(Kate Chopin)
সবাই জানত যে মিসেস ম্যালার্ডের হার্টের সমস্যা রয়েছে, তাই স্বামীর মৃত্যুর সম্ভাব্য খবরটা খুব সাবধানেই ওঁকে জানানো হয়েছিল। (Kate Chopin)

ওর বোন জোসেফিন-ই জানায়। থেমে থেমে, ভাঙা ভাঙা কয়েকটা বাক্যে। আভাসে-ইঙ্গিতে। অর্ধেক লুকোনোর চেষ্টাতেই সে সবটা বলে দেয়। ওঁর স্বামীর বন্ধু রিচার্ডসও ছিল সঙ্গে। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট-এর খবরটা যখন খবরের কাগজের অফিসে পৌঁছায় রিচার্ডস তখন সেখানেই। মৃতদের লিস্টের একেবারে উপরেই ছিল ব্রেন্টলি ম্যালার্ডের নাম। দ্বিতীয় একটা টেলিগ্রাম আসতে যতটুকু সময় লাগে ততক্ষণই অপেক্ষা করেছিল ও। খবরটা যাচাই করার জন্য। আর তারপর-ই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ছুটে এসেছিল। বলা যায় না, যদি অন্য কেউ খবরটা আগে পৌঁছে দেয়! এমন কেউ যে ওর মতো সাবধানী নয়, যে ওর মতো এত আলতো করে জানাতে পারবে না! (Kate Chopin)
অন্য কোনও মহিলা হলে যেভাবে শুনত- অসাড় মনে, কী হয়েছে সেটা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে- তেমন করে উনি শোনেননি ঘটনাটা। হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন, বোনের গলা জড়িয়ে। যন্ত্রণার ঝড়টা কিছুটা শান্ত হলে, নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। একা থাকতে চেয়েছিলেন। (Kate Chopin)
খোলা জানলাটার মুখোমুখি একটা বেশ বড়সড় হাতলওয়ালা চেয়ার। বেশ আরামের। তাতে শরীরটা এলিয়ে দিলেন উনি। (Kate Chopin)
সারা শরীর জুড়ে যে ক্লান্তি, তা যেন মনকেও ছুঁয়ে ফেলেছে।
বাড়ির সামনের খোলা চত্বরটার ওপারে গাছের মাথাগুলো নতুন বসন্তের ছোঁয়ায় দুলছে। হাওয়ায় বৃষ্টির চনমনে গন্ধ। নিচের রাস্তাটায়, একজন ফেরিওয়ালার ডাক। দূরে কেউ একজন গাইছে। অস্পষ্ট ভেসে আসছে সুর। ছাদের কার্নিশে অনেকগুলো চড়ুই কিচিরমিচির করেই চলেছে। জানলাটা পশ্চিম মুখো। (Kate Chopin)
একসাথে জড়ো হওয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশের ঝলক।
চেয়ারের কুশানে মাথা হেলিয়ে উনি স্থির বসেছিলেন। শুধু গলা দিয়ে কান্নার এক একটা দমক উঠে এসে ওঁর শরীরটাকে মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। যেন একটা বাচ্চা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর স্বপ্নের মধ্যে মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠছে। (Kate Chopin)

ওঁর বয়স অল্পই। মুখটা ফর্সা, শান্ত। মুখের রেখাগুলো দেখলে বোঝা যায়, কী যেন একটা চেপে রেখেছেন ভেতরে, এমনকি একটা জোরের আভাসও পাওয়া যায়। (Kate Chopin)
কিন্তু এখন দৃষ্টিটা নিস্তেজ, অনেক দূরের ওই টুকরো নীলগুলোর কোনও একটায় যেন হারিয়ে গেছে।
এই দৃষ্টিতে কোনও গভীর চিন্তা নেই। বরং ভাবনাগুলো কোথাও যেন একটা থমকে রয়েছে।
কিছু একটা এগিয়ে আসছে ওঁর দিকে, আর উনি যেন সেটার জন্যই অপেক্ষা করছেন, ভয়ে ভয়ে। কী সেটা? জানেন না উনি।
“আমার শরীর মুক্ত, মন মুক্ত’, ফিসফিস করে বলে যাচ্ছিলেন উনি।”
খুব সূক্ষ্ম, ধরাছোঁয়ার বাইরের কিছু। যার কোনও নাম নেই। কিন্তু তা যে আছে, উনি টের পাচ্ছেন। আকাশ পেরিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ওঁর দিকে। যে শব্দ, গন্ধ আর রঙে বাতাস ভরে আছে সেগুলোয় ভর করে এগিয়ে আসছে ওটা। (Kate Chopin)
ওঁর বুকটা এখন খুব তাড়াতাড়ি উঠছে আর নামছে। যা ওঁকে দখল করার জন্য এগিয়ে আসছে, তা চিনতে শুরু করছেন উনি। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সেটাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর সেটা ওঁর দুটি সাদা, সরু হাতের মতোই অক্ষম। শেষে যখন উনি নিজেকে ছেড়ে দিলেন, অল্প ফাঁক হয়ে থাকা দু’টো ঠোঁটের মধ্য দিয়ে একটা ফিসফিসানো শব্দ বেরিয়ে এল। বার বার অস্ফুটে শব্দটা উচ্চারণ করতে লাগলেন: ‘মুক্ত-মুক্ত- মুক্ত!’ (Kate Chopin)
প্রথমে যে শূন্য দৃষ্টি আর পরে ভয়ের ছাপ ওঁর দু’চোখে ফুটে উঠেছিল সেগুলো মিলিয়ে গেল। চোখ দু’টো এখন ব্যগ্র, ঝকঝকে। নাড়ি চলছে দ্রুত, ধমনী, শিরায় বয়ে চলা রক্ত ওঁর শরীরের কোনায় কোনায় পৌঁছে দিচ্ছে উষ্ণতা, প্রশান্তি। যে খুশি ওঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তা বিকট, অস্বাভাবিক কী না এই প্রশ্ন ওঁর মনে একবারের জন্যও এল না। হঠাৎ করেই যেন সবকিছু একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। যেন এই তুচ্ছ প্রশ্নটার কোনও মানেই নেই। (Kate Chopin)
উনি জানেন, যখন ওই কোমল, দয়ালু হাত দু’টোকে মৃত্যুতে স্থির, জড়ো করা অবস্থায় দেখবেন, যে মুখটায় ওঁর প্রতি ভালবাসা ছাড়া অন্য কিছু দেখেননি, সেই মুখকে যখন উনি দেখবেন- অনড়, ধূসর, মৃত- তখন চোখের জল কিছুতেই সামলাতে পারবেন না। কিন্তু এই ভীষণ কষ্টের মুহূর্তটা পেরিয়ে উনি দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকগুলো বছরের একটা মিছিল চলেছে- যে বছরগুলো এক্কেবারে ওঁর নিজের।
“ডাক্তাররা এসে বললেন হার্টের অসুখেই লুইজ মারা গেছে- খুব আনন্দে যেমন লোকে মারা যায়।”
দু’হাত বাড়িয়ে ওই বছরগুলোকে যেন জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। কারোর জন্য নয়, তখন শুধু নিজের জন্য বাঁচবেন। কেউ ওঁর মনের ওপর জোর করবে না। পুরুষ, মহিলা যাই বলো, মানুষ কেমন অন্ধ জেদে মনে করে, আরেকটা মানুষের ওপর এভাবে নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার তাদের আছে! ঐ সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার মুহূর্তে ওঁর মনে হচ্ছিল ভাল করার ইচ্ছা হোক, বা কষ্ট দেওয়ার, তাতে অপরাধটা এক চুলও কমে না। (Kate Chopin)
অথচ উনি তো ভালোবাসতেন ওঁর স্বামীকে কখনও কখনও। কখনও আবার বাসতেন না। কী এসে যায় তাতে! নিজের মতো করে বাঁচার অধিকারবোধটা যে উনি টের পাচ্ছেন, হঠাৎ করে এই যে মনে হচ্ছে ওঁর অস্তিত্বের সবথেকে জোরালো অনুভূতি এটাই, সেটার কাছে ভালবাসার ঐ অন্ধকার রহস্যের গুরুত্ব আর কতটাই বা! (Kate Chopin)

‘আমার শরীর মুক্ত, মন মুক্ত’, ফিসফিস করে বলে যাচ্ছিলেন উনি।
বন্ধ দরজাটার ওপারে জোসেফিন হাঁটু গেড়ে বসে, কি হোলটায় মুখ রেখে বলে যাচ্ছিলেন, ‘লুইজ, দরজাটা খোল, প্লিজ খোল! তোর শরীরটা এবার খারাপ করবে। কী করছিস তুই লুইজ? আমার মাথার দিব্যি, খোল!’
‘তুই যা। ঠিক আছি আমি’। ঠিক তো আছেই। তার সাথে আরো কিছু। জানলা দিয়ে বয়ে আসা জীবনের অমৃত ও তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে। সামনের দিনগুলো উনি কীভাবে কাটাবেন সেই ভাবনায় ওঁর কল্পনা লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছিল। বসন্তের দিনগুলো, গ্রীষ্মের দিনগুলো, সব রকম দিনগুলো, যেগুলো ওর একেবারে নিজের। হঠাৎই নিশ্বাসের সঙ্গে একটা প্রার্থনা বেরিয়ে এল ওঁর ভেতর থেকে: যেন উনি অনেকদিন বাঁচতে পারেন। অথচ গতকালই, এই ভাবনায় কেঁপে উঠেছিলেন উনি, যদি খুব বেশিদিন বাঁচতে হয় ওঁকে, কী করবেন তাহলে? (Kate Chopin)
শেষ পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠল লুইজ। দরজাটা খুলল। চোখ দু’টোয় যেন যুদ্ধ জয়ের আলো। ওঁকে যে জয়ের দেবীর মতোই লাগছে সেটা ও বুঝতে পারছিলেন না। বোনের কোমরটায় হাত বেড় দিয়ে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন দু’জনে। নিচে রিচার্ডস অপেক্ষা করছিল ওঁদের জন্য। (Kate Chopin)

কেউ দরজাটা খুলছে ল্যাচ কী দিয়ে। ব্রেন্টলী ম্যালার্ড ঢুকলেন দরজা খুলে। ধীরেসুস্থে। হাতে ব্যাগ, ছাতা। জোসেফিনের হঠাৎ চিৎকারে, থতমতো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অবাক চোখে দেখলেন রিচার্ডস ঝট করে সরে গিয়ে ওঁকে ওঁর স্ত্রীর নজর থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রিচার্ডসের দেরি হয়ে গিয়েছিল একটু। (Kate Chopin)
ডাক্তাররা এসে বললেন হার্টের অসুখেই লুইজ মারা গেছে- খুব আনন্দে যেমন লোকে মারা যায়।
রচনাকাল: ১৯ এপ্রিল, ১৮৯৪
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অনুবাদ করেছেন: কৌশিক দাশগুপ্ত
কৌশিকের অনুবাদের বিচরণক্ষেত্র গল্প ও কবিতা তো বটেই, তার সঙ্গে নন ফিকশনও। ভাষা শিক্ষার ও সাহিত্য আস্বাদনের উপকরণ হিসেবে গল্প বলা ও কবিতা লেখাকে ব্যবহার করেন। ট্রেকিং কৌশিকের কাছে অনুধ্যানের একটি অবকাশ।