এখন গভীর রাত, নদীর দুই পাড় ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুম নেই শুধু নদীর চোখে। সে ছুটে চলেছে দেশ থেকে দেশান্তরে। বহতা এই নদী-উপত্যকাতেই বহু যুগ আগে গড়ে উঠেছিল মানুষের আদিম সভ্যতা।
সুদূর উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার বুক চিরে বয়ে চলা পৃথিবীর দীর্ঘতম এই নদী, নীলনদের (Nile) সঙ্গে আজই প্রথম পরিচয়। গতকাল সন্ধ্যায় মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে ট্রেনে রওনা হয়ে সকালে পৌঁছেছি প্রাচীন শহর আসোয়ানে, ও সেখান থেকে অপেক্ষমান বাসে ফেরিঘাটে। এখান থেকেই আমরা দেখে নেব ফিলে মন্দির। ঘাটের রাস্তার দুপাশে সারি সারি হস্তশিল্পের দোকান। কৃষ্ণবর্ণ, কুঞ্চিত কেশের দোকানিদের পরনে সাদা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক। এরা আফ্রিকান উপজাতি নুবিয়ান, মিশরের আদি অধিবাসী।
নীলনদের (Nile) বুকে ভেসে চলেছে লঞ্চ, তার টলটলে জলে গভীর মায়া। মাঝে মাঝে জল থেকে মাথা তুলে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ছোট ছোট দ্বীপ। ভাবতে রোমাঞ্চ লাগছে, ইতিহাস বইতে পড়া নদী আমার চোখের সামনে।
ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম ফিলে দ্বীপে।

প্রায় ৩০০০ বছরের বেশি পুরনো এই মন্দিরটি মিশরীয়দের মাতৃত্বের দেবী আইসিসের। মন্দিরের প্রবেশপথের দু’ধারে নানান কারুকার্য করা পাথরে তৈরি স্তম্ভের সারি, গ্রেকো-রোমান স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। তোরণদ্বারে পাইলনে খোদিত দেবদেবীর মূর্তি, ভিতরেও তাই।
নীলনদের ওপর বাঁধের ফলে মন্দিরটি জলের তলায় চলে যাচ্ছিল, ইউনেস্কোর সাহায্যে মন্দিরটি খণ্ড খণ্ড করে কেটে অন্য একটি দ্বীপে নিরাপদ উচ্চতায় এনে, পুনরায় জোড়া দিয়ে স্থাপন করা হয়। আকারে ছোট থাকায়, পাথর ফেলে দ্বীপটির আয়তন বৃদ্ধি করে নামকরণ করা হয় ‘ফিলে’। স্থাপত্য ও অবস্থান মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ ভারী মনোরম।
মন্দির দেখা শেষ করে ফেরিঘাটে পৌঁছে, বাসে চলে এলাম জাহাজঘাটায়। নীলনদের বুকে সারি সারি জাহাজ দাঁড়িয়ে। আমাদের জাহাজের নাম ‘লা বোহেমিয়া‘। স্টিলের পাটাতন পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই পাঁচতারা জাহাজটির অন্দরসজ্জা মুগ্ধ করে দিল। প্রথমেই সুসজ্জিত রিসেপশন কাউন্টার, পাশে বিশাল কনফারেন্স রুম। এরই নীচে সিঁড়ি তরতরিয়ে নেমে গেছে ডাইনিং-রুমের দিকে। চারতলার খোলা ডেকে সারি সারি আরামকেদারায় বিশ্রামের আহ্বান। দোতলা ও তিনতলায় মোট ৪০টি দ্বিশয্যা ঘরে যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা। তিনতলার একপাশে সুইমিং পুল ও অন্য পাশে ওপেন ডেক। বিলাসবহুল প্রতিটি ঘরের ওপারেই আছে নিজস্ব ব্যালকনি, যেখানে বসে দিব্যি গল্প করা যায় নদীর সাথে।

দুপুরের ভুরিভোজের পর ইচ্ছা ছিল একটু গড়িয়ে নেবার, কিন্তু গাইড ফারুকের তাড়ায় দৌড়লাম ফেরিঘাটের উদ্দেশে। নদীর পাড় ধরে চমৎকার বাঁধানো রাস্তা। জলে ভাসছে রং-বেরঙের জাহাজ আর বাহারি নৌকা। ঘাটে পৌঁছতেই সামনে চোখ আটকে গেল, ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে বিশাল বিশাল সাদা পালতোলা কাঠের নৌকা। এই নৌকাগুলিই তাহলে এতদিনের ছবিতে দেখা ফেলুকা! তড়িঘড়ি ক্যামেরা বার করতে যেতেই বেয়াকুব, ভুল করে ওটা জাহাজেই ফেলে এসেছি। অগত্যা মনখারাপ নিয়েই উঠে পড়লাম ফেলুকায়।
হাওয়ার টানে ভেসে চলেছে ফেলুকা। প্রায় ৩০-৪০ ফুট দীর্ঘ সাদা পালের নৌকাগুলি এখানকার বৈশিষ্ট্য। দাঁড় বায় দুজন, আর নৌকা চলে হাওয়ার টানে। দেখতে দেখতে মাঝনদীতে চলে এসেছি, চারপাশে কাচের মতো স্বচ্ছ সবুজাভ জল। নদীর এক পাড় সবুজ, অন্য পাড় ধূ ধূ মরুভূমি। উত্তর-বাহিনী নদীর বুকে আছে ছোট-বড় নানা দ্বীপ। পেরিয়ে এলাম প্ল্যানটেশন দ্বীপ। দেশ-বিদেশের গাছের সমাহারে এখানে তৈরি হয়েছে ছোট বোটানিক্যাল গার্ডেন। দূরে একটা ঘাট দেখা গেল। ঘাট পেরিয়ে বালি পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ওগুলি কী? কোনও মরুশহর বুঝি? বুঝে ওঠার আগেই এগিয়ে গেছে নৌকা।
আরও পড়ুন- ভ্রমণ: কেমন আছে অজন্তা?
আমাদের ফেলুকাটি চালাচ্ছে কৃষ্ণকায় প্রৌঢ় সোবেস্টান ও তার ছেলে। ওরা নুবিয়ান, অতীতে যাদের বাস ছিল মানবসভ্যতার লীলাভূমি মধ্য-নীল উপত্যকায়। কিছুক্ষণের মধ্যে গাইডের মাধ্যমে প্রস্তাব এল বাপ-ছেলে নাচবে, গাইবে এবং আমাদেরও ওদের সঙ্গী হতে হবে। সানন্দে রাজি হতেই, ওরা জিপসি জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বের করে গানের সঙ্গে নাচ শুরু করল। ভাষা না বুঝলেও সুরের মাদকতা ও ‘ও হো রে রে’ বলে কয়েকটি শব্দের অনুরণন আমদের আচ্ছন্ন করে ফেলল।

ঢুকে পড়েছি ফাঁড়িতে। কোথাও গাছ ঝুঁকে স্পর্শ করতে চাইছে নদীকে, কোথাও রচনা করেছে বনরাজি। নৌকার পাল হাওয়ায় উড়ে যেতে চাইছে আকাশের দিকে। বেলা শেষ হয়ে আসছে, দিনান্তের সবটুকু আলো মেখে নিয়ে নদী এখন মায়াবি। এবার ফেরার পালা, আজ মধ্যরাতে নতুন অভিযানে বেরোতে হবে। সন্ধ্যা ঘনাতেই, কিছুক্ষণ আগের স্বপ্নীল নদীর বুকে ছমছমে রহস্য।
জাহাজে ফিরে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিলাম, সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে। ৯টায় ডিনারের পর ঘোষণা করা হল, সবাইকে ১২.৩০ মিনিটের মধ্যে লাউঞ্জে মিলিত হতে হবে। আজকের গন্তব্য সুদান-সীমান্তের কাছে আবু-সিম্বেল মন্দির। ঠিক সময়ে প্যাকড ব্রেকফাস্ট হাতে জাহাজের বাইরে পা রাখলাম। আলো ঝলমল নিশুতি রাতে সাহারা মরুভূমির বুক চিরে ছুটে বাস ভোর ৪.১৫ মিঃ আমাদের পৌঁছে দিল নাসের হ্রদের কাছে। নীলনদের প্রলয়ঙ্কর বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য বাঁধ দেওয়ার ফলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি।

টিকিট হাতে পাবার পর বেশ খানিকটা হেঁটে মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছলাম। এখানে দুটি মন্দির— রাজা ও রানির। আগে মন্দির দুটি নীলনদের ধারে ছিল, কিন্তু বাঁধ দেওয়ার সময় মন্দিরগুলি জলের তলায় চলে যাওয়ার উপক্রম হলে, সারা বিশ্বের স্থাপত্যবিদদের বিস্ময়কর প্রচেষ্টায় মন্দিরদুটি একটি উঁচু জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়।
আজ ২২ ফেব্রুয়ারি, ফ্যারাও দ্বিতীয় রামোসিসের রাজ্যাভিষেকের দিন। এইদিন ও রাজার জন্মদিন ২২ অক্টোবর এখানে পৃথিবীখ্যাত সান ফেস্টিভ্যাল পালন করা হয়। আজ তাই বিশ্বের নানান প্রান্তের মানুষের জমায়েত এখানে। পূর্বাকাশে সূর্য উঁকি দিতেই বেজে উঠল শিঙা, কাড়া–নাকাড়া। প্রাঙ্গণ জুড়ে শুরু হল নাচ। অরুণ আলোর রশ্মি গর্ভগৃহে প্রবেশ করে আলোকিত করল রামোসিস ও দুই সূর্যদেবতা আমণ-রা-র মুখমণ্ডল। শুরু হল সূর্য-বন্দনা। নানা দেশের নৃত্য-গীতের মূর্ছনা, মুহূর্তের মধ্যে আমাদেরও সামিল করে ফেলল সেই আনন্দযজ্ঞে।
মিশরের মন্দির মানেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের সংমিশ্রণ। এখানে প্রথম মন্দিরটি ফ্যারাও দ্বিতীয় রামোসিসের, অন্যটি তাঁর প্রিয়তমা মহিষী নেফারতারির। বিশাল মরুপ্রান্তরের মাঝে মন্দিরদুটির স্থাপত্য, অলংকরণ সত্যিই আকর্ষণীয়।
মন্দির দেখার শেষে এবার ফেরার পালা। আমাদের দেখে স্থানীয়রা অনেকেই এগিয়ে এসে ছবি তুলল, মেয়েরা গভীর চুম্বন এঁকে দিল গালে। এরা অনেকেই নুবিয়ান, যাদের বাসভূমি ছিল নীলনদের দুই তীরে। নাসের হ্রদ সৃষ্টির সময়ে এদের ভিটেমাটি বিলীন হয়ে গিয়েছিল জলের তলায়। বোঝার উপায় নেই এদের প্রাণোচ্ছলতা ও দরাজ হাসির আড়ালে চাপা পড়ে আছে একরাশ বুকফাটা কান্না।

বাস ছুটছে ঝড়ের গতিতে। মসৃণ রাস্তার দুপাশে বিশ্বের বৃহত্তম মরুভূমি সাহারার লালচে বালির রুক্ষ্ম প্রান্তর। প্রায় সমতল মরুভূমির কোথাও কোথাও অল্প বালিয়াড়ি ও কাঁটাগুল্ম দেখা যাচ্ছে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস, মরুভূমির শীতকাল। এরপর বালি উত্তপ্ত হয়ে ঝড় উঠবে মরুপ্রান্তরে।
গত কয়েকদিন ধরে ঝড়ের মতো ঘুরছি, আজ জাহাজে ফিরে বিশ্রাম। দুপুরে খাওয়ার পর কেবিন-সংলগ্ন ব্যালকনিতে এসে বসলাম। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ধরছে শরীরে। নদীর বুকে ভাসছে ফেলুকা। তাদের দীর্ঘ পালগুলি দুলে দুলে অবিরাম কানাকানি করছে বাতাসের সঙ্গে। অগুণতি ক্রুজ চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। ছোট কাঠের নৌকা বাইছে একলা মাঝি। নদীর কলকল শব্দে ভেসে আসে তার জন্ম-কাহিনি। সুদূর অতীতে উগান্ডার ভিক্টোরিয়া লেক থেকে জন্ম নিয়েছিল ‘হোয়াইট নাইল‘-এর একটি উৎস, অন্য দিকে ইথিওপিয়ার টানা হ্রদ থেকে ‘ব্লু-নাইল‘-এর একটি উৎস বের হয়েছিল অসীম কৌতূহলে। চলতে চলতে এই দুই নদীর দেখা হয় সুদানের রাজধানী খাটুমের কাছে। এদের মিলিত ধারা মিশরে ঢুকে পড়ে নাসের হ্রদের কাছে। এরপর ২০০০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে, দুপাশের মরুভূমিকে উর্বর করে লীন হয় ভূমধ্যসাগরে। চলার পথে এই নদী সমৃদ্ধ করেছে আফ্রিকার ৯টি রাষ্ট্র বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়া ও মিশরকে। মজার ব্যাপার হল, এই রাষ্ট্রগুলির প্রত্যেকের জলবায়ু আলাদা।
নদীর কথা ভাবতে ভাবতে দিন শেষ হয়ে আসে, বিদায় নেবার আগে দিবাকর তার সবটুকু আলো ঢেলে দেয় নদীর বুকে। পড়ন্ত বেলায় সিগালেরা চেঁচামেচি করে জানান দেয়, নীড়ে ফিরতে হবে। নদী তীরের আসোয়ান সেজে ওঠে আলোকসজ্জায়। এই শহরের নামের মধ্যে একটা গল্প লুকিয়ে আছে। সোয়ান মানে ব্যবসা। সভ্যতার আদিম যুগে আফ্রিকার অন্যান্য অংশের সঙ্গে ব্যবসায়িক আদানপ্রদানের জন্য এই শহর গড়ে উঠেছিল। ফ্যারাওদের আমলে শহরটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অন্য কারণে। আসোয়ানে অতি উচ্চমানের গ্রানাইট পাথর পাওয়া যায়। মিশরের সমস্ত মন্দির, পিরামিড ও মূর্তি এই পাথরেই তৈরি।
পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons
প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক, ভ্রামণিক, পর্বত-পদযাত্রী, ভ্রমণ লেখক, ট্রাভেল রাইটার্স ফোরামের সদস্য...