আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের কাহিনির মত বললে অত্যুক্তি হবে না।(Dhanyakuria) ‘ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেন’ রেল স্টেশনটা গড়ে উঠেছিল মাত্র একদিনে। তফাৎ যেটা তা হল, আলাদীন তার আশ্চর্য প্রদীপটা ঘষার পরে আগত দৈত্যর সাহায্যে রাতারাতি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটাতে পারত। আর এখানে ঘটেছিল দিনের আলোয় সবার সামনে। আর হ্যাঁ, আলদিনের সব কাহিনি গল্পগাথা আর ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেনের (Dhanyakuria) ঘটনা বাস্তব।
কলকাতায় আর এন মুখার্জির নামে রাস্তা রয়েছে। পুরোনাম – রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি। তিনিই বাস্তবের আলাদীন। তাঁকে যোগ্যসঙ্গত করেছিলেন বিদেশি বেসরকারি রেল-কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা খোদ অ্যাকুইন্যাস মার্টিন। জোরালোভাবে আবেদন ছিল ধান্যকুড়িয়ার (Dhanyakuria) বিখ্যাত ব্যবসায়ী গাইনদের। আর তাতে অনুঘটকের কাজ করেছিল ছোটলাট সাহেব কারমাইকেলের গাইন গার্ডেন প্যালেসে আচম্বিত আগমন-বার্তাটা।

বাংলায় ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ের গাড়ির চাকা গড়ানোর প্রায় চার দশক পরে আসরে নেমেছিলেন অ্যাকুইন্যাস মার্টিন সাহেবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি’। ছোট রেলগাড়ি (Light rail) চালিয়ে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি সরকারি ব্যাবস্থার রেলগাড়ি চলাচলহীন অবহেলিত বাংলার পরিবহণে অনেকটাই গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। তার-ই একটি ‘বারাসাত বসিরহাট রেলওয়ে’ – যার মধ্যেই আলোচ্য স্টেশনটি।
এই মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির একজন অংশীদার ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি। কোম্পানির বিস্তারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন ধান্যকুরিয়া-টাকি-হাসনাবাদ এলাকার ভ্যাবলা গ্রামের ভূমিপুত্র। ভ্যাবলা নামে স্টেশন রয়েছে বারাসাত-হাসনাবাদের বড় রেলে। পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য পুত্র বীরেন্দ্রনাথ মুখার্জিও কোম্পানির গুরুদ্বায়িত্বে ছিলেন।

ছোট রেল (Light rail) মানেই যে মার্টিন রেল, জনমানসের বহুল এই ধারণা প্রথমেই ভেঙে দিই। ছোট রেল চালিয়েছিল দেশি-বিদেশি নানান সংস্থা। মার্টিনের পরেই নাম আসবে, ম্যাক্লিয়ড অ্যান্ড কোম্পানি, গিল্যান্ডার্স অর্বুথনট কোম্পানির কথা। বাংলায় এদের পরিচালিত ছোট রেলের পাশাপাশি ছিল, খাঁটি বাঙালিয়ানার বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলওয়ে কোম্পানি, আর কোচরাজ্যে ছিল কোচবিহার স্টেট রেলওয়ে। বাংলার বাইরেও বহু দেশি-বিদেশি কোম্পানির পাশাপাশি রাজা-মহারাজা, নবাব-নাজিমরা ছোট রেল চালিয়েছিল। ক্লিক নিক্সন কোম্পানি বিদর্ভে চালাত শকুন্তলা রেলওয়ে। ময়ূরভঞ্জ আর বরোদার রাজাদের ছোট রেলের খ্যাতি ছিল। মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানিও চালিয়েছিল বাংলার বাইরে নানা রাজ্যে ছোট রেল।
বারাসাত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে প্রকল্প ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ের শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ বড় লাইন স্থাপনের পরে নেওয়া হয়েছিল। বসিরহাট মহকুমার মানুষের বঞ্চনার কথা ভেবে ২৪ পরগণা জেলা পর্ষদ কিছু একটা করার কথা ভাবলে— তখন লাইট রেলওয়ে বা ট্রামওয়ে স্থাপনের কাজে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি দরপত্র সহ আবেদন করে। রাজেনবাবু জানতেন সমসাময়িককালে এলাকার মানুষদের কলকাতা যাতায়াতের কী নিদারুণ দুর্গতির কথা।
আরও পড়ুন: প্রকৃতি ভবন আর উড ফসিল পার্ক
ততদিনে হাওড়া-হুগলির বিস্তীর্ণ জায়গায় দু’ফুটের ছোট রেল চালিয়ে কোম্পানি অভিজ্ঞ। হাওড়া তেলকল ঘাট (পরে হাওড়া ময়দান) থেকে ট্রেন চালিয়েছে আমতা, চাঁপাডাঙা, শিয়াখালা, জনাই প্রভৃতি শাখায়। তারপরে রানাঘাটের আউসতলা ঘাট থেকে ফুলিয়া হয়ে শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর পথে আড়াই ফুটের রেল চালানোর আত্মবিশ্বাস। দুই ফুটের থেকে আড়াই ফুটের রেলের গতি বেশি হবে ভেবেই বারাসাত-বসিরহাট রেলে এই গেজের স্থাপনা। অতঃপর রেল চলল বারাসত জংশন বসিরহাট পথে। ভাঙা সফরে চলল তিলোত্তমা কলকাতার সঙ্গে যোগসূত্র।
পরবর্তীতে সরাসরি কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত রেল চালানোর দাবী ওঠে। ওদিকে বসুরহাট তথা বসিরহাট থেকে ইছামতী তীরে হাসনাবাদ পর্যন্ত এক্সটেন্সানের কথা ভাবা হয়। তখন বেলিয়াঘাটা ব্রিজ স্টেশনকে জংশন করে একটা নতুন লাইন বাগুইহাটি হয়ে পাতিপুকুর টার্মিনাল পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। কয়েক বছর পরেই শ্যামবাজারের পথে বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোতে আনতে সক্ষম হয়েছিল কোম্পানি। বেলগাছিয়াতে অবস্থান হলেও প্রকল্পের নামানুসারে স্টেশনের নাম রেখেছিল শ্যামবাজার।
এখন ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেন সহ বেশ কিছু স্টেশন বাস্তবের কঠিন জমিতে মুছে গেলেও কিছু স্টেশন স্থান পেয়েছে বা নতুন হয়েছে বারাসাত-হাসনাবাদগামী সরকারি বড় রেলপথে। আর অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে ধান্যকুড়িয়ার কিছু ঐতিহ্যশালী প্রাসদোপম ভবন। যার অন্যতম হল ‘গাইন গার্ডেন হাউস’। ধান্যকুড়িয়ার জমিদারদের অন্যতম গাইনরা ‘গাইন গার্ডেন হাউস’ গড়েছিলেন যেন রাজপ্রাসাদ। ইয়োরোপিওরা যাতে খুশি হন তাই সুউচ্চ সিংহদ্বারের মটকায় সিংহর সঙ্গে দুজন নিরস্ত্র সাহেবের মল্লযুদ্ধর বিক্রমী ভাস্কর্য নজর কাড়ে।
চিঙড়িঘাটা তথা হাসনাবাদ প্রান্তিক স্টেশন থেকে একযাত্রায় যাত্রীরা চলে আসতে পারতেন কলকাতায়। দিনে ৬ জোড়া ট্রেন গোটা ছয়েক কামরা নিয়ে চলত। কু-ঝিক-ঝিক শব্দে ধোঁয়া উড়িয়ে টানত কয়লার ইঞ্জিন। শ্যামবাজার স্টেশনের পরে অনেকগুলো স্টেশন ছিল পথিমধ্যে । চলার পথে সে অনেক কালোয়াতি— রেলগাড়ির প্যাঁয়তারা কষা।
বারাসাত থেকে স্টেশনগুলো কাজিপাড়া, বামুনমুড়া, কদম্বগাছি, গোলাবাড়ি, বেলিয়াঘাটা ব্রিজ জংশন। তারপরে শ্যামবাজার আগত কমন লাইনে দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা, স্বরূপনগর, আড়বেলিয়া, খোলাপোতা, মৈত্র বাগান, বসিরহাট কাছারি বাড়ি, বসিরহাট ইত্যাদি।
এই ‘বসিরহাট কাছারি বাড়ি’ স্টেশনটা বেশ বড় ছিল আর ‘বসিরহাট’ ছিল টার্মিনাল স্টেশন। এখানে যাত্রা শেষের পরে ফিরতি পথের জন্যে ইঞ্জিন ঘোরানো হত ‘টার্ন টেবিল’-এ তুলে। বসিরহাট কাছারি বাড়ি স্টেশন বর্তমান সরকারি বড় রেলে নেই।

তখন এপথে পুরোদমে ট্রেন চলছে। এমত অবস্থায় ধান্যকুড়িয়ার ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় আর কোম্পানির জাঁদরেল কর্তা রাজেনবাবুর বদান্যতায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় একদিনেই তৈরি হয়েছিল ‘ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেন’ স্টেশনটি। ছোটলাট কারমাইকেল সাহেবের আগমন-বার্তায় – বাগানবাড়ির অনতিদূরে। না হলে যে ওনাকে নামতে হত অনেকটা দূরে স্বরূপনগরে নয়ত আড়বেলিয়ায়। বেঙ্গল গভর্নর স্যর স্ট্যানলি জ্যাকসন, লেডি জ্যাকসন, অন্যান্যরা এসেছিলেন। রাজেনবাবু পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন ভ্যাবলার বাড়িতেও। মাত্র অর্ধ শতাব্দী চলেছিল এই রেল। এই রেলপথ নিয়ে অনেক গল্পগাথা পুরাতন বাংলা-সাহিত্যে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনীতিক আর সাহিত্যিকদের স্মৃতিধন্য।

এখন ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেন সহ বেশ কিছু স্টেশন বাস্তবের কঠিন জমিতে মুছে গেলেও কিছু স্টেশন স্থান পেয়েছে বা নতুন হয়েছে বারাসাত-হাসনাবাদগামী সরকারি বড় রেলপথে। আর অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে ধান্যকুড়িয়ার কিছু ঐতিহ্যশালী প্রাসদোপম ভবন। যার অন্যতম হল ‘গাইন গার্ডেন হাউস’।

ধান্যকুড়িয়ার জমিদারদের অন্যতম গাইনরা ‘গাইন গার্ডেন হাউস’ গড়েছিলেন যেন রাজপ্রাসাদ। ইয়োরোপিওরা যাতে খুশি হন তাই সুউচ্চ সিংহদ্বারের মটকায় সিংহর সঙ্গে দুজন নিরস্ত্র সাহেবের মল্লযুদ্ধর বিক্রমী ভাস্কর্য নজর কাড়ে। প্রায় তিরিশ একর জমিতে এই বাগান বাড়ি। যার সামনে আর পিছনে (ভবনের) দুটো শান বাঁধাই পুকুর। এই ভবন-এর গায়ে ঝোলা শৌচালয়গুলো বিপজ্জনক হয়ে গেলেও সাবেককালের রাজস্থানের হাভেলির ঝারোকার কথা স্মরণ করায়। বিদেশি স্থাপত্যকলার মিশ্রণ একে অনন্যতা দিয়েছে। এতদিন ছিল সরকারি অনাথ আশ্রম। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়, এই ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেন ক্যাসেল (প্যালেস) হেরিটেজ ঘোষিত হয়েছে ২০২১ সালে, West Bengal Heritage Commission এর দ্বারা।

এখানকার জমিদারদের ছিল মূলত পাট ও অনুসারী শিল্পের ব্যবসা। আদানপ্রদানের জন্য ইউরোপীয়দের সঙ্গে দহরম মহরম ছিল। তাই তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, বাঈজির নাচাগানা খানাপিনা সব চলত। গাইন গার্ডেন হাউসের পরে ধান্যকুড়িয়ায় দেখার রয়েছে তাদের বসতবাড়ি ‘গাইন হাউস’। ভেতরে কুলদেবীর মন্দির, দুর্গাদালান আর নজরমিনার। আরেকটু দূরে সাউবাড়ি, বল্লভবাড়ি। বল্লভবাড়ির চৌহদ্দিতে প্রাচীরের বাইরে একান্তে একটা সু-দৃশ্য নজরমিনার রয়েছে । তিনতলা মিনার-এর গঠনশৈলী আকর্ষণীয়। প্রায় সব বাড়িতেই দুর্গাদালান। শরিকরা বছরে দুর্গাপুজোর সময়েই আসেন।

ধান্যকুড়িয়ার রাসমঞ্চ নজর কাড়ে। রথের চূড়ার মত, ধবধবে সাদা। তার আগেই একটা ছোট মন্দির পথের ডান পাশে, ওটা কালীমন্দির। ধান্যকুড়িয়ার আরও কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে । যেমন সাউ গার্ডেন হাউস, মণ্ডল হাউস ইত্যাদি। প্রায় সারে তিন-চার কিলোমিটারের মত পরিক্রমা।
ধান্যকুড়িয়া বেড়ানোর বিশেষ তথ্য-
শিয়ালদহর নর্থ/মেন থেকে হাসনাবাদ লোকালে ‘কাঁকড়া মির্জানগর’ হল্ট (ঘণ্টা দেড়েক)। তিনচাকায় শেয়ারে ৩০ টাকা ভাড়া ধান্যকুড়িয়া বাজার (৭/৮ কিলোমিটার)। পথে দেখে নিতে পারেন চাকলায় লোকনাথ বাবার জন্মস্থান। বাজারের অনতিদূরে গাইন গার্ডেন হাউস। পরিক্রমা করতে বাহনের আলাদা চুক্তি দরকার। নিজেরা গাড়ি আনলে ভাল। উন্নতমানের খাবারের অভাব এলাকায়। খাবার নিতান্ত সাধারণ মিলবে: আশা ফাস্ট ফুড (98836 72939)। ধান্যকুড়িয়ার দ্রষ্টব্যের জন্যে অনুমতি দেওয়া হয় এসডিও/হাসনাবাদ-এর তরফে। অন্যথায় বাইরে থেকে দেখে ফেরা।
তথ্যসূত্র:
১) বাংলায় ছোট রেলের গৌরবগাথা / নিশীথ মান্না (সূত্রধর)
২) মার্টিন রেলের ইতিবৃত্ত / প্রদীপরঞ্জন রীত (অলকানন্দা পাবলিশার্স)
৩) বাংলায় ভ্রমণ / অখণ্ড সংস্করণ (পূর্ব্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ হইতে প্রকাশিত/১৯৪০)-এর তথাগত সংস্করণ ২০২৩
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia, Wikimmedia Commons
প্রথম ছাপার অক্ষরে লেখা প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে। আপাতত এক কুড়ি গ্রন্থের প্রণেতা। বাংলা গ্রন্থ জগতে ভ্রমণ, রেল, রেল-ভ্রমণ, রহস্য-ভ্রমণ ও অরণ্য-ভ্রমণের ওপরে নজর কেড়েছেন । প্রণীত করেছেন ভ্রমণ কাব্যগ্রন্থও।