“…শুধুই তোমার সঙ্গে কথা বলি অজানা ভাষায়
কেননা তুমিই বুঝি হতে পারো একমাত্র আমার স্বদেশ
আমার বসন্ত, টুকরো খড়কুটোর বাসা, বৃষ্টিপাত বৃক্ষশাখে”
ক্রমাগত ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বিয়াসকে পাশে রেখেই আমাদের গাড়িটা এগিয়ে চলেছে উপরের উপত্যকার দিকে। একটু ঝুঁকে নুড়িপাথরের ওপর বৃষ্টির জল পড়া দেখতে দেখতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইতে পড়া পিলিপ জাকোতের কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ল।
একটা লোহার সাঁকোর ওপর গাড়িটা উঠতেই বিয়াসকে নীচে রেখে আমরা ওপরের দিকে উঠতে থাকলাম। উপরের থেকে নীচের দিকে ঝুঁকলে মাথার ভেতর কীরকম একটা অস্বস্তি হয়, তাই ওপরের পাহাড়গুলোই দেখতে লাগলাম। এখানে যে আর একটা নদী এসে মিশেছে বিয়াসের সাথে, তার নাম পার্বতী। আমরা পার্বতী উপত্যকার দিকেই যাচ্ছি। যত উপরে উঠছি পার্বতী পাহাড়ের ওপরে একেবারে নবীন থেকে নবীনতর রূপে যেন ধরা দিচ্ছে। এত উচ্ছল তার বেগ। পাহাড়িপথে নদীর এই প্রগলভতা স্বাভাবিক।

পাইনের জঙ্গল দিয়ে পাহাড়ির হাওয়ার মধ্যে মিশে রয়েছে পার্বতীর ছোটো ছোটো ঢেউ-এর মৃদুমন্দ গর্জন। আর এই গর্জন শুনতে শুনতেই এসে পৌঁছলাম কসৌলে। পাহাড়ে ওঠার সময় বেশ শরীরখারাপ লাগে আমার। অথচ পাহাড়ে উঠে এলে কোন যাদুবলে যে চাঙ্গা হয়ে যাই তা নিজের কাছেই রহস্য মনে হয়। কত কত বছরধরে পাইন দেবদারু আর সিডারের বনে যে রহস্য লুকিয়ে আছে তার কিছু কিছু মানবজীবনেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নিশ্চয়ই। আর এই রহস্যগুলোই সৃষ্টির টিকে থাকার মূল মন্ত্র।
একটু ফ্রেশ হয়েই আমরা কসৌল পরিদর্শনে বের হলাম। হোটেলের সামনেই আর একটা লোহার সাঁকো। নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পার্বতী নদী। এইরকম একটা সাঁকো যেকোনো শহুরে পথক্লান্ত মনই বারবার পেরোতে চাইবে। আমরাও তাই সাঁকোর পথ ধরেই পৌঁছালাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে।

যে কোনও শহরের প্রাণকেন্দ্রেই বাস ও ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ড। সেখানে গিয়ে জানলাম, এখুনি যদি বেরিয়ে পড়ি তাহলে তোষগ্রামটি ঘুরে আসা যাবে। এই গ্রাম থেকে বরফে মোড়া তোষ পাহাড় দেখা যাবে। কাল রাতেও বরফ পড়েছে তোষপাহাড়ে। হিমাচলী যুবকের উচ্চারণে ‘তোষ’ নামটা এত মধুর সুরে কানে এসে বাজল যে তখুনি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুধু ব্রেকফাস্টের জন্য আধ ঘণ্টা সময় চেয়ে নিলাম।
ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডে আসার পথে একটা রেস্তরাঁয় দেখেছিলাম অনেকগুলো খাবারের নামের সাথে ট্র্যাডিশনাল ব্রেকফাস্ট কথাটা লেখা ছিল। ট্র্যাডিশনাল ব্রেকফাস্ট বিষয়ে জানতে ও নিজেদের ভেতরের জানান দেওয়া প্রচণ্ড খিদে দুইয়ের নিবৃত্তিকরণের উদ্দেশ্য ওই রেস্তরাঁতেই গেলাম।
ট্র্যাডিশনাল শব্দটায় আস্থা রেখে ভুল করিনি। নতুন কিছু যে জানতে পারব, তা বুঝলাম রেস্তরাঁর অন্দরশয্যা দেখে। পুরো ডাইনিং হলটি ছোটো ছোটো চৌকোখোপে বিভক্ত। আর প্রতিটা খোপে এক একটা খাওয়ার জায়গা। জুতো খুলে বসতে হল নরম গালিচার ওপর। হেলান দেওয়ার জন্য আছে তাকিয়া আর ছোটো ছোটো পাশবালিশ। গালিচার ওপর পাতা খুব সুন্দর ছোট্ট টেবলের ওপর খাওয়ার সার্ভ করা হল। মনে হল কাশ্মীরি রীতি যেন। কিন্তু জানতে পারলাম, কসৌল দীর্ঘদিন ধরে ইজরায়েলিরা বসবাস করছে। ঠিক কবে ওরা এখানে এসেছে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পেলাম না। বর্তমানে মালানা বলে একটি জায়গা আছে যাকে স্থানীয়রা নিষিদ্ধ স্থান বলেন, সেখানেই ওদের বাস। আর ওদের ভাষা এখন হিমাচলী মিশ্রিত হিন্দি। এই সাজশয্যা সবই ইজারায়রেলি রীতিতে। হিমাচলী ইজরায়েলিদের সম্বন্ধে আরও কত কি জানার ইচ্ছে রইল। কিন্তু সঙ্গীদের তাড়ায় দ্রুত গরম আলুরপরোটাগুলো ঠান্ডা দইয়ে ডুবিয়ে কোনওমতে সে যাত্রায় গরম খাবার অতিদ্রুত গলাধঃকরণ করে তোষপাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

সেরেন ও ভার্জিন শব্দদুটো ইংরাজি হলেও বাংলায় ব্যবহার করেন অনেকেই। বিশেষত ভার্জিন শব্দটা। তবে এই শব্দের সাথে কুমারীত্বকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। যদিও সেই অর্থেই ব্যবহৃত। মূলত নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ একটা সৌন্দর্য বোঝাতেই এই শব্দটার ব্যবহার। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ পাহাড়েই এখন আর নিস্তব্ধতা নেই। কিন্তু তোষ পাহাড়ের পথে এক অপূর্ব নির্জন নিস্তব্ধতায় আমরা সকলেই মগ্ন শ্রোতা অথবা দর্শক হয়ে বসেছিলাম। নাম না জানা পাখির শিস আর নদীর ঢেউয়ের শব্দ এক সাথে মিশে যেতে থাকল। একটা নতুন ধ্বনি মনে হল। বেশকিছুক্ষণের জন্য আমরা সবাই স্তব্ধই ছিলাম। এমনকি আমার সদ্য এগারোয় পা দেওয়া পুত্রটিও একটাও কথা না বলে চুপ করে নিজের মধ্যে ভরে নিচ্ছিল পথের এই অদ্ভুত সুন্দর ধ্বনি।
-ইঁয়াহ্যা সে ক্ষীরগঙ্গা ট্রেক শুরু হতি হ্যায়।
চালকের কথায় ঘুম ভাঙার মতো নিস্তব্ধতা ভেঙে আমরা সচকিত হয়ে উঠলাম।
-ইসে বারষিণী ক্যাহতে হ্যায়।
-এখান থেকেই ক্ষীরগঙ্গা ট্রেকিং-এর রাস্তা?
আমি বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম।
-জি ম্যাডাম, লওটনে কে ওকত রুক যায়েঙ্গে। ফোটো লেনা।
পথে একটা বহুপ্রাচীন দুর্গামন্দির পড়েছিল সেটাও ফেরার পথে দেখবো জানিয়ে গাড়ি থামায় নি। কিন্তু এইবার গাড়িটা একটু থামাতে বললাম। পার্বতী নদীর গা বেয়ে একটা ঢালুপথ। সেই পথ ধরে উঁচুতে উঠতে উঠতে ক্ষীরগঙ্গা। সে পথেই চলেছে কত তরুণ তরুণী, কাঁধে র্যাকসাক, চোখেমুখে উজ্জ্বল আনন্দ, কৌতুহল।
-ইয়েজওয়ানি দিওয়ানি ফিল্ম কা শ্যুটিং ভি ইয়াহা পে হুয়া থা।
জওয়ানির দিওয়ানি তো চোখেই দেখতে পেলাম। মন জুড়িয়ে গেল। আহা, কবে যে এইভাবে পথকষ্ট ও পিছুটান উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়তে পারব? গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে পাহাড় নদী দেখতে দেখতেই কেটে গেল গোটা জীবন। এত ঘুরলাম তবুও ভ্রমণ হল না আজও!

আমাদের গাড়ি ক্ষীরগঙ্গার উল্টোদিকের পাহাড়ি পথ ধরে এগোতে থাকল। দূরত্ব খুব বেশি নয় তবুও রাস্তা এখানে বেশ কাঁচা, এবড়োখেবড়ো, অসমতল। কিছুদূর গিয়ে তোষ আর পার্বতীর মিলনস্থল দেখলাম। দুটো নদী একসাথে মিশেছে আর তার পাশ দিয়ে পাহাড়ি চড়াই। ওটাই ক্ষীরগঙ্গার পথ। বারবার মন টানছিল সেদিকে।
অবশেষে এসে পৌঁছালাম তোষ। ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস ঘিরে ধরল আমাদের। তোষ পাহাড়ে কালও বরফ পড়েছে তাই ঠান্ডাটা এখানে বেশি। জ্যাকেট, ওভারকোট, মাফলার ইত্যাদিতে নিজেদের যথাসম্ভব মুড়ে ঠান্ডা বাতাস কেটে কেটে কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে উপরের দিকে উঠতে থাকলাম। ঘড়িতে সময় দুটো। ঘরে ফিরে আসছে তোষগ্রামের বাসিন্দারা। বেশিরভাগের মাথায় গাছেরডালের শুকনো আঁটি। জ্বালানির কারণে নিশ্চয়ই। কেউ আবার গরু মোষ, ভেড়াদেরও ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা ঘোড়া ও পাহাড়ি খচ্চর দেখলাম পথের মধ্যে। জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে যাওয়ার জন্যও বেশ কয়েকটা লড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামের মুখে। ভারি ভারি গাছের গুড়ি, লগি লোডিং হচ্ছে লড়িগুলোতে। এই দৃশ্যটি দেখে অবশ্য মনখারাপ হয়ে গেল। সভ্যতার নিঃশ্বাস সর্বত্র। তাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় কোথায়?
মধ্যে মধ্যে দুধারে আপেলের ক্ষেত। আর দূরে বরফের আস্তরণে ঘুমিয়ে আছে তোষপাহাড়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছালাম। একটা কাফে দেখতে পেলাম। ৩৬০ ডিগ্রি নামে এই কাফের ভিতর থেকে আরও সুন্দর ও অনেকটা কাছ থেকে বরফ চূড়া দেখলাম। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ আর তার মাথায় তুষারের শিরস্ত্রাণ সরল অভ্যর্থনায় মুগ্ধ করে দেয় জটিল ক্লান্ত শহুরে মনগুলো।
একই ইজরায়েলি রীতির রেস্তরাঁয় বসে গরম ধোঁয়া ওঠা মোমোর প্লেট টেবিলে দেখে মনে পড়ল সকালে জলখাবারের পর আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পরিবেশন করছিল একটি বাঙালি মেয়ে ও বাঙালি ছেলে। ঘুরতে এসে এখানের আকর্ষণে রয়ে গেছে জানাল ওরা। ওদের গল্প শোনার ইচ্ছে হল খুবই। তবুও একজীবনে কতটুকুই বা গল্প জানা যায়। তাই জানা হল না কিসের টানে ঘর ছেড়ে দুই বাঙালি যুবক যুবতী এই এতদূরে পাহাড়ের মধ্যে এসে রয়েছে? ওরা কি তাহলে সফল হয়েছে? পাহাড়ের বুকে ওরা কি সত্যিই খুঁজে পেয়েছে ওদের ছোট্ট গ্রামখানি?
ছবি ঋণঃ ইন্দ্রনীল মুৎসুদ্দি
রিমি দিল্লিনিবাসী, অর্থনীতির শিক্ষক। খবরের কাগজে ফ্রিলান্স সাংবাদিকতা ছাড়াও লেখেন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। তাঁর প্রকাশিত বই দুটি। ‘মিথ্যে ছিল না সবটা নামে কবিতা সংকলন ও দময়ন্তীর জার্নাল নামে গল্প সংকলন। ভালবাসেন এরোপ্লেনের ডানায় ভেসে থাকা মেঘ আর সেই উথালপাতাল ঢেউ ও চাপচাপ কুয়াশায় খুঁজে পাওয়া নতুন কোনও ক্যানভাস।
One Response
খুব ভাল লাগল। তোষগ্রাম ঘুরে এলাম।