(Gopalpur Chitrokote)
এবার পুরনোকেই ফিরে দেখার ইচ্ছে। তবে মূল আকর্ষণ চিত্রকোট জলপ্রপাত। আরো ভালোভাবে বললে, চিত্রকোটের গা ঘেঁষে থাকা ডান্ডামি রিসোর্টে রাত্রিবাস। সেক্ষেত্রে পৌঁছতে হবে জগদলপুর। অধিকাংশ পর্যটক বিশাখাপত্তনম হয়ে জগদলপুর যান, যাওয়ার বা ফেরার পথে ঘুরে নেন আরাকু। সেখানে সমস্যা হলো, দুটি মাত্র ট্রেন। একটি কিরণডুল প্যাসেঞ্জার, যাতে সারাদিন জার্নি করার ধৈর্য আমার নেই। আর একটি এক্সপ্রেস ট্রেন আছে, যা পৌছয় ভোররাতে। কিন্তু ডান্ডামি রিসোর্টে চেক ইন টাইম বেলা দুটো। কোলকাতা থেকে একটা সরাসরি ট্রেন আছে, সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস, পৌঁছয় রাত ১০টায়, মানে আরো ঝামেলা। (Gopalpur Chitrokote)
দেখলাম, ভুবনেশ্বর থেকে ছেড়ে হীরাখন্ড এক্সপ্রেস বেলা ১১টায় পৌঁছয়। মাথায় এলো, যদি আগেই বেরহামপুর পৌঁছে গোপালপুর ঘুরে তারপর জগদলপুর যাই, তাহলে গোপালপুরের পুরোনো স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। হিসাব করে দেখলাম, ফেরার পথেও হীরাখন্ড এক্সপ্রেস সুবিধাজনক। এবার ভুবনেশ্বর যখন আসতেই হচ্ছে, তখন বাঙালির চিরচেনা পুরীই বা বাদ থাকে কেন! সুতরাং, পুরো প্ল্যানটা দাঁড়ালো গোপালপুর, চিত্রকোট, পুরী। (Gopalpur Chitrokote)

তবে এবারের ভ্রমণ টিক দিয়ে দিয়ে ঘোরা নয়, শুধুই গা এলিয়ে বসে থেকে সমুদ্র দেখে বা চিত্রকোটের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাবো। নির্দিষ্ট দিনে রাত পৌনে বারোটায় চেন্নাই মেল। পরদিন ৬০০ কিলোমিটার যেতে মাত্র ঘন্টা খানেক লেটে পৌঁছে দিলো বেরহামপুর। একটা অটো নিয়ে গোপালপুর। হোটেল ঠিক করাই ছিল। ঘরে ঢুকে আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সাথে কথাবার্তা সেরে নিয়ে তারপর স্নান-খাওয়া সেরে হালকা একটু দিবানিদ্রা। বিকেল হতে না হতেই ক্যামেরা বাগিয়ে সমুদ্রের বালিতে। (Gopalpur Chitrokote)
রাত বাড়ে, ধীরে ধীরে কমতে কমতে একসময় নিভে যায় সৈকতের আলো, থামে কোলাহল। নির্জন সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকে অস্থায়ী দোকানের বাঁশগুলো। সন্ধ্যে থেকে ঘুরে যাওয়া লাইট হাউসের আলোটা অসহায়ের মতো এতক্ষণ চাপা পড়ে ছিল, এখন সে দৃশ্যমান। জোয়ারের জল নিয়ে সগর্জনে দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্র। হোটেলের বারান্দায় বসে শুনি সেই গর্জন, দেখি ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার নাচ।
পুরোনো স্মৃতিকে তার মত থাকতে দেওয়াই ভালো, পাল্টানো সময়ে তাকে আবার খুঁজতে গেলে দুঃখই বাড়ে। একাধিকবার সেই প্রমাণ পেয়েছি, তবু ঘুরে দেখতে মন চায়। আর সেই টানেই ২০ বছরেরও বেশী সময় আগে ঘুরে যাওয়া গোপালপুরে আসা। মন খারাপের ধাক্কাটা সামলে পুরনো সেই ছবিটা একটু মনে করি। হাতেগোনা গুটিকয়েক হোটেল, সৈকতে নামার সিঁড়ির সামনে একটুখানি আলোকিত অংশ বড় সংকোচে আলো দিচ্ছে। নিকষ অন্ধকার সৈকত আর সমুদ্রকে আলাদা করতে দেয় না। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার তরবারি নিয়ে সমুদ্র তার সীমানা চিহ্নিত করছে কখনও আগ্রাসী ভঙ্গিতে এগিয়ে, কখনও একটু পিছিয়ে গিয়ে শক্তি সঞ্চয়। এক অদ্ভুত রহস্যময় চিত্রকল্প।(Gopalpur Chitrokote)

আর এবার! বিস্তীর্ণ আলোকোজ্জ্বল বসার জায়গা, সেখানে ভুট্টাসেদ্ধ, কাবাব সমেত রকমারি খাবার তো আছেই, তার সাথে বাচ্চাদের রিমোট গাড়ি, ঘুরতে থাকা প্লাটফর্মে ছোট বড় সকলের বিচিত্র ভঙ্গিতে মোবাইলে মুভি করা। সৈকতময় বিকিকিনির আলো দেখে সমুদ্র ভয়ে ভয়ে পা ফেলে। বিচিত্র শব্দের অনুপ্রবেশ, যেন সমুদ্রের গর্জনকে দাবিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায়। স্মৃতিটুকু থেকে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। (Gopalpur Chitrokote)

রাত বাড়ে, ধীরে ধীরে কমতে কমতে একসময় নিভে যায় সৈকতের আলো, থামে কোলাহল। নির্জন সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকে অস্থায়ী দোকানের বাঁশগুলো। সন্ধ্যে থেকে ঘুরে যাওয়া লাইট হাউসের আলোটা অসহায়ের মতো এতক্ষণ চাপা পড়ে ছিল, এখন সে দৃশ্যমান। জোয়ারের জল নিয়ে সগর্জনে দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্র। হোটেলের বারান্দায় বসে শুনি সেই গর্জন, দেখি ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার নাচ। কান পেতে বুঝি, সেই গর্জনের মধ্যে আছে নিজেকে মেলে ধরা, ফিরে আসার আমন্ত্রণ। জোয়ারের জল আছড়ে পড়ার শব্দ মন ভালো করে দেয়। আসলে গোপালপুরের সৈকতে স্থানীয় এলাকার মানুষের ভিড় বেশি। বাইক নিয়ে এসে বিকেল সন্ধ্যাটুকু কাটিয়ে, ফিরে যায়। ফলে রাত ৮ টার পর সৈকত খালি হতে শুরু করে।
ভোরবেলাতে বা স্নানের সময়ও ভিড় বিশেষ নেই। তবে সবসময়েই বিরক্তির কারণ অস্থায়ী দোকানের বাঁশের ভিড়। (Gopalpur Chitrokote)
অস্তগামী সূর্যের আলোয় মোহময় দেখায় চিত্রকোটকে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর, অন্ধকারেও সবেগে আছড়ে পড়া বিপুল জলরাশির আভাস পাওয়া যায়, গর্জন কানে আসে। মন ভরে যায়। কাল সকালে নতুন করে দেখা পাওয়ার অপেক্ষায়।
এদিকসেদিক কোথাও যাওয়ার প্ল্যান নেই। সি বীচে কাটিয়ে ঘরে ফিরে আসি। চেয়ার বাগিয়ে বসি সমুদ্রমুখী বারান্দায়।
রাত দশটায় বেরহামপুর থেকে ট্রেন, নটার সময় গোপালপুর ছেড়ে আবার অটোয় রওনা। এবার ট্রেন একঘন্টা লেট, ষ্টেশনে বসে মশার কামড় খেয়ে সময় কাটাই। ট্রেনে উঠেই ঘুম। সকালে রায়গাড়া ছাড়ার পর ঘুম ভাঙে, ট্রেন অনেকটাই লেটে চলছে। কিন্তু জানলা দিয়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা নিশ্চিতভাবেই বিরক্তি আসতে দেবে না। কোরাপুট, জেপুর পর্যন্ত অসংখ্য টানেল আর আঁকাবাঁকা অনুচ্চ পাহাড়ি পথ মন ভালো করে দেয়। অবশেষে একঘন্টা লেটে রেলযাত্রা শেষ হলো জগদলপুরে। (Gopalpur Chitrokote)

একটা গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চললাম চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের ডান্ডামি রিসোর্টের দিকে। বেলা দুটোয় চেক ইন হলেও ঘন্টাখানেক আগেই আমরা ঘর পেয়ে যাই, বরং প্রথম আসার সুবাদে ২০১ নম্বর, মানে সেরা লগহাটটাই পেয়ে যাই। ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকের দেওয়াল জোড়া কাঁচের দরজার পর্দা সরালেই চিত্রকোট। কাঁচের স্লাইডিং দরজা সরিয়ে বিরাট বারান্দায় পা দিয়ে বাকরুদ্ধ। চিত্রকোট জলপ্রপাত, ইন্দ্রাবতী নদীর উপর ভারতের নায়াগ্রা নামে খ্যাত এই জলপ্রপাতটি ৯৫ ফুট উঁচু পাথরের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ব্যাপ্তিতে ৩৮০ ফুট, এই সব তথ্য দিয়ে চিত্রকোটকে অনুভব করা যাবে না। (Gopalpur Chitrokote)

বর্ষা শেষের নদীর ঘোলা জল গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, দিনের দ্বিতীয়ার্ধের সূর্যের আলোয় তা সোনালী রঙ নিচ্ছে। জলের তোড় এতটাই বেশী যে ধোঁয়ার মতো জলকণা পাক খেয়ে উঠছে। কখনও কখনও তাতে নাকি রামধনুও দেখা যায়। এখন তা দেখা যাচ্ছে না, তবে দুদিন আছি, আশাকরি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। মধ্যবিত্ত পকেটের উপর একটু বেশী চাপ হলেও, ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের ডান্ডামি রিসোর্টে রয়েছি শুধু এই দৃশ্যের জন্যই। দুটো দিন এখানে বসে চিত্রকোটের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এবারের আসা। (Gopalpur Chitrokote)

আগেরবার যখন এসেছিলাম, জগদলপুরে রাত্রিবাস করে এখানে এসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে গিয়েছিলাম অতৃপ্তি নিয়ে। তা সুদে আসলে পুষিয়ে নিতেই এবার এই আনন্দের শেষ বিন্দুটুকু শুষে নিতে আসা। বারান্দায় বসে অপলক চেয়ে থাকি। অস্তগামী সূর্যের আলোয় বড় মোহময় দেখায় চিত্রকোটকে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর অন্ধকারেও সবেগে আছড়ে পড়া বিপুল জলরাশির আভাস পাওয়া যায়, গর্জন কানে আসে। মন ভরে যায়। কাল সকালে নতুন করে দেখা পাওয়ার অপেক্ষায়।
সকালে হাঁটতে বেরোই। ডান্ডামি রিসোর্টের ভিতরে হেঁটে বেড়াতেও বেশ ভালো লাগে। অসংখ্য পাখি, গাছ। সামান্য হেঁটে পৌঁছে যাই জলপ্রপাতের সামনে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নদীর ধারে নেমে যাই। জলকণা পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় মুখে, মাথায়, চোখে। এখন জল খুব বেশি, তাই নৌকা চলছে না। নাহলে নৌকা করে নদীর বুকে খানিক দূর যাওয়া যায়। ফিরে আসি, বারান্দায় বসে চিত্রকোটের দিকে তাকিয়ে, প্রজাপতি দেখে, পাখির ডাক শুনে দিনটা স্বপ্নের মত কেটে যায়।

আজ এই স্বপ্নপুরী ছেড়ে যাওয়া। বেলা ১১টায় গাড়ি আসবে। তার আগে লোভীর মত যতটা পারি তাকিয়ে থাকি চিত্রকোটের দিকে। তারপরে যাত্রা জগদলপুরের আরেক সুন্দরী তিরথগড় জলপ্রপাতের দিকে। কাঙ্গেরঘাটি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে জঙ্গলে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর রাস্তা টপকে পৌঁছে গেলাম। কাঙ্গের নদীর উপর প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু এই প্রপাত ধাপে ধাপে নেমে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে প্রপাতের গোড়ায় নেমে গেলাম। একাংশে প্রবল জলধারা গর্জন করে নেমে আসছে, আরেক অংশে জলধারা শান্ত, যেন নূপুর পায়ে নেচে চলেছে। সেখানে অনেকেই স্নানও করছেন। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসি গাড়িতে। এবার জগদলপুর থেকে ফিরতি হীরাখন্ড এক্সপ্রেস, ভুবনেশ্বর হয়ে পুরীর পথে।(Gopalpur Chitrokote)
বাঙালীর কাছে পুরীর গল্প করা, আর মায়ের কাছে মাসির গল্প বলা সমান, তাই সেই চেষ্টাই করলাম না। মনের মণিকোঠায় স্মৃতি হয়ে থাক উচ্ছ্বল চিত্রকোট আর তার গম্ভীর গর্জন। (Gopalpur Chitrokote)
ছবি সৌজন্য: লেখক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর।পেশায় শিক্ষক। বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ফোটোগ্রাফির ডিপ্লোমা। ভালোবাসেন বেড়াতে, ছবি তুলতে আর পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।
