রোমাঞ্চকর জায়গার প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালীন। তার সঙ্গে যদি ভূতের গল্প জড়িয়ে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। আর জায়গার নাম যদি হয় ‘মৃত্যু উপত্যকা’, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এ গল্পের পটভূমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত, যেখানে প্রশান্ত মহাসাগর এসে মিশেছে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে, তারই অদূরের এক মরুভূমি অঞ্চল। আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমের অনেকখানি জুড়ে আছে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য। আরও পূর্ব দিকে এগোলে একে একে পড়ে তিনটি রাজ্য— নেভাদা, অ্যারিজোনা আর ইউটা। আজকের গল্পের ভৌগলিক অবস্থান এই অঞ্চলে।
‘Death Valley’— ‘মৃত্যু উপত্যকা’। মূলত এই নামের আকর্ষণেই এক বসন্তের সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের এই পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলের উদ্দেশ্যে। সহযাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে আর স্থানীয় বাহন চালকের সঙ্গে কথায় কথায় জানলাম বেশ কিছু অবাক করা তথ্য। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাস-এর সময়ে কিছুটা সোনা আর অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যাত্রা করেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। সেই অভিযাত্রীকদের একাধিক দল নাকি নেভাদা আর ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের মাঝে এই মরু অঞ্চলে পথ হারিয়ে তীব্র জলকষ্টে প্রাণ হারায়। এদেরই মধ্যে কোনও এক যাত্রী কোনওক্রমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলেছিলেন “Goodbye, Death Valley”. সেই থেকেই এই উপত্যকার নাম ডেথ ভ্যালি। পথে আসতে আসতে বেশ কিছু গা ছমছমে পরিত্যক্ত জনবসতি চোখে পড়ল। স্থানীয়দের কথায় যা “Ghost Village”।

প্রমোদনগরী লাস ভেগাস থেকে যাত্রা শুরু করে ঘণ্টা দুয়েকের পথ পেরিয়ে আমারগোসা পর্বতশ্রেণীর মাঝে এক অপরূপ ভূমিপ্রান্তরে এসে পৌঁছালাম। লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই অঞ্চলে ফারনেস ক্রিক লেক নামে এক বিশাল জলাশয় ছিল। ক্রমে তার পলি থেকে এই জায়গা বোরাক্স-এর খনিতে পরিণত হয়। ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৯ — এই ছয় বছর ‘হারমনি বোরাক্স ওয়রক্স’ নামে এক কোম্পানি এখানে খননকার্য চালায়। বোরাক্স বয়ে নিয়ে যাবার জন্য তারা যে বিশাল কারাভান ব্যবহার করত, ইতিহাসে তাই টোএনটি মিউলস টিম নামে বিখ্যাত। বিংশ শতাব্দীতে পেসিফিক কোস্ট বোরাক্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ক্রিস্তিয়ান যাব্রিস্কির নাম অনুসারে জায়গাটির নামকরণ করা হয় যাব্রিস্কি পয়েন্ট। পরিত্যক্ত বোরাক্সের খনির তীব্র হলুদ রঙের ভূমিরূপের উপর পড়ন্ত সূর্যের আলো এখানে এক মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি করে।
এই ফারনেস ক্রিক অঞ্চলে এক ধরনের লম্বা পা-অলা পাখির দেখা মেলে। এমনিতে প্রচণ্ড গরমে এখানে পশু-পাখি খুব বেশি বাঁচে না। কিন্তু রোডরানার নামের এই কদাকার পাখিটির মরুভূমির শুষ্ক গরমে মানিয়ে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।

মোজাভে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ পশ্চিমের দিকে চলে আমরা এলাম ডেভিলস গলফ কোর্সে। প্রায় দশ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে এক বিশাল লবণ-হ্রদ ছিল। এই হ্রদের জলের উৎস আমারগোসা নদী, এখনও মাটির অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে। স্থানীয় প্রবাদ অনুযায়ী, প্রতি একশো বছর অন্তর এই নদীতে বান আসে। প্লাবনের পরে বিশাল এই উপত্যকা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। আমরা অবশ্য দেখলাম উঁচু নিচু রুক্ষ প্রান্তর। প্রাচীন হ্রদের লবণ হ্যালাইট ক্রিস্টাল আকারে সম্পূর্ণ উপত্যকা ছেয়ে আছে। রোদের তাপে সেই লবণে পা ছোঁয়ানো দুষ্কর। আমাদের এক ইউরোপিয়ান সহযাত্রী অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন “Only the devil could play golf on its surface”। এই ভৌতিক পরিবেশে কিছু ভারী পাথর চোখে পড়ল, যেন পাথরগুলোকে কেউ মাটির উপর দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছে। মাটির ওপরে স্পষ্ট টানার দাগ। স্থানীয় বাহন চালকের মুখে শুনলাম পাথরগুলো নাকি নিজেরাই সরে যায়, বিশেষ করে ভরা পূর্ণিমা আর অমাবস্যার রাতে। এর একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা থাকলেও ওই পরিবেশে এটাকে অলৌকিক কিছু ভাবতেই ভালো লাগছিল। এখান থেকে একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে সবজে নীল, বেগুনি আর মেটে রঙের পাথরের একটা অঞ্চল দেখা যায়, যার পোশাকি নাম আর্টিস্ট‘স প্যালেট। এই গোটা পাহাড়ি অঞ্চলটাই যে একসময় অগ্নুৎপাতের ফলে তৈরি হয়েছিল, এই আর্টিস্ট‘স প্যালেট তার প্রমাণ।

ডেভিলস গলফ কোর্স ছাড়িয়ে আরও দশ মিনিট চলার পর আমাদের গাড়ি এসে পড়ল আরও এক বিস্ময়কর প্রান্তরে। দূরে পর্বতশ্রেণীর রেখা। তার মাঝে সূর্যের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া শুভ্র উপত্যকা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন বিশাল জলাশয়। কিন্তু একটু কাছে গেলে বোঝা যায়, এই গোটা অঞ্চলটাই ঢাকা নুন আর নানারকম খনিজ পদার্থের তলায়। তার মাঝে একটি ক্ষুদ্র জলাশয় আজও তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে কোনওরকমে। স্থানীয় নাম ব্যাড ওয়াটার বেসিন। এই জলাশয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা উত্তর আমেরিকা মহাদেশের নিম্নতম স্থান। চোখে পড়ল একটা কাঠের ফলক। তাতে লেখা রয়েছে যে আমরা রয়েছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট নীচে। এই অঞ্চল কিন্তু ডেভিলস গলফ কোর্সের মতো রুক্ষ নয়। কাছ থেকে দেখে মনে হয় বুঝি এইমাত্র সমুদ্রের ঢেউ সরে গিয়ে সাদা বালির প্রান্তর উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের রেখা সেই নৈসর্গিক দৃশ্যে এক অন্য মাত্রা যোগ করে।

নেভাদা প্রদেশে এই ডেথ ভ্যালির এক অংশে রয়েছে প্রকৃতির আরও এক বিস্ময় ডেভিলস হোল। পাথরের মাঝে প্রায় ৫০০ ফুটের বেশি গভীর এই গর্ত সুদূর জাপান, ইন্দোনেশিয়া বা চিলির ভূকম্পের সময়ে গরম জলের স্রোতে নাকি আশেপাশের অনেকটা অংশ ভিজিয়ে দিয়েছিল। এই গর্তে বাস করে বিলুপ্তপ্রায় ডেভিলস হোল পাপফিশ। ছোট আকারের এই মাছগুলির বর্তমান সংখ্যা ২০০- র কম এবং সারা পৃথিবীতে এই প্রজাতির একমাত্র বাসস্থান ডেভিলস হোল।
ফেরার পথে মরুভূমির মাঝে পথের বাঁকে এক বিশাল প্রাসাদ চোখে পড়ায় যারপরনাই বিস্মিত হলাম। সুদূর রাজপুতানার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। আকারে বা শিল্পকাজে রাজপুত প্রাসাদের ধারে-কাছে না হলেও চাঁদনি রাতে এই প্রাসাদে পরিদের দল নেমে আসে বলে স্থানীয় সাধারণ মানুষদের বিশ্বাস। ওয়ালটার স্কট নামে এক রহস্যময় ব্যক্তি ১৯২০-৩০ সালে এই প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। কারও কারও মতে তিনি ছিলেন মেষপালক। কেউ বলেন অভিনেতা। আবার তাঁর নিজের বক্তব্য অনুযায়ী এই প্রাসাদ তৈরির মূলধন ছিল এই অঞ্চলের এক গোপন খনি। তাঁর নাম থেকেই এই প্রাসাদের নাম স্কটি‘স ক্যাসল।

সমস্ত ডেথ ভ্যালি অঞ্চলটাকে পাখির চোখে দেখতে হলে যেতে হবে ৫৪৭৬ ফুট উঁচু দান্তেস ভিউ তে। এই অঞ্চল ব্ল্যাক মাউন্টেন নামে এক প্রাগৈতিহাসিক আগ্নেয়গিরির অংশ। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এ যাত্রায় রাস্তা বন্ধ থাকায় আমরা সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হলাম। ভাগ্যবান যাত্রীরা অনেকে রাতে এখানে তাঁবু ফেলে থাকেন। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে নাকি অসাধারণ রূপ এই বিস্তীর্ণ মরুভূমি আর উপত্যকার। আর অমাবস্যায় সারা আকাশ জুড়ে অপার্থিব জ্যোতিষ্কের মেলা।
এই মরু অঞ্চলের স্থানীয় উপজাতির নাম তিম্বিশা। এদের সংখ্যা বর্তমানে একশোরও কম। প্রায় হাজার বছর ধরে তারা এই মরুর বিশেষ অংশে বাস করে। তিম্বিশা নামটি এসেছে লাল রঙের এক বিশেষ মাটির নাম থেকে, যা দিয়ে এই উপজাতির মানুষেরা তাদের মুখ রং করত। এই লাল মাটি পাওয়া যায় বর্তমান ডেথ ভ্যালির দক্ষিণে গোল্ডেন ভ্যালি অঞ্চলে। আমাদের ভাগ্যে এই আদি জনজাতির দেখা না মিললেও রাঢ়বাংলার হাজার হাজার মাইল দূরে বসে এই লাল মাটির গল্প আমাকে রোমাঞ্চিত করছিল।

সারাদিনের ক্লান্তি আর অদ্ভুত এক মুগ্ধতা নিয়ে মনে মনে আবার ফিরে আসার অঙ্গীকার করে আমরা ফিরে চললাম পাশ্চাত্যের লাস্যনগরী লাস ভেগাসের আস্তানায়।
প্রসঙ্গত বলি, এই ডেথ ভ্যালি নিয়ে অজস্র ছবি, বই আর ডকুমেনটারি হয়েছে। আপনাদের যদি ‘স্টার ওয়ার্স’ ছবিটার কথা মনে থাকে, তাহলে বলি, স্টার ওয়ার্স-এর তাতুনি গ্রহের শুটিং এই অঞ্চলেই করা হয়।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia
লেখক সরিৎ চ্যাটার্জি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় হিমালয়প্রেমী ও পর্যটক। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক এ কর্মরত।
One Response
“Death Valley ” পড়ে খুব ভালো লাগলো ……