মিশকালো মেঘটা মাথার ওপর শামিয়ানা খাটিয়েছে। ভরদুপুরে পাহাড় চুঁয়ে অন্ধকার নামছে। বৃষ্টির অঝোর ধারাপাত দেখতে দেখতে চোখ ও মন এখন ক্লান্ত। মার্চের গোড়ার দিক। ভরা বসন্তে নিম্নচাপ সব প্ল্যান ভেস্তে দিল।
বৃষ্টির দৌরাত্ম্যে কর্ণপ্রয়াগে দু’দিন ধরে গৃহবন্দি হয়ে আছি। অলকানন্দার গা ঘেঁষেই বারান্দা। এখানে বসেই দেখতে পাই অলকানন্দা ও পিণ্ডার নদীর মিলন। ওপারের মন্দিরটায় সকাল থেকেই পূজাপাঠ শুরু হয়। ভক্তদের আনাগোনা চলতেই থাকে সারাদিন। বিরামহীন বারিধারায় নদীর জলও বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। দুপুরের পর থেকে তুমুল বর্ষণে চারপাশ ফ্যাকাশে। হাড় কাঁপানো শীত।
সন্ধ্যার দিকে একটা সুখবর দিল আমাদের গাড়ির চালক ভিকি— “সপ্তাখানেক আগেও আউলিতে বরফ ছিল না। লাগাতার অকাল বর্ষণে আউলি (Auli) বরফে ঢেকে গেছে।” যোশীমঠ ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের কেউ একজন তাকে ফোনালাপে জানিয়েছে। দুটো দিন নষ্ট হওয়ার শোক কিছুটা দূর হল।

ভোরের দিকে ধারাপাতে বিরতি পড়ল। আবহাওয়ার খানিক উন্নতি হয়েছে। হৈ হৈ করে সকাল ৯টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। পান্নাসবুজ অলকানন্দার সমান্তরালেই গাড়ি চলছে। সবুজ উপত্যকা, অল্পবিস্তর ঘরবাড়ি, আঁকাবাঁকা খেত— পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি। নন্দপ্রয়াগে অনেকটা নীচে সবুজাভ অলকানন্দার সঙ্গে কালচে সবুজ নন্দাকিনী মিলেছে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে সঙ্গমের কাছে। নেপথ্যে ধাপচাষের সবুজ পাহাড়, তারও পিছনে মেঘের আলগা আস্তরণ জড়ানো বরফাবৃত পাহাড়চূড়া।
সকালের দিকটা বেশ কিছুক্ষণ মেঘ-রোদ্দুরের খুনসুটি চললেও, এখন ঝলমলে নীল আকাশ। গত তিন-চারদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে বরফের শিরা-উপশিরা। তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকিও শুরু হয়েছে। একে একে পেরিয়ে গেলাম চামোলি, বিরহী, মায়াপুর, পিপলকোঠি, গরুড় গঙ্গা। এই গরুড় গঙ্গাতেই পাতালগঙ্গা নদী অলকানন্দায় এসে মিশেছে। হাতিঘোড়ি শৃঙ্গ আর নীচে আঁকাবাকা সবুজ অলকানন্দা – অনবদ্য যুগলবন্দি।

হেলাং, আনিমঠ হয়ে যখন যোশীমঠ বাজারে পৌঁছলাম, ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা প্রায় একটা। এখানেই হালকা লাঞ্চের পর ভিকি আমাদের আউলি যাওয়ার রোপওয়ে টার্মিনালে ছেড়ে দিল। আউলির (Auli) জি এম ভি এন লজে দু রাতের অগ্রিম বুকিং করা আছে। ভিকিকে বলা হয়েছিল, গাড়ি নিয়ে লজে পৌঁছে যেতে। কিন্তু পরিস্থিতি সহায় হল না। বরফে পথ আটকে গেছে। চাকায় চেন বেঁধে কিছু ল্যান্ডরোভার চলাচল করলেও, গাড়ি যে কোনও সময় ফেঁসে যেতে পারে।
টিকিট কেটে অপেক্ষা করছিলাম। যাত্রীসংখ্যা বাড়ার পর রোপওয়ে ছাড়ল। বেশ বড়সড় একটা কাচের বাক্স। জনা পঁচিশেক লোক গা ঘেঁসাঘেঁসি করে দাঁড়াতে পারে। এক রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু হল। যোশীমঠ টার্মিনাল থেকে মোট ১০টা টাওয়ার আছে। শেষ টার্মিনাল পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ৪.১৫ কিলোমিটার। সময় লাগে ২২ মিনিট। নীচের দিকে তাকিয়ে যোশীমঠের ঘন-সন্নিবিষ্ট ঘরবাড়ি দেখছি। এক সময় তা মিলিয়েও গেল। এবার একে একে নামকরা শৃঙ্গগুলি দৃশ্যমান হচ্ছে। কেবল-কারের গার্ড ভদ্রলোকটি এক এক করে চিনিয়ে দিচ্ছেন তাদের। গাছগুলো সব সাদা হয়ে গেছে। বহু নীচে বরফ ঢাকা আঁকাবাঁকা সড়ক পথটিকে সাদা ফিতের মতো মনে হচ্ছে।

জি এম ভি এন লজে রাত্রিবাস করতে হলে ৮ নম্বর টাওয়ারে নেমে আবার চেয়ার কারে চাপতে হবে। জনাকয়েক ট্যুরিস্টের সঙ্গে আমরাও নেমে পড়লাম। বাকিদের নিয়ে কেবলকার এগিয়ে গেল ১০ নম্বর টাওয়ারের দিকে। মন তখন খুশিতে পাগলপারা। অপার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নন্দাদেবী। বেথারতোলি, দ্রোণাগিরি, হাতিঘোড়ি, পালকি, নীলগিরি, মানা— তুষারশৃঙ্গের সুবিশাল রেঞ্জ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। এই তুষারাবৃত পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে সজ্ঞানে স্বর্গে পৌঁছে গেছি।
আরও পড়ুন: বন-পাহাড়ের হাতছানিতে সেজে উঠছে ফুটিয়ারি
কিন্তু লাগেজপত্তর নিয়ে তুষার সাম্রাজ্যে পা রাখতেই দেখি, নামার লিফট বন্ধ। লোহার সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা নীচে নামতে হবে। বরফ পড়ে সেগুলো সাংঘাতিক পিছল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে স্নানঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা সাবানজলের উপর দিয়ে হাঁটছি। প্রতি মুহূর্তে পা হড়কাচ্ছে। সাবধানে রেলিং ধরে পা টিপে টিপে নামছি। পিঠে ভারী রুকস্যাক নিয়ে এভাবে নামাটা বেশ বিপদজনক। একটু অসাবধানতায় পা হড়কে গেলেই হাড়গোড় যে আস্ত থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।
প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা সিঁড়ি হবে। শেষ ধাপে পা রাখতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে পরমুহূর্তেই সবার মুখ রক্তশূন্য। বেশ কিছুটা এগিয়ে চেয়ার-কার টার্মিনাল। আর সে পথে জমে আছে প্রায় ২ ফুট পুরু বরফের স্তর। প্রথম পদক্ষেপেই হাঁটু ঢুকে গেল। পিঠের বোঝা সামলে টলমল করে এগোচ্ছি। মনে হচ্ছে, এই বোধ হয় উল্টে পড়লাম। জুতোয় বরফ ঢুকে পা ভিজে অসাড় হয়ে গেছে। গত কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টি আর তুষারপাতেই বরফের এত বাড়বাড়ন্ত।

অবশেষে অক্ষত দেহে চেয়ার-কার টার্মিনালে পৌঁছলাম। এতক্ষণ চারপাশে চোখ মেলে দেখার সুযোগ পাইনি। এবার নন্দাদেবীকে একেবারে হাতের নাগালে পেয়ে সব কষ্টকে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। প্রথম মোলাকাতেই মুগ্ধতা। সামনেই এক জলাশয়। তাপমাত্রার পারদ নেমে জলস্তরের উপরিভাগের তরলটুকু জমাট বেঁধে কাচের প্লেটের চেহারা নিয়েছে।
চেয়ার-কার ছাড়ল। পাশাপাশি চারজন বসতে পারে। সামনে ধরে বসার জন্য একটা রড। চারপাশ উন্মুক্ত। পা দুটো নীচে ঝুলছে। যেদিকেই তাকাই, তুষারশৃঙ্গের অনুপম শোভা। উড়তে উড়তে নিজেকে মনে হচ্ছে সুমেরু অঞ্চলের পাখি। বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় ‘রুশদেশের উপকথা’ বইখানা হাতে নিয়ে বরফ ঢাকা সাইবেরিয়ার গ্রামগুলোকে মানসচক্ষুতে খুঁজে বেড়াতাম। কল্পনাও মিশে থাকত অনেকখানি। আজ যেন সেই ছবি স্বচক্ষে দেখছি। নীচের দিকে তাকালেই বরফে ঢাকা ভূখণ্ড। গুটিকয়েক মানুষ স্কি করছে। শুধুমাত্র সাদা রঙে সেজেছে প্রকৃতি। বর্ণহীনতা যে এত লাবণ্যময় হতে পারে, তা প্রথমবার অনুভব করলাম।

এই উড়ে চলা অন্তহীন নয়। নেমে পড়লাম চেয়ার-কার থেকে। সিঁড়িপথ চলে গেছে জি এম ভি এন রিসর্টে। সুন্দর কটেজ। আমাদের কটেজের নামটা কিন্তু বেশ, ‘কামেট’। জানলার কাচ, ঘরের হেলানো ছাদ, বারান্দা, লনে সাজানো চেয়ার টেবিল সবকিছুই বরফে ঢেকে আছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। চেয়ার-কার টার্মিনালের পাশেই স্কি-পয়েন্ট। তাকে পাশ কাটিয়ে চড়াই সিঁড়ি গেছে হনুমান মন্দিরে। পুরু বরফে পা বসে যাচ্ছে। পিছলে পড়ার আশঙ্কায় রেলিং ধরে খুব সাবধানে ধীর গতিতে পা ফেলছি। হনুমান মন্দিরের ত্রিসীমানায় কেউ নেই। শুধু ভজনের সুর ভেসে আসছে। এখান থেকে বেশ কিছু ঘর-বাড়িও দেখা যাচ্ছে।

সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বমহিমায় নন্দাদেবী, লালচে থেকে ধীরে ধীরে রং পাল্টে সোনালি হল। দিনের শেষ আলোয় মায়াবী রূপ ধারণ করল হিমানি শৃঙ্গগুলি। রঙের খেলা দেখতে দেখতে বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে নিল চারপাশ, সেই সঙ্গে বাড়ল কাঁপুনি।

আকাশ ময়লা হলেও সারাদিন বৃষ্টি ছিল না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হল খইয়ের মতো বরফবৃষ্টি। এ অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে ডাইনিং হল পর্যন্ত যেতেই দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার অবস্থা। রাত আটটার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে চার দেওয়ালে নিজেকে বন্দি করে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। চারদিক সুনশান, নিস্তব্ধ। জানালার শার্শিতে চোখ রেখে তুষারপাত দেখতে দেখতে একসময় পাড়ি দিলাম ঘুমের দেশে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি জানলার অর্ধেকটা বরফে ঢেকে গেছে। সামনের লনটা তাজা বরফের সাদা চাদরে মুড়ে গেছে। গাছের ডালে থোকা থোকা ফুলের মতো বরফ। ডালপালাগুলো সাদা হয়ে গেছে। ছাদের ঢাল, কার্নিশ থেকে বরফ ঝুলে নেমে এসেছে। কোনোটার আকার ছুরির মতো, আবার কোনোটা বর্শার ফলার মতো।

হাঁটতে হাঁটতে স্কি পয়েন্টের কাছে এলাম। টাটকা বরফের পরিমাণটা বেড়েছে। দুধসাদা বরফের মসৃণ ঢালটা যেন বিশাল বড় আকারের আইসক্রিম। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা স্কি-এর আসর জমিয়েছে। দূর থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝড়ের গতিতে তাদের নেমে আসা দেখতে বেশ মজা লাগে। উল্টে চিৎপটাং হওয়া আনকোরা পর্যটকের সংখ্যাও কিছু কম নয়।
ঝলমলে আকাশ। রোদে গা সেঁকতে বেশ আরাম লাগছে। দিনের আলো নিভতেই তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নামতে শুরু করে দিল। তার সঙ্গে উত্তুরে বাতাসের কামড়। রাত বাড়ছে, ঠান্ডাও বাড়ছে। মেঘমুক্ত আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের সঙ্গে সই পাতাতে রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ বাইরে বেরিয়ে এলাম।
আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। নিঝুম রাতে আউলিকে মোহময়ীর মতো লাগছে। জ্যোৎস্না ধোয়া হিমানি শৃঙ্গগুলি রুপোর মতো ঝলমল করছে। দূরের সিলভার ওকের জঙ্গলে কালো আঁধার। সাদা বরফের গায়ে গাছের ছায়া। বোবায় পাওয়া মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে আছি। মাইনাস সাত ডিগ্রিকে উপেক্ষা করে কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, খেয়াল নেই। হিমশীতল আউলি তার গভীর উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরেছে।

যাতায়াত: ট্রেনে হরিদ্বার, হৃষিকেশ বা দেরাদুন পৌঁছে বাসে বা ভাড়াগাড়িতে চলে যান যোশীমঠ। সেখান থেকে রোপওয়ে চেপে আউলি যাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তবে যোশীমঠ থেকে গাড়িতেও আউলি যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ান যাচ্ছে দেরাদুন।
থাকা: আউলিতে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের লজে থাকতে হলে এই ওয়েবসাইট দেখুন: www.gmvnonline.com
এছাড়া, বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল আছে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।
3 Responses
ছবি আর লেখা নিয়ে একটা নিটোল মুক্তো। বেশ বেশ।
দিনের বেলা বরফ পড়ে বাইরেটা যেন মস্ত একটা আইসক্রিম আর রাতে ওক গাছের অন্ধকার – কী সুন্দর বর্ণময় লেখা।ঈশ্বরী আউলি !
ভালো লাগলো