গেঁওখালির কাছে হুগলি আর রূপনারায়ণের মিলন। এই মিলিত প্রবাহ বহরে আরও বেড়ে এগিয়েছে মোহনার দিকে। আরও কুড়ি কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ দিক দিয়ে হলদি নদী এসে মিশেছে সেই প্রবাহে। এপারে রয়ে গেছে হলদিয়া, ওপারে নন্দীগ্রাম। অতীতে নদী পাড়ে পলির উপর গড়ে ওঠা এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘দোর দুবনান পরগনা’। পরে নদীর নামে নামকরণ হয় ‘হলদিয়া’ (Haldia)।
৬০-৬২ সালে মোহনায় গড়ে ওঠে নদীবন্দর— কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ রূপে। উন্নয়নের জোয়ার লাগে গোটা অঞ্চল জুড়ে।
সপ্তাহান্তে কোনও ঝটিকা সফর নয়, শিল্পনগরী হলদিয়া আমার কর্মস্থল। গোটা বছরব্যাপী রোটেশনাল শিফট ডিউটি। কাজের বাইরে বেরিয়ে সেভাবে দেখা হয়নি মহানগরীর উপকণ্ঠে এই বন্দর শহরকে। কিন্তু হঠাৎই কাঁধে এল গুরুদায়িত্ব। এক ঝাঁক বন্ধুবান্ধবের আকস্মিক হলদিয়া আগমনের সংবাদ। হলদিয়ার বিশ্বকর্মা পুজোর জগৎজোড়া খ্যাতি এর অন্যতম কারণ। তাই পুজোর আগের দিন দুপুর দুপুর তারা এসে হাজির। গাইড হিসেবে আমি রইলাম তাদের সঙ্গে।

হলদিয়া (Haldia) শহরের প্রধান বাসস্ট্যান্ড বলতে ব্রজলালচক, সিটি সেন্টার, রানিচক কিংবা টাউনশিপ বাস ডিপো। আমার অজান্তেই অনলাইনে তারা বুক করেছে ‘হলদিয়া ভবন’। তাই টাউনশিপ বাসস্ট্যান্ড থেকে তাদের সঙ্গে করে টোটো নিয়ে চললাম হলদিয়া ভবনের উদ্দেশ্যে।
বড় রাস্তা ছেড়ে অলিগলি পথে টোটো এগিয়ে চলেছে। গলিপথ শেষ হতে হঠাৎ সামনে হলদি নদী। হলদিয়া বন্দরের খুব কাছেই, নদীর ধারে গড়ে ওঠা সরকারি এই ভবন মন কেড়ে নেয়। সপ্তাশেষে একটা কি দুটো দিন নদীর মলয় বাতাস গায়ে মেখে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। হলদিয়া ভবনের বিশেষ আতিথেয়তায় দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন হল। হাতে মাত্র আজকের অর্ধেক দিন এবং কালকের গোটা দিন। তাই সময় নষ্ট না করে সবান্ধব বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। বিশাল হুইসেলের শব্দে দৈত্যাকৃতি জাহাজ বন্দর ছাড়ছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। জোয়ারের জেরে নদীও রয়েছে ফুলে-ফেঁপে। আমরা সকলে মিলে হাঁটতে শুরু করলাম নদীর পাড় ধরে। অসাধারণ শৈল্পিকভাবে সাজানো নদীর পাড়। মখমলের সবুজ ঘাসের উপর ফুটে থাকা নানান ফুলের সমারোহ। নদীর ছোট ছোট ঢেউ কূল ছাপিয়ে উঠে আসছে উপরে। ট্রাউজার গুটিয়ে পা মেলালাম নদীর জলে।

বেশ কিছুটা পথ হেঁটে পৌঁছলাম কৃষ্ণার্জুন ঘাটে। হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তত্ত্বাবধানে বিশেষভাবে সেজে উঠেছে এই ঘাট। কোথাও সবুজ ঘাসের চাদরে মোড়া, আকাশছোঁয়া ভাস্কর্য আবার কোথাও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা একজোড়া জিরাফ। তির-ধনুক হাতে আদিবাসী মূর্তি, বা একতারা হাতে ক্ষ্যাপা বাউল— প্রচণ্ড রকমের জীবন্ত।
ঘাটে নামার সিঁড়ির মুখে মহাভারতের কৃষ্ণার্জুন রথ। সিঁড়ির প্রতি ধাপে আয়েশ করে বসার জন্য বানানো সিমেন্টের বেদি।
বিশ্বকর্মা পুজোর আশেপাশে এমনিতেই হলদিয়ায় লোকসমাগম বেশি। তাই গোটা ঘাট-চত্বর লোকে লোকারণ্য। বসবার জায়গায় উপচে পড়া ভিড়। তাই আমরা এগিয়ে চললাম আরও কিছুটা দূর। পৌঁছলাম অপেক্ষাকৃত ফাঁকা একটা জায়গায়। নদীর ধারে বড় বড় বোল্ডার ফেলা, তারপর হালকা সবুজ ঢাল এসে মিশেছে বড় রাস্তায়। হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম সবুজ কার্পেটের উপর। একটু পরেই টিনের বাক্স বাজিয়ে চা-ওলা এসে হাজির।
অল্প দূরেই ফেরিঘাট। মাঝে মাঝে ঘণ্টা বাজিয়ে ছাড়ছে যাত্রীবোঝাই ভেসেল।
বিকেল পেরিয়ে সূর্যাস্তের মুহূর্ত আগত। গোধূলির আলোয় দিগন্তের আকাশ এক বিধুর লালিমায় ভরে উঠেছে। আমরা রওনা দিলাম আমাদের আস্তানায়। ফেরার পথেও দেখতে পেলাম নদীবক্ষে সেই বিশাল জাহাজ। সন্ধ্যার গাঢ় নীল আকাশের পটভূমিকায় আলো ঝলমলে সেই জাহাজ রওনা দিয়েছে মোহনার উদ্দেশ্যে।

দ্বিতীয় দিনের শুরুতে টোটো নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। সাজগোজের চাকচিক্য বাদ রেখে হলদি নদীকে আবার দেখব বলে। টোটো ছুটল পিচের কালো রাস্তা ধরে। দুধারে ঘন ঝাউবন। অনেকক্ষণের ব্যবধানে ছুটে চলা কিছু স্থানীয় বাস ছাড়া আর কোনও গাড়ি-ঘোড়া নেই। শিল্পাঞ্চলের ধুলোয় ভরা ধূসর বাতাস এদিকে নেই। এক সময় টোটো থামল। একপাশে কিছু মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ পৌঁছে গেছে নদীর ধারে। বেশ কিছুক্ষণ সুন্দর সময় কাটিয়ে, নির্মল বাতাসে বুক ভরিয়ে আবার রওনা দিলাম। বি সি রায় হাসপাতালের পাশেই ঝাউবনে ঘেরা ছোট্ট পিকনিক স্পট সানসেট ভিউ পয়েন্ট।
আজ বিশ্বকর্মা পূজা। গোটা হলদিয়ায় উৎসবের সাজ সাজ রব। টোটো ছুটল বন্দরের উদ্দেশ্যে। এই একটা দিনই সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় হলদিয়া বন্দর। পাশেই বন্দর রেল স্টেশন। লোকাল ট্রেন স্টেশনে থামতেই মানুষের ঢল নেমে আসছে বন্দরের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে জনারণ্য। গেটের সামনে অন্তত কিলোমিটার খানেক লম্বা লাইন। পুজোর মণ্ডপ দেখে প্রবেশ করলাম বন্দরের সীমানায়। বিশাল বিশাল দেশি বিদেশি জাহাজ এসে ভিড়েছে বন্দরে। অন্তত ঘণ্টাখানেক বন্দরের ভেতরে চক্কর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

একথা স্বীকার করতেই হবে বিশ্বকর্মা পুজোই হলদিয়ার দুর্গাপূজা। গোটা রাস্তা ঢেকে দেওয়া হয়েছে আলোর জালে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আলো দিয়ে বানানো বিশাল বিশাল গেট। গানবাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে ছোটখাটো মেলা— সবমিলিয়ে উৎসবের আবহে জমজমাট আয়োজন। সন্ধের দিকে টোটো নিয়ে ছুটলাম পূজা পরিক্রমায়। যদিও ভিড়ের চাপে টোটো ছুটল কম, আমরা ছুটলাম বেশি। একে একে দেখলাম এক্সাইড, ইন্ডিয়ান অয়েল রিফাইনারি, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, মিৎসুবিশি কেমিক্যালসের পুজোর মণ্ডপ। কলকাতার দুর্গাপূজা বা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার মতো এখানেও পুজো হচ্ছে থিমভিত্তিক।
ফেরার পথে দেখলাম অন্ধকার আকাশের বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কলকারখানার সুউচ্চ টাওয়ার-কলম। হিরের গয়নার মতো জ্বলজ্বল করছে তাদের শরীরে জড়ানো আলোকমালা। আরও উপরে মিটমিট করে জ্বলছে লাল এভিয়েশন লাইট।
উৎসবে মেতে উঠেছে শিল্পনগরী। গোটা রাত জুড়ে চলবে বাংলার শ্রমিকদের আনন্দ উৎসব।

কাছেপিঠে ঘুরে দেখুন–
হলদিয়া থেকে বাস ধরে চৈতন্যপুর, এবং সেখান থেকে বাসে করে মহিষাদল যাওয়া যেতে পারে। দেখে নিন মহিষাদলের পুরনো এবং নতুন রাজবাড়ি। ঘুরে আসতে পারেন গেঁওখালি এবং গাদিয়াড়া।
হলদিয়া থেকে ট্রেন ধরে যেতে পারেন পাঁশকুড়ার পরের স্টেশন খিরাই। মরশুমি ফুলের চাষের জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চল। শীতের দিকে গেলে দেখতে পাবেন নানান ধরনের ফুলে রঙিন হয়ে থাকা এই অঞ্চল।
হলদিয়ার সানসেট ভিউ পয়েন্টে পিকনিক করা যেতে পারে। তার জন্য এইচডিএর থেকে বুকিং অবশ্যই প্রয়োজন।
নদীবক্ষে আমোদ আহ্লাদ
এইচডিএ কিছুদিনের মধ্যেই চালু করতে চলেছে হুগলি নদীর উপর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ভেসেলের ব্যবহার। ৩০ জনের একঘণ্টার নদী বিহারের খরচ ৪০০০ টাকা। অতিরিক্ত প্রতিজনের জন্য দেড়শ টাকা করে। তবে ন্যূনতম দু’ঘণ্টার বুকিং প্রয়োজন। যোগাযোগ: গৌতম চক্রবর্তী (৮১৭০০৪৫৬০৭) অথবা অর্পণ সামন্ত (৮১৭০০৪৫৬২৮)
নতুন পিকনিক স্পট
হলদিয়ার বালুঘাটা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে নতুন একটি পিকনিক স্পট ‘খোলা আকাশ’। নদীর ধারে, সবুজে মোড়া একফালি জায়গা। নদীর কুল কুল ধ্বনি শুনতে শুনতে, আর নানান পাখির ডাক শুনে বেশ কেটে যাবে একটা বেলা। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সহ মাথাপিছু খরচ ৪৫০ টাকা। যোগাযোগ,: ০৩২২৪-২৬৬৭৭২, ২৬৪৮১৩।
ইসকন মন্দির
ইসকনের একটি মন্দির সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হলদিয়াতে। বিসি রায় হসপিটাল এর পাশে অবস্থিত সেই মন্দিরে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করেই আসতে পারেন।

কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে সকাল ৬:১৫, ৯:৩২ এবং সন্ধ্যা ৬:০০ -এ রয়েছে হলদিয়া লোকাল— সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা। মেদিনীপুর বা খড়গপুরগামী ট্রেনে করে মেচেদা পৌঁছে, সেখান থেকে লোকাল বাসে চলে আসা যায় হলদিয়া (Haldia)। কলকাতার ধর্মতলার এস বি এস টি সি থেকে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় রয়েছে হলদিয়ার বাস। নদীপথে আসতে চাইলে প্রথমে ডায়মন্ডহারবার পৌছে সেখান থেকে লঞ্চ ধরে আসতে হবে কুঁকড়াহাটি। আবার সেখান থেকে বাস ধরে হলদিয়া।
কোথায় থাকবেন
www.hda.gov.in এর মাধ্যমে অনলাইনে বুক করতে পারেন হলদিয়া ভবন। এছাড়াও থাকতে পারেন সিটি সেন্টারের পাশে গোল্ডেন রিট্রিট হোটেলে। মঞ্জুশ্রী বা দুর্গাচক এলাকায় রয়েছে থাকার জন্য সাধারণ মানের বেশ কিছু হোটেল।
জেনে রাখুন
বিশ্বকর্মা পূজা হলদিয়ার প্রধান উৎসব। তবে হলদিয়া বন্দর সেই বছর সর্বসাধারণের জন্য খোলা হবে কিনা, তা সেখানকার আধিকারিকেরা ঠিক করে।
সাধারণত জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির শুরু অবধি চলে বিখ্যাত হলদিয়া মেলা। ( তারিখ জেনে তবেই আসুন)। রানিচক বাস স্ট্যান্ড বা বন্দর স্টেশন থেকে মেলার সতীশ সামন্ত মাঠ হাঁটা দূরত্ব।
হলদিয়ার এখানে-ওখানে ঘোরার জন্য টোটো সব থেকে ভালো উপায়
হলদিয়া পেট্রোক্যামিকালস লিমিটেডে কর্মরত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। নেশা ঘুরে বেড়ানো, আর বেরিয়ে এসেই তা লিখে ফেলা খাতার পাতায়। বেড়ানোর কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, আনন্দমেলা, ভ্রমণ, এই সময় পত্রিকায়।
One Response
Khub bhalo laglo pore