তখনও বর্ষার দাপটে তিস্তা বানভাসি হয়নি আর সিকিমেও ভয়াবহ বিপর্যয়ের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসেনি। ২০২৩-এর গ্রীষ্মেই প্ল্যান হল গ্যাংটকের। পড়শি রাজ্য সিকিমের ভ্রমণ-প্ল্যান ছকে দিলেন পাড়ার বন্ধু ট্যুর প্ল্যানার ইউনিকর্ন ট্র্যাভেলসের মি. শুভজিৎ ব্যানার্জি। কারণ সিকিমের প্ল্যানিংয়ে অত ভাবনাচিন্তার দরকার হয় না। যেন সংসারের রোজনামচা শিকেয় তুলে লোটাকম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল ছুটির দিনে। বাঙালির হঠাৎ ভ্রমণ, আবার ভ্রমণ, কিংবা কারণে অকারণে কাছেপিঠে ভ্রমণে সিকিমের জুড়ি নেই।
পূর্ব সিকিমের গ্যাংটক আর পশ্চিম সিকিমের পেলিং হল ভ্রমণপিপাসু বাঙালির অতি পছন্দের এক দ্বন্দ্ব সমাস। ঠিক উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত-মান্না, তেলেভাজা-মুড়ি কিংবা ইলিশ-চিংড়ির মতোই প্রিয় কম্বো। কাকে ছেড়ে কাকে ধরি! তাই গ্রীষ্মে হিমালয় যাবার প্ল্যান হলেই পড়শি রাজ্যের আরশিনগর গ্যাংটক-পেলিং মানিকজোড়ের কথা মাথায় এল।

উত্তরপূর্ব হিমালয়ের শিবালিক পর্বতশ্রেণীর মধ্যে সিকিমের রাজধানী শহর গ্যাংটক। তার সঙ্গের লেজুড় পেলিং, যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়াটাও উপরি পাওনা। এই নিয়ে বার তিনেক সিকিম। এবার অভিযান নাথুলার (Nathula) কারণে। প্রায় কয়েক হাজার বিচিত্র গাছপালা, কয়েকশো পাখিদের স্বর্গরাজ্য আর পাঁচশো প্রজাতির অর্কিডের শহর এই গ্যাংটক। সবুজ flora আর সজীব fauna-র অভিনব মিশেল সেখানে। এবারের ট্রিপে নাথুলা (Nathula) যাওয়ার প্ল্যান। ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে কালিম্পং-এ রাত্রিবাস করে পরদিনই গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
আরও পড়ুন: ঈশ্বরের আপন দেশে, পাহাড়ি বাগানবিলাসে
নাথুলার পারমিট সংক্রান্ত মেসেজ এল নাথুলা যাবার ঠিক আগের রাতে। এখানে কিন্তু আধার কার্ড চলে না। পারমিটের জন্য ভোটার কার্ড আর ছবি আবশ্যিক। সিকিম-চিন স্পর্শকাতর এক সীমান্ত। সেখানে খুব রাখঢাক। পাকদণ্ডি পথ বেয়ে ধাপে ধাপে উঠতে থাকি আর ঠান্ডা হাওয়ার রেশ এসে গা ছুঁলেই অনুভূত হয় সমতলি মানুষের দেহমনের আরাম।

আমাদের এগিয়ে চলা ছাঙ্গু লেক, নাথুলা ও বাবামন্দিরের উদ্দেশ্যে। চড়াই রাস্তা ধরে গাড়ি পৌঁছে গেল ৩৮ কিলোমিটার দূরবর্তী ১২,৪০০ ফুট উঁচু ছাঙ্গু লেকে। ছাঙ্গু লেকের স্থানীয় নাম ভুটিয়া ভাষায় ‘সোমগো’ (Tsomgo)। ‘Tso’ অর্থাৎ হ্রদ এবং ‘Mgo’ অর্থাৎ উৎস বা মাথা, এই দুটি শব্দ জুড়ে Tsomgo।
সেদিন আবার বৃষ্টির বিরাম নেই। তাই আগের বারের দেখা নীলরঙা জলের সঙ্গে এবারের ছাঙ্গুকে মেলাতে পারি না। তবুও নয়নাভিরাম। পরিযায়ী পাখির দল ভেসে বেড়ায় আপনমনে। থরে থরে বিশালাকায় চমরী গাই রাজকীয় সেজেগুজে সওয়ারি নেবার আবাহন জানায় ত্রস্ত পায়ে।
ছাঙ্গু প্রদক্ষিণ আরেক অভিজ্ঞতা। আগেরবারেই হয়েছে। এবারে বয়স বেশি, তাই রিস্ক নিতে ভয় করে। ছাঙ্গু থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরেই চিন সীমান্ত নাথুলা। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারেই চিনের সাম্রাজ্যের শুরু। অতন্দ্র প্রহরায় টহলদারি চিনা সৈনিকের। ১৪,৪৫০ ফুট উচ্চতার এই নাথুলা দিয়েই একসময় ভারত-চিন ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। তাই এটি সিল্ক রুটও বটে। এখন তা বন্ধ।
ঐতিহ্যগতভাবে নাথু লা নামের ইংরেজি অর্থ হল ‘হুইসলিং পাস’ বা কেউ বলে ‘listening ears’, মানে যে গিরিপথ সব শুনতে পায়। চিন সরকারের ভাষায় “a place where snow is deepest and the wind is strongest”। আর আক্ষরিক অর্থেই এই অঞ্চলের স্থানীয় লেপচা মানুষজন নাথুলাকে ma-tho hlo বা na tho lo বলে— যা থেকেই সম্ভবত বর্তমান শব্দের বিবর্তন।

নাথুলা যাবার পথের ভয়াবহতা তেমন নেই, তবে আচমকা তুষারধ্বস নেমে প্রায়শই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা ভয়ানক করে দিতে পারে। চোরা গ্লেসিয়ারের নততলের ওপর চড়ে বেদম দাপাদাপি করে কিছুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে দুই বাঙালি পর্যটকের। এ দুর্গম পথে সবকিছুই অনিশ্চিত। তবে যেতে যেতে ক্রমশই যখন গিরিপথের নৈকট্য অনুভূত হতে থাকে, তখন বদ্ধ গাড়ির মধ্যে বসে তেমন শীত না করলেও গাড়ি থেকে রাস্তায় নামলে শৈত্যপ্রবাহ মালুম দেয়। একের পর এক শীত পোশাকের স্তর তখন গায়ে চড়তেই থাকে।
পারদ নামতে নামতে শূন্য বা তার নীচে নেমেছিল মে মাসের মাঝামাঝি। বরফাচ্ছন্ন পথের দু পাশের মধ্যে দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করছিল একে একে। কিন্তু অতিমারীর পরে মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে এবার দেখলাম নাথুলা যেন কোলাহলপূর্ণ এক মেলাতলা হয়ে উঠেছে। থিকথিক করছে মানুষের ভিড়। আর তাদের সেলফি তোলার হিড়িকে ও একই সঙ্গে সম্মিলিত কলরবে নাথুলার সেরেনিটি কিছুটা হলেও যেন স্তিমিত। ঠিক প্রগাঢ় তুষারময় গিরিপথ দর্শনে যে নিমগ্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম লাদাখের খারদুংলা বা অরুণাচলের সেলা পাস গিয়ে, সেটায় এবার ঘাটতি। আসলে পশ্চিমবঙ্গবাসীর এত কাছে ১৪১৪০ ফুট উচ্চতায় এমন এক মোটরেবল গিরিপথ— সেটাই বড় গর্বের আমাদের কাছে। তাই অতিমারীর পরে ট্র্যাভেল-ট্যুরিজম শাইনিং দেখে মনের কোনায় একটা ফিলগুড ফ্যাক্টরও কাজ করে বৈকি।
ভারত ও তিব্বতকে সংযুক্ত করেছে এই নাথুলা গিরিপথ, তাই দু’দেশের সংস্কৃতি এখানে মিলেমিশে একাকার। শেরাথাং হল এখানে একটি সুপরিচিত সীমান্ত বাণিজ্য বাজার, যেখানে নিয়মিত একসময় চিনের সঙ্গে ভারতের তুমুল কেনাবেচা চলত।

টুপটাপ, ঝিরঝির, ঝমঝম নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছিল সেদিন। পাহাড়ের খামখেয়ালি বৃষ্টির ধারাই এমন। জল-কাদায় বরফে মাখামাখি রাস্তায় নেমেই আবারও উঠে বসি গাড়িতে। বড় কড়াকড়ি সীমান্তে। গাড়ি থামতে দেবে না। অতএব নিষ্ক্রমণ। ফেরার পথে এবারে জাগ্রত বাবামন্দিরে। তিনি এখানে আক্ষরিক অর্থেই হিরো।
দুর্ঘটনায় অকালমৃত ভারতীয় সেনার অন্যতম এই বাবা হলেন হরভজন সিংহ। যার স্মৃতিমন্দিরে মাথা ঠুকে প্রণাম জানিয়ে যাওয়ার রীতি এখানে। এই বাবা একজন প্রকৃত শহিদ। সদা সর্বদা অতন্দ্র প্রহরায় থাকেন। তিনি এখনও সব শুনতে ও দেখতে পান। সীমান্তের আগাম অশান্তির আভাস পেয়ে মানুষকে নাকি সচেতন করে চলেছেন এখনও। তাই এই সীমান্তের প্রকৃত ঈশ্বর তিনি।
বাবামন্দির থেকে নেমে আবারও ছাঙ্গু লেকে এসে ছবি তোলার পালা। মেঘলা দিনে সাদায় কালোয় ছাঙ্গুর রূপ বেশ রহস্যময়। জলের মধ্যে তুষারাবৃত পাহাড়ের ছায়া পড়ে এক অদ্ভূত সিমেট্রির ল্যান্ডস্কেপ রচনা করেছে। তার মাঝে টুকটুকে লাল জমকালো পোশাকে রাজকীয় চমরী গাইদের সওয়ারি নিয়ে তাদের মালিক দাঁড়িয়ে। লেক প্রদক্ষিণ করায় তারা। জম্পেশ ঠান্ডা ছাঙ্গুর ধারে। প্রকাণ্ড ছাঙ্গু লেকের দিকে তাকিয়ে থাকলে যেন পলক পড়ে না। তবে এবার সময় শেষ। ফিরে চলি গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে, রাস্তায় যদি কিছু গরম পানীয় পাওয়া যায় তার খোঁজে।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
One Response
সুন্দর সর্বত্র পূজ্যতে!