দ্র সভাঘরে। এই সুযোগে ইলিশ মাছকে ঘিরে বেশ জমজমাট আড্ডায় মেতে উঠলেন উপস্থিত বক্তারা, স্মৃতিচারণ কিংবা ব্যাঙ্গকৌতুক থেকে নিয়ে নানা তথ্যসমৃদ্ধ কথা শুনিয়ে সন্ধ্যেটা দারুণ জমিয়ে দিলেন সবাই। ইলিশ গবেষক দিগেন বর্মণ জানালেন সমুদ্র আর নদীর ইলিশের কোথায় তফাৎ, কেমন করে বাসি-টাটকা চিনতে হয় এবং ফরিদপুরের লোক হয়েও তাঁর অকপট উক্তি ‘পদ্মার ইলিশ মানেই বেশি সুস্বাদু নয়’। একবার ঢাকায় গিয়ে এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশীদের যে রীতিমত চটিয়ে দিয়েছিলেন সে কথাও মুচকি হেসে বলতে ছাড়লেন না তিনি। কলকাতা বিশেষজ্ঞ হরিপদ ভৌমিকের কাছ থেকে জানা গেল বাঙ্গাল আর ঘটি শব্দের উৎস আর ‘মা তুমি আছ’ থেকেই নাকি মাছ শব্দটা এসেছে। এই বইটির মলাট এবং ভিতরের বেশ কিছু স্কেচ করে দিয়েছেন হিরন মিত্র। উনি রসিকতার ছলে জানালেন কিভাবে ইলিশের গন্ধ গোঁফে নিয়ে শুতে যেতেন অর্থাৎ ইলিশের সঙ্গে একটা গোটা রাত কাটানো। মলাটে লাল চোখো রুপোলি ইলিশের গাঢ় নিল জলে খেলা করার ছবিটা দেখে কবি মন্দার মুখোপাধ্যায় বলে উঠলেন এ নদীর রঙ নয়, মাঝসমুদ্রের। মঞ্চে উঠে খাস ঘটি বাড়ির মেয়ে মন্দার প্রথমেই ঘটিত্বের তারতম্যের প্রসঙ্গ টেনে বললেন ব্যারাকপুরের ইলিশ আর কোন্নগরের ইলিশ নিয়েও নাকি দুদলে হামেশাই রেষারেষি চলে। সেদিন প্রবীন ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের উপস্থিতি ছিল কিছুটা অপ্রত্যাশিত, যথারীতি তাঁকে কিছু বলার অনুরোধ এলো এবং কিঞ্চিৎ খেদ নিয়ে তিনি বললেন ইলিশ সম্পর্কে পড়া আর খাওয়া এক জিনিস নয়, তাছাড়া এখন তাঁর খাওয়ার কোটাও ফুরিয়ে এসেছে। অমন সুস্বাদু ইলিশকেও যে কতখানি পচিয়ে খাওয়া যায় দামু মুখোপাধ্যায় বেশ রসিয়ে শোনালেন সে গল্প। রজতেন্দ্র বইতে লিখেছেন ‘আসলে পদ্মার মাছটা তোমার বা গঙ্গার মাছটা আমার এমন ছোটলোকি চিন্তা আগেকার মানুষদের মনে ছিলনা, রান্না হওয়া ইলিশের পাগল করা গন্ধটাও আর মধ্যবিত্ত দিনযাপনের সঙ্গে তেমন মিশে নেই। হারিয়ে গেছেন বসন্ত চৌধুরীর মত অভিজাত মানুষ যিনি ইলিশের গাদার বড় একখানি পিস মুখে পুরে খানিকক্ষণ চিবিয়ে তার চুলের মতো সমস্ত কাঁটাগুলি একসঙ্গে মুখ থেকে বার করে দিতে পারতেন অনায়াসে। আপাদমস্তক ভোজনরসিক রজতেন্দ্র সবশেষে মাইক হাতে নিয়ে কবুল করলেন তিনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সুযোগ্য চেলা, ইলিশমাছ খেতে বসে কখন যে থামতে হয় সেটা কস্মিনকালে শেখেননি আর যতই খাবারের পরিমাণ বাড়তে থাকে তাঁর লেখার আইডিয়াগুলোও হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রায় ম্যাজিকের মত। বোঝা যায় ইলিশ মাছের সঙ্গে রজতেন্দ্রর রোম্যান্স শেষ হবেনা কোনওদিন।
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
2 Responses
লেখক যে দুর্দান্ত সাংবাদিক তা এই লেখা পড়ে আবারো টের পাওয়া গেলো।
দেবাশীষদাকেও উদ্যোক্তাদের সবিশেষ অনুরোধে মঞ্চে উঠতে হয় এবং তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্যের বক্তব্যটিও ছিল চমৎকার হাস্যরসে ভরা। এখানে নিজের নামটি তিনি যে সযত্নে বাদ দেবেন– সে তো জানা কথা। কিন্তু এটা উল্লেখ না করলে ঘোরতর অন্যায় হবে।