“আরে ম্যাডাম আপ তো হাস রাহে হ্যায়। ম্যায় তো সোচ রহ থা আপ যাদা বাতচিত করনা ইয়া হাসনা পসন্দ নেহি করতে হ্যায়” ……..আমাদের গাড়ির চালক ধরম’জির মুখে ওই কথা শুনে অনিন্দ্য তো ভিরমি খেলো। আমি অপটু হিন্দিতে বললাম “না না… আমি খুব কথা বলতে ও হাসতে পছন্দ করি। কিন্তু গত আড়াই দিন ধরে এত জার্নি করেছি সব হাসি শুকিয়ে গেছিল ভাইসাব।”
গত বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এক বিকেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী চেপে বসেছিলাম রাজধানী এক্সপ্রেসে। পরদিন দুপুরে নিউ দিল্লি। রেল স্টেশন থেকে ওলা ধরে ISBT বাস স্ট্যান্ড। বিকেলের বাস ধরে রাতদুপুরে দেরাদুন। রাতটা কোনওরকমে দুচোখ এক করে কাটিয়ে, পরদিন সাতসকালে দেরাদুন থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘণ্টা পাঁচেকের জার্নিতে আমরা পৌঁছলাম উত্তরকাশী। সেই রাতটা গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের গেস্ট হাউসে কাটিয়ে সকালে ধরম সিং পাওয়ারের গাড়িতে উত্তরকাশী থেকে রওনা হলাম হরশিল (Harsil) অভিমুখে। কলকাতা থেকে ক্রমাগত পথ চলা আর গাড়ি বদল করতে করতে শারীরিক ধকলের কারণে মুখের হাসি, প্রাণের কথা— সবই তখন প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়।

উত্তরকাশী ছেড়ে যত এগোচ্ছি, প্রকৃতি নিজের রূপের ভাণ্ডার যেন মেলে ধরছে চোখের সামনে। একপাশে সবুজ পাহাড় আর অপর পাশে সঙ্গী হয়েছে ভাগীরথী নদী। আধঘণ্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম খেদি জলপ্রপাত। রামধনুর সাতরঙে রাঙা ঝরনা। সবুজের সমারোহ আর নিস্তব্ধতা জায়গাটিকে ছবির মতো সুন্দর করে তুলেছে। গাড়ি থেকে নেমে কয়েকটা দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলাম। সব কষ্ট ভুলে মনটা এক লহমায় খুশিতে ভরে উঠল, আর তাই দেখে ধরম’জি বলে উঠলেন, “আরে ম্যাডাম, আপ তো হাস রহে হ্যায়…”
জলপ্রপাত ছাড়িয়ে অল্প এগোলেই মানেরি। এখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। তাই ভাগীরথী নদী এক বিশাল হ্রদের মতো স্নিগ্ধ। পাশেই গাড়োয়াল মণ্ডলের ট্যুরিস্ট বাংলো। একটা রাত এই নির্জনতায় কাটাতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু আমাদের হাতে যে সময় কম। গাড়ি চলতে থাকে। ডান হাতে দেখি বিশাল এক শিবমূর্তি বিরাজমান। তার পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী। এক স্বর্গীয় রূপ উপভোগ করলাম। মহাদেবকে প্রণাম জানিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল হরশিল অভিমুখে। যত এগোচ্ছি পথের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছি। মাথার ওপর নীল আকাশ, সঙ্গে বয়ে চলেছে পান্না-সবুজ ভাগীরথী। পাশে তুষারাবৃত পর্বত হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বারবার গাড়ি থামিয়ে অপরূপা হিমালয়ের রূপকে উপভোগ করছি আমরা।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম হরশিল। রজতশুভ্র পর্বতরাজি ঘিরে রেখেছে এই ছোট পাহাড়ি গ্রামটিকে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম জায়গাটার। কয়েকটি দোকান নিয়ে একটা ছোট বাজার এলাকায় আমাদের গাড়ি থামল। সেখান থেকে অল্প হাঁটাপথে পৌঁছলাম GMVN-এর অতিথিশালায়— আমাদের আগামী দুটি রাত্রির আশ্রয়স্থল। পৌঁছনোর সাথে সাথে কেয়ারটেকার ভদ্রলোকের উষ্ণ অভ্যর্থনা ভালো লাগল। অসময়ে পাহাড়ে গেলে দুটো জিনিস বিনামূল্যে জুটে যায়— মন ভরানো আতিথেয়তা আর শান্তির নিস্তব্ধতা। উপর নীচে সব রুম ফাঁকা। পছন্দ মতো একটি রুমে ঢুকে দেখলাম অতিথিশালার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী, আর ঘরের সম্মুখে তুষারের চাদর মুড়ি দিয়ে পর্বতশৃঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সূয্যি পাটে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আক্রমণ করল আমাদের। ট্যুরিস্ট লজের লেপের সঙ্গে বাড়ি থেকে আনা স্লিপিং ব্যাগ গায়ে চাপিয়ে কোনওমতে সেই ঠান্ডাকে বাগে আনা হল।

পরেরদিন সকালে ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি সূর্যোদয় হচ্ছে। রজতশুভ্র শৃঙ্গ এখন স্বর্ণালী হয়ে উঠেছে। সোনা রঙে চিকচিক করছে ভাগীরথীর জল। ওদিকে পাইপের জল সব জমে বরফ। ট্যাপের মুখ থেকে বোধহয় জল গড়িয়ে পড়ছিল। সেটাও বরফ হয়ে ঝুলে আছে। লজের রাঁধুনি মুকেশ চা-বিস্কুট বাড়িয়ে দেয়। সে পাট চুকিয়ে, আর দেরি না করে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হরশিল দেখতে।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ফ্রেডরিক উইলসন নামে একজন ব্রিটিশ হরশিলে বসবাস শুরু করেন কাঠ-ব্যবসার সূত্রে। স্থানীয় এক পাহাড়ি মহিলাকে বিয়ে করে এখানেই স্থায়ী ঠাঁই গাড়েন উইলসন। তাঁকে বলা হত ‘রাজা উইলসন’। ইনি হরশিলে প্রথম আপেল বাগান করেন এবং আজ হরশিলের আপেল জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের দরবারে। তবে আমরা ডিসেম্বর মাসে গেছি বলে অনেক আপেল গাছ দেখলেও, গাছে আপেলের দেখা তেমন পাইনি। যেগুলো রয়েছে তারা খাওয়ার উপযুক্ত নয়।

GMVN–এর অনতিদূরে রয়েছে সেই পোস্ট অফিস যেখানে রাজ কাপুর পরিচালিত এবং মন্দাকিনী অভিনীত ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল। দরজার ওপরে সেই ছবির একটি দৃশ্য আজও সেই স্মৃতি বহন করছে। পোস্ট অফিস পেরিয়ে হরশিলের বাজারে পৌঁছলাম। মরশুমে কতটা জমজমাট থাকে জানি না, এখন স্রেফ কয়েকটা খাবার দোকান, আর কয়েকটা গরম পোশাকের দোকান খোলা। স্থানীয় মহিলারা সেখানে স্থানীয় উল দিয়ে নিজেদের হাতে বোনা গ্লাভস, টুপি, জ্যাকেট ইত্যাদি বিক্রি করছেন। খাবারের দোকানে আরেক রাউন্ড ধোঁয়া ওঠা চা আর গরম গরম মোমো খেয়ে, উলের দোকানে কয়েকটা গ্লাভস পছন্দ করে, টাকা দিয়ে রেখে দিলাম। গ্রাম দেখে ঘরে ফেরার পথে নিয়ে নেব।

উইলসন যে প্রাসাদোপম কাঠের বাংলোয় থাকতেন, সেটা কয়েক বছর হল আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। তার উল্টোদিকে একটা পথ গিয়েছে ভাগীরথী পাড়ের লক্ষ্মী-নারায়ণের মন্দির। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে। মন্দিরটি নানারকম গাছ ও বিভিন্ন ফুলগাছ দিয়ে সজ্জিত। চারপাশে তুষারশৃঙ্গ ঘিরে রয়েছে। অনতিদূরে ভাগীরথী বয়ে চলেছে কুলকুল রবে। একটা স্বপ্নিল পরিবেশ বিরাজ করছে। আপাতত জনশূন্য মন্দিরে এক বাঙালি সাধুবাবার দেখা পেলাম। উনি দীর্ঘদিন ধরে এই মন্দিরে আছেন। নিত্য পূজা করেন।
বাবাজী আতিথেয়তা করে মন্দিরের আপেল গাছের দুটি আপেল খাওয়ালেন। এগুলি আগে থেকে উনি ঘরে মজুত রেখেছিলেন।
ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম বাগোরি (Bagori) গ্রামের দিকে। হরশিল থেকে বাগোরির পথে বেশ কয়েকটা ব্রিজ পেরোতে হয়। মজার ব্যপার হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগের নীচে কোনও নদীনালা নেই। হয়তো বর্ষাকালে জলস্রোত বয়ে যায়। চঞ্চলা জলন্ধরি নদী পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই পৌঁছে গেলাম বাগোরি গ্রাম।

গ্রামের মুখে পৌঁছতেই ঠান্ডা কনকনে হাওয়া শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। কিন্তু ছবির মতো সুন্দর গ্রামটা মন ভরিয়ে তুলল। বরফঢাকা পর্বত ঘেরা ছোট্ট গ্রামটিতে ভুটিয়ারা বাস করেন। তবে শীতের জন্য প্রায় কেউ এখন গ্রামে নেই। বাড়ির পর বাড়ি বাইরে থেকে তালাবন্ধ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও এই গ্রামটিতে বিশেষ দ্রষ্টব্য এখানকার দেওয়ালচিত্র। প্রতিটা বাড়ির দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর রঙিন ছবি আঁকা রয়েছে। তাতে কখনও ফুটে উঠেছে গ্রামের প্রধান শিল্পকলা উলবোনার ছবি, কখনও বিভিন্ন পশু, স্থানীয় মানুষের রোজনামচার ছবিও মিলবে এখানকার দেওয়ালে। হরশিল বাজারেও এমন রঙিন গ্রাফিতি দেখেছি।

দুপাশে বন্ধ দরজা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটি পাঁচিলঘেরা বাড়ির গেটটা অল্প খোলা দেখলাম। বাইরে লেখা ‘Pure apple juice’। গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়া তো ভাগ্যে নেই, জ্যুসই না হয় জুটুক। গেট ঠেলে ঢুকতেই দেখি একজন পুরুষ কিছু কাজ করছেন। ভদ্রলোক জানালেন ওঁরা হোম স্টে ভাড়া দেন। এখন অসময়ে কোনও অতিথি নেই। আমরা ঘর দেখতে চাওয়ায়, উনি ঘর খুলে দিয়ে চলে গেলেন আমাদের জন্য আপেল জ্যুস আনতে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর, কাঠের দেওয়াল, আসবাবপত্র, ওয়েস্টার্ন টয়লেট। কিন্তু ঠান্ডাটা একটু বেশি মনে হল। ইতিমধ্যে আপেল জ্যুস এসে গেছে। বিশাল এক বিয়ার মগ ভর্তি ঠান্ডা সুমিষ্ট আপেল রস, যেন অমৃত। দাম মাত্র পঞ্চাশ টাকা। জ্যুস খেতে খেতে চোখ গেল ঘড়ির দিকে। বেলা অনেক হয়েছে। ট্যুরিস্ট লজে লাঞ্চ করতে হবে। ভবিষ্যতে আবার কখনও বাগোরি এসে ওঁদের বাড়িতে রাত কাটাব— এই ইচ্ছা নিয়ে রওনা দিলাম হরশিলের পথে।
*ছবি সৌজন্য: লেখিকা
ভ্রামণিক, লেখিকা এবং ফটোগ্রাফার।
4 Responses
ভালো লাগল লেখাটা। 👌
বাহ
নতুন জায়গার হদিশ পেলাম ।ভাল লাগল ।
বহুবছর আগে বাসে গঙ্গোত্রী যেতে গিয়ে হঠাৎ নেমে পড়েছিলাম হরসিল। সাথে আমার বয়স্কা মা, স্ত্রী ও ছোট ছোট দুই কন্যা। ওখানে তখন সদ্য নির্মিত একটি মাত্র থাকার জায়গা। হরসিল আমায় মুগ্ধ করে দিয়েছে।