জার্মান কবি কার্ল মিকেল-এর কবিতা
১৯৩৫ সালে ড্রেসডেনে জন্মগ্রহণ করেন এই কবি (Karl Mickel)। যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে তিনি জার্মানিতেই কাটান। যুদ্ধের পর পূর্ব জার্মানিতে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮তে তিনি একটি পত্রিকার অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়ের সম্পাদক হন। ১৯৫৯ থেকে ৬৩ পর্যন্ত তিনি একটি শিল্প সংক্রান্ত পত্রিকার সম্পাদনা করেন। হিটলার জমানার ফ্যাসিবাদের পর তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সোভিয়েত শাসিত পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট শাসনও। পূর্ব জার্মানিতে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরেই তিনি সেই সময়কার শাসকদের কুনজরে পড়েন। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় পশ্চিম জার্মানিতে। হিটলার শাসনের সময়কার জার্মানির চেয়েও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পূর্ব জার্মানির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়েই তিনি লিখে গেছেন, দুটি দেশেই। তাঁর কবিতা নিয়ে পশ্চিম জার্মানির কবিরা ছিলেন উল্লসিত। বার্লিন দেওয়াল ভাঙার পর জার্মানিতে তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।
তাঁর কবিতার মধ্যে সমসাময়িক অ্যান্টিপোয়েট্রির ছায়া পাওয়া যায়। ২০০০ সালের ২০ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।

কান্না
এখনো আকাশের থেকে অনেকটা দূরত্ব আমাদের
মাথার উপরে কোনও ছাদ নেই
বিষবাষ্প মনের ভিতর
তোমাকেও আচ্ছন্ন করে আছে
এখনো
এখনো
রক্তপাত ভীষণ চোখে
ঘাম
এ কোন শীতের মরশুম শুরু হল, কিছুই বুঝতে পারছি না
কেন গাড়িগুলোর বনেট নেই আর
কেন মানুষের মুখগুলো জ্বলন্ত মশালের মতো
আমাদের নাকি গাছের মতো উদাসীন হওয়ার কথা ছিল
আমাদের নাকি
জলের মতো ভেসে যাওয়ার কথা ছিল আগুনে
কিন্তু বন্ধু
তোমার কপাল ছুঁয়ে যে মৃত্যু ভেসে চলে গেছে
তার নাম
দেশ
তাকে তুমি এড়িয়ে থাকতে পারছ না
পাথর এবং হৃদয়
হায়, কী নিপুণভাবে নৈঃশব্দ রচনা করল ওরা
প্রচুর শব্দের ভিতর
আমরা দেখলাম শববহনকারী
কিছু কফিন
আমাদের ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে
ওদের ভয় করছে না
ধ্বংস
আলতো করে, যেভাবে মৃতদেহ নামানো হয় মাটির ভিতর
ঠিক সেভাবে
এই ফুল তুলে ফেলো
এ পৃথিবী ফুলের যোগ্য নয়

জার্মান নারী ১৯৪৬
হয়তো এটা মজার বা একদমই মজার নয়
আমার মন বলল, সে ছিল উপযুক্ত একজন পুরুষ
জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সে গাছেদের সঙ্গে কথা বলত,—
কিন্তু সেগুলো কথা ছিল না, ছিল হুমকি
বলত, ‘আমি তোমাদের কেটে কেটে আসবাব বানিয়ে ছাড়ব’
ও ছিল একজন কাঠের মিস্ত্রী, কমিউনিস্ট, বেকার।
বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত একটা রান্নাঘরের মধ্যে
তুমি যদি একটু সুন্দর নারী হও, তাহলেই তাকে আর থামাবে কার সাধ্য
যখন সে আমাকে নিতে এসেছিল, তখন মালকিন এমনই বলেছিলেন
তার পর হিটলার, মালকিন বললেন, হিটলার শব্দের মানেই হল যুদ্ধ
এখানেও কোনও শিশুর অস্তিত্ব ছিল না, হত্যা করার জন্য
আমার কোনও শিশুর দরকার ছিল না, মালকিনের একটি মেয়ে ছিল।
তার পর যুদ্ধ শুরু হল। এ এক অন্য যুদ্ধ
রাশিয়ায় যুদ্ধবন্দীদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, নতুন ভাবে শিক্ষা দেওয়া
গাছগুলো কাটতে কাটতে যখন বনসাই হয়ে গেছে
কেউ কেউ চেয়ার, টেবল, খাট
তখন কেউ বলল, গাছে পাতা নেই, আমাদের কেউ চুমু খায় না।
ভাঙা বাড়ি
তুমি ইতিহাসের কথা বললে, আমি দেখলাম একটি খসে পড়া স্তম্ভ
হুমকির সুরে কথা বলতে বলতে যেন ঝড় স্থির হয়ে গেছে
দেওয়ালে গুলির দাগ, সমাধির উপরে পচা ফুল
যেন গোধূলির রঙ তোমার মুখের উপর এসে পড়েছে
আমরা কেউ দরজা পেরিয়ে মাঠে নামতে পারি না
এর দায় তোমার নয়, এই দ্যাখো পেট ফুলে গেছে তিমি মাছের
আকাশ থেকে খসে পড়ছে পাখি, যারা একদিন ধূসর ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল
সাঁজোয়া গাড়ির মতো মন নিয়ে আমাদের দিন শুরু হয়

ইস্তেহার
কারা যেন এসে বলে গেল এর পর থেকে রুটি সেঁকা যাবে না
কারা যেন বলে গেল সিঁড়ি দিয়ে নামা যাবে না
কেউ কেউ বলল গান গাইলেই গলা কেটে নেওয়া হবে
আর কেউ কেউ কিছুই বলল না
জন্ম নিলেই মেরে ফেলা হবে বলতে বলতে
তারা নিজেদের মা বাবাকেও হত্যা করল প্রথমে
প্রতিবাদ
আমরা কথা বলতে চেয়েছিলাম
বলতে চেয়েছিলাম, এভাবে নয়, অন্যভাবে ভাবতে হবে
মাটির ভিতর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে
রাজসিংহাসনে বসানো যাবে না
আমরা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলাম দেওয়াল
আর আমাদের মিথ্যে প্রমাণ করে
একটা বিশাল ট্যাঙ্ক ঢুকে গেল আমাদের ঘরের ভিতর
যেখানে
কিছুই নেই, শুধু কিছু কবিতার খাতা পড়ে আছে
ড্রাগন
আমাদের দেওয়ালগুলো আমাদের তৈরি করা নয়
যদি তৈরি করা হত, কবে সেই দেওয়াল ভেঙে পড়ে যেত
পঞ্চাশ বছর ধরে একটি ড্রাগন আছে আমাদের মধ্যে
এত লোভ, এত জিভ
লকলকে খুনি এক, আমাদের মধ্যে
এসেছে বন্দুকবেশে, এসেছে আদর করে, চেনে বেঁধে নিতে
তাকে যতই আদর করবে, তুমি হয়ে উঠবে তার পোষা চাকুরিজীবী
আবহসঙ্গীত বাজবে,
যেন হত্যার আগের রাতে
স্বাধীনতার বিউগল।

ভালবাসার স্মৃতিস্তম্ভ
এইখানে সমাধি ছিল, আলোর মধ্যে, ছায়ার মধ্যে
ঘোড়ার গায়ের গন্ধের মতো
ভালবাসা ছিল
তোমার চোখের মধ্যে যেদিন বেয়নেট ঢুকে গেল
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম
আমি প্রতিশোধ নেব
আজ দেখো, কেমন প্রার্থনা করছি
আর সৈন্যরা এসে
আমার বুকে এঁকে দিয়ে যাচ্ছে
ক্রুশ
আমরা ভাল আছি
আকাশের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো
আমরা ভাল আছি
আলো আসছে
অন্ধকার আসছে
বৃষ্টি আসছে
এমনকি বোমাও
যুদ্ধবিমানও
সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে
এই তো বেঁচে আছ তুমি
আমিও
একবুক মৃত গন্ধ টেনে নিতে নিতে
বলছি
আমার পরিচয় দাও
আমার আয়না দাও
আমার ভালবাসা দাও
আমার দেশ দাও
আমরা ভাল আছি
এখনও
কাঁদতে পারছি তোমার জন্য

স্বীকারোক্তি
এত কিছু সহ্য করার ক্ষমতা কোথা থেকে আসে মানুষের?
খিদে ও যৌনতা থেকে?
ভালবাসা থেকে?
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে?
আশা থেকে?
স্বপ্ন থেকে?
এত কিছু মেনে নেওয়ার ক্ষমতা কোথা থেকে আসে মানুষের?
সমাধির দিকে তাকাতে তাকাতে
এক পাগল প্রশ্ন করেছিল।
আমি শুনেছিলাম মাত্র। আর কিছু করিনি, বিশ্বাস করুন কমরেড!
দেশ
আমাদের কথা বলতে দিন
আমরা বোবা নই
আমরা পাথর নই
আমাদের মৃতদেহেরও ইচ্ছা আছে
আমাদের গান গাইতে দিন
আমরা বন্দুক নই
তোমাদের আঙুলের অপেক্ষায়
আমার ট্রিগার
না খেয়ে মরে যাবে না
কফিন
হায় মৃতদেহ, তুমি হাঙরের খাদ্য হতে পারতে
তুমি হতে পারতে সিংহের প্রথম কামড়ে ক্ষতবিক্ষত
তুমি হাতির পায়ের নীচে থেঁতলে যাওয়া দেহ হতে পারতে
হতে পারতে তারা খসে পড়া জ্বলন্ত আগুনে ছাই
কিন্তু আজ
তুমি ভয় পেয়ে আছ এমনকী মৃত্যুর পরেও
মৃত্যুর পরেও তোমাকে
জাগিয়ে তুলে আবার হত্যা করতে পারে ওরা
কারণ তুমি ইহুদি
আমার প্রিয় ডয়েশল্যান্ড
ঘনঘন রাস্তা পরিবর্তন করতে করতে
বাতাস বলেছে আর ঝরা পাতা হব না এখানে
আমাদের বরফ গলবে না আর
বরফের ভিতর থেকে
একদিন উঠে আসবে
কিছু বুলেটের টুকরো, কিছু ভাঙা বাড়ি আর মানুষের হাড়
এইখানে একদিন মানবসভ্যতা ছিল
বলতে বলতে
মানুষের উত্তরপুরুষ ছুঁড়ে দেবে ঘৃণা
সূর্য উঠবে না এই দেশে
নক্ষত্র উঠবে না এই দেশে
চাঁদ উঠবে না এই দেশে
শুধু কিছু বিমানবাহিনি ছুটে যাবে
তথ্যসূত্র—
১) জার্মান পোয়েট্রি ১৯১০-১৯৭৫ (সম্পা- মাইকেল হ্যামবার্গার)
২) https://www.goodreads.com/author/show/1045397.Karl_Mickel
৩) https://www.jstor.org/stable/487696?seq=1
৪) https://www.goethe.de/ins/in/lp/prj/ptp/mag/en14937144.htm
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wallpaper flare, Pexels, Pixabay,
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
2 Responses
কত যুগ আগের লেখা আজও কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক! অনুবাদ স্বচ্ছ। মূল কবিতার রসকে ধরে রাখতে পেরেছে বলেই প্রতিভাত হয়।
সত্যিই অসাধারণ। এ যেন অনুবাদ নয়, ভিতর থেকে ছেঁকে তোলা শব্দযান। চলতে চলতে কোথাও হোঁচট খাইনি।