মেঘালয়ের বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা সংখ্যায় কম হলেও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং তার প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কঙ স্পেলিটি তাঁদের আদর্শ। তার উপরে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন তো হাতের মুঠোয় এসে গেছে পৃথিবীর যাবতীয় খবরাখবর। ঝাড়খণ্ডের যাদুগোড়ার খবর আর এখন গোপন নয়। যাদুগোড়ায় ইউসিআইএল-এর কাজকর্ম শুরুর পর আশপাশের এলাকায় যক্ষ্মা ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। সন্তানসম্ভবা মেয়েদের মধ্যে গর্ভপাতের মাত্রা বাড়তে থাকে। চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত ছিলেন যে ইউরেনিয়াম খনন এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য এইসব ঘটনা ঘটছে। তবে তাঁরা প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও প্রযুক্তিবিজ্ঞান চিকিৎসাশাস্ত্র অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত অ্যাকাডেমিক পত্রপত্রিকায় গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আর সেই সুবাদেই সকলের জানা হয়ে গেছে যে খনি থেকে ইউরেনিয়াম তোলার প্রক্রিয়া পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের থেকে কম বিপজ্জনক নয়।
[the_ad id=”270084″]
ততদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কলোরাডো নদীর গিরিখাত জুড়ে বসবাসকারী নাভাজো জনজাতির খবর সকলের কাছে পৌঁছে গেছে। নাভাজো জনজাতির লোককথায় দুই ধরনের হলুদ ধুলোর কথা উচ্চারিত হয়। প্রথমটা নাকি ঈশ্বরের দান। পৃথিবীতে সমস্ত জীবনের প্রতীক সেই ধুলো — হলুদ পরাগ রেণু বলে নাভাজোদের বিশ্বাস। এই হলুদ ধুলো না থাকলে পৃথিবী নাকি ফুলে-ফলে ভরে উঠত না। আর এক রকম হলুদ ধুলো হল মানুষের তৈরি এবং পৃথিবীর ধ্বংসের কারণ, ইউরেনিয়াম। এই ধারণাকে সম্পৃক্ত করে ১৯৭৯-এর চার্চ রক ইউরেনিয়াম মিল-এর ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই নাভাজো জনজাতির মানুষ। এই দুর্ঘটনায় নাভাজোদের নদী-সহ সমস্ত জলাধার দূষিত হয়ে যায়। ফলাফল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মারণরোগ বহন। ইউরেনিয়াম দূষণের কারণেই নাভাজোদের বর্তমান প্রজন্ম আজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সঙ্কটে ভুগছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রজেক্ট-এর হাত ধরে পরমাণু বোমা তৈরির সময় থেকেই খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন পৃথিবীর সর্বত্র এক লাভজনক ব্যবসা। পদার্থবিদ্যার ভয়ঙ্করতম ধ্বংসাত্মক সৃজন পরমাণু বোমার জন্ম দিয়েছিল ম্যানহাটন প্রজেক্ট।
১৯১৫ নাগাদ বেলজিয়ামের শাসনাধীন আফ্রিকার খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ কঙ্গোর শিঙ্কোলোবুই প্রদেশে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে থেকে প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়াম তুলে নিয়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বেলজিয়াম। পাচার হয় মার্কিন মুলুকে। সুসান উইলিয়ামস রচিত ‘স্পাইসেস ইন দ্য কঙ্গো’ বইতে ইউরেনিয়াম খনির কার্যকলাপের খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যায়। মাটির গভীরে গিয়ে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাজে জোর করে শিঙ্কোলোবুই গ্রামের মানুষকে নিযুক্ত করা হত। এই অঞ্চলের মানুষ আজও শরীরে বহন করে চলেছে ইউরেনিয়ামের বিষ। শুধুমাত্র নাভাজো, শিঙ্কোলোবুই বা কানাডার গ্রেট বেয়ার লেক অঞ্চলে নয়, গোটা বিশ্বেই ইউরেনিয়াম দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্থানীয় জনজাতির মানুষ। প্রথম পর্যায়ে ইউরেনিয়াম খনি তৈরির জন্য তাঁদের বাসভূমি হারাতে হয়। আর খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের পর ছড়াতে থাকে তেজস্ক্রিয়তা। ইউরেনিয়াম আকরিকের অব্যবহারযোগ্য উপাদান (পরিভাষায় ইউরেনিয়াম-২৩৮) খনি-সংলগ্ন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। ভারী ইউরেনিয়াম-২৩৮ ভেঙে তৈরি হয় থোরিয়াম, রেডিয়াম, পোলোনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় ধাতু। এগুলি মানব দেহের ডিএনএ-র গঠনকে প্রভাবিত করে ঘটিয়ে তোলে ক্ষতিকর মিউটেশন। ফলে দেখা দেয় ক্যানসার-সহ একাধিক মারণরোগ। এবং এই মিউটেশন জেনেটিক গঠনের অংশ হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতেই থাকে।
[the_ad id=”270085″]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রজেক্ট-এর হাত ধরে পরমাণু বোমা তৈরির সময় থেকেই খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন পৃথিবীর সর্বত্র এক লাভজনক ব্যবসা। পদার্থবিদ্যার ভয়ঙ্করতম ধ্বংসাত্মক সৃজন পরমাণু বোমার জন্ম দিয়েছিল ম্যানহাটন প্রজেক্ট। আর চাপা পড়ে গিয়েছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ এলাকায় উপনিবেশ বিস্তার ও জনজাতি ধ্বংসের নির্মম ইতিহাস।
এর মধ্যে সংক্রমণ জর্জরিত অবরুদ্ধ পৃথিবীতে জার্মানির রোজা লুমেক্সবার্গ ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের প্রথম ইউরেনিয়াম অ্যাটলাস (১৬ জুলাই, ২০২০)। এই বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে গোটা বিশ্বের ইউরেনিয়াম খননের প্রামাণ্য মানচিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত কোন দেশ কত পরিমাণ ইউরেনিয়াম খনন করেছে, কোন কোন খনিতে এখনও কাজ চলছে এবং কোন খনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, রয়েছে তারও সম্পূর্ণ খতিয়ান। ইউরেনিয়াম খননের ফলে যাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কথাও এই বইতে তুলে ধরা হয়েছে। ভারতের যাদুগোড়া, ভাতিন, নরপাহাড়, মহুলডিহির অবস্থাও উল্লেখ করা রয়েছে। চূড়ান্ত বিচারে দেখা যাচ্ছে যে মেঘালয়ের সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলার কয়েকটি এলাকার ভূগর্ভ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হলেও তা উত্তোলন করা আপাতত সহজ নয়।
আগামী পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ জানুয়ারি, ২০২১
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।