কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী মহম্মদ রফি এক উর্দু পত্রিকার জন্য দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন— ‘লতার মতো বটগাছের নীচে জন্মানো আশার জীবনের বড় ট্র্যাজেডি।’ তবে বড়দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় আজও তাঁর নাম। এ কথা সত্যি, আশা সম্পর্কে রফির মূল্যায়ন টাকায় ষোল আনা খাঁটি। আশা ভোঁসলের (Asha Bhonsle) কেরিয়ার-গ্রাফ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে স্বনামধন্য গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের ছোট বোন হওয়ার সুবাদে কোনও সুবিধা আশা পাননি। বরং জীবনের প্রতি পদে বিখ্যাত দিদির সঙ্গে তুলনা তাঁকে বিব্রত করেছে। এটাকে আশার জীবনের ট্র্যাজেডি বললে মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না।

মারাঠি রঙ্গমঞ্চের গায়ক-নায়ক মাস্টার দীনানাথ মঙ্গেশকরের পরিবারকে আসমুদ্র হিমাচলের সংগীতপ্রেমীরা এক ডাকে চিনেছে লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলের দৌলতে। তবে এই সাফল্য কিন্তু সহজে আসেনি। দীনানাথের অকাল প্রয়াণ ঘটে চল্লিশ দশকের গোড়ায়। বিধবা মা এবং ছোট ভাই-বোনেদের সংসারের ভার ওঠে কিশোরী লতার কাঁধে। অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে করতে লতা যখন সবে পায়ের তলায় শক্ত জমি পেয়েছেন এমন সময় আশা এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। গণপতরাও ভোঁসলে ছিলেন পেশায় রেশনিং ইন্সপেক্টার। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদি আশা। গোটা পরিবারকে তাঁর জেদের কাছে হার মানতে হল। সবার অমতে বিয়ে করার অপরাধে আশাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। মুম্বাই-এর উপকণ্ঠে বোরিভেলি–তে একটা ভাড়াবাড়িতে উঠে এলেন নববিবাহিত দম্পতি। রোজ ভোরে উঠে রেওয়াজ সেরে, সংসারের কাজ নিপুণ হাতে সম্পন্ন করে বিভিন্ন সংগীত পরিচালকদের অফিসে যাওয়াই ছিল সেসময় আশার প্রাত্যহিক রোজনামচা।
আরও পড়ুন: উনিশ শতকে ভোট নিয়ে একটি ব্যঙ্গগান
ফিল্মে গাইলেও আশা (Asha Bhonsle) শুরু করেছিলেন মারাঠি রঙ্গমঞ্চের গান দিয়ে। হিন্দি সিনেমায় গান গাইতে গিয়ে দিদি লতার গগনচুম্বী সাফল্যের মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতি পদে। তবে কেরিয়ারের শুরু থেকেই আশা সচেতন ছিলেন বিখ্যাত দিদির প্রভাব যেন তাঁর গানে না পড়ে। তাই তিনি লতাকে কখনও অনুসরণ করেননি। প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমী হতে চেয়েছিলেন এবং কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে তিনি উজ্জ্বল। একদিকে সংসারের দাবি মেটানো, অন্যদিকে গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন।

গুণী কম্পোজার ও পি নাইয়ার–এর সুরের স্রোতে অবগাহন করে আশা ভোঁসলের (Asha Bhonsle) গায়কি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এতদিন পরেও সেসব কালজয়ী গান সংগীতপ্রেমীদের স্মৃতিতে নস্টালজিয়ার ছোঁয়া নিয়ে আসে। কে ভুলতে পারে ‘মেরে সনম’ (১৯৬৫) ফিল্মে ও পি নাইয়ারের সুরে আশার নিবেদন— ‘যাইয়ে আপ কাহাঁ যায়েঙ্গে’ বা ‘ইয়ে হ্যায় রেশমি জুলফোঁ কা অন্ধেরা’! একই ছবিতে নায়িকা এবং পার্শ্বচরিত্রে কণ্ঠদানের অনায়াসদক্ষতা আশার মতো জাত শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। মধুবালার লিপে ‘হাওড়া ব্রিজ’ (১৯৫৮) ছবিতে আশার গাওয়া ‘আইয়ে মেহেরবাঁ ব্যাঠিয়ে জানে জাঁ’ মন মাতাল করা রোম্যান্টিক গান। নাইয়ার সাহেবের সুরে আরও এক অনন্যসাধারণ সংযোজন, ‘প্রাণ যায়ে পর বচন না যায়’ (১৯৭৪) ফিল্মের জনপ্রিয় নগমা— ‘চ্যয়ন সে হামকো কভি আপনে জিনে না দিয়া’। পরবর্তীতে আশা ভোঁসলে–রাহুল দেববর্মন জুটির মেলবন্ধন আমাদের এত হিট গান উপহার দিয়েছে যে স্বল্পপরিসরে তার উল্লেখ করা দুরূহ কাজ।
বি আর চোপড়ার ‘নয়া দৌর’ (১৯৫৭) ছবির গান সমঝদার শ্রোতাদের কাছে আদৃত হওয়ায় আর পেছন ফিরে চাইতে হয়নি আশাকে। একের পর এক ফিল্মে কণ্ঠের যাদু ছড়িয়ে মাত করে দিয়েছিলেন এই প্রতিভাময়ী গায়িকা। তবে সাফল্যের গরিমায় সহজে মহিমান্বিত হননি আশা। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য দিন-রাত এক করে দিয়েছিলেন। লড়াই ছিল নিজের সংসারেও। যাকে বিশ্বাস করে তিনি ঘর ছেড়েছিলেন সেই গণপতরাও ভোঁসলের কাছ থেকে সহমর্মিতা তো দূরের কথা, জুটেছিল বিদ্রূপ। কেন তিনি তাঁর দিদির চেয়ে পিছিয়ে আছেন, সেই জন্য নিত্য অপমানিত হতে হয়েছিল তাঁকে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে লড়াই চালিয়ে ছিলেন কিশোরী আশা। নায়িকাদের জন্য লতা কণ্ঠ দিলেও আশার ভাগ্যে জোটে ভ্যাম্প বা সহনায়িকার গান। যেখানে যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন সদ্ব্যবহার করেছিলেন পুরোপুরি। সময়ের সঙ্গে দিদির পাশাপাশি ছোট বোনের নামও সংগীতপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেয়।

আশার সংগীত-সফর শুরু হয় মারাঠি ফিল্ম ‘মাজে বাল’ (১৯৪৪)-এ গাওয়া ‘চলা চলা নববালা’ গানটির হাত ধরে। সহশিল্পীরা ছিলেন লতা, মীনা, ঊষা এবং হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। এই ছবিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। হিন্দি ফিল্মের জন্য আশার কণ্ঠে সর্বপ্রথম গানটি রেকর্ড করা হয় ‘আঁন্ধো কি দুনিয়া’ (১৯৪৭)–তে। গুণী সুরকার বসন্ত দেশাই-এর নির্দেশনায় ‘গরিবোঁ কে দাতা গরিবোঁ কে ওয়ালি’ (সহগায়িকা- জোহরাবাঈ) শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। ১৯৪৮ সালের ফিল্ম ‘ভক্ত গোপাল ভাইয়া’–তে আমরা পেয়েছিলাম আশা-কণ্ঠনিঃসৃ্ত দুটি অসাধারণ নিবেদন— ‘গুরু বিন কৌন বতাওয়ে জ্ঞান’ ও ‘ম্যায় নাথ অনাথ হুঁ, বালক হুঁ’। প্রথম গানটির রচয়িতা ছিলেন কবীরদাস এবং পরেরটি রমেশ গুপ্তা’র লেখা। সুরসংযোজনায় ছিলেন শংকররাও ব্যাস।
১৯৪৯-৫০ সালে সমগ্র দেশের শ্রোতামণ্ডলী যে সকল ফিল্মের মাধ্যমে আশা-কণ্ঠের সাথে পরিচিতি লাভ করলেন সেগুলি যথাক্রমে— ‘এক তেরি নিশানি’ (সুরকার- শার্দূল কাত্রা), ‘রাত কি রাণী’ (সুরকার- হন্সরাজ বেহেল), ‘পর্দা’ (সুরকার- খৈয়াম), ‘লেখ’ (সুরকার- কৃষ্ণদয়াল), ‘চোর’ (সুরকার- পণ্ডিত গোবিন্দরাম), ‘নিলি’ (সুরকার- এস মোহিন্দর), ‘বিজলী’ (সুরকার- খেমচাঁদ প্রকাশ), ‘বিবি’ (সুরকার- আজিজ হিন্দি/খৈয়াম), ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’ (সুরকার- শংকররাও ব্যাস), ‘ভীমসেন’ (সুরকার- অবিনাশ ব্যাস), ‘ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা’ (সুরকার- এস কে পাল), ‘মধুবালা’ (সুরকার- লচ্ছিরাম), ‘ওয়াফা’ (সুরকার- বিনোদ), ‘সতী নর্মদা’ (সুরকার- খেমচাঁদ প্রকাশ), ‘সবক’ (সুরকার- আল্লারাখা কুরেশি) ইত্যাদি।

ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের সুরে আশার কণ্ঠে দুটি উৎকৃষ্ট নজম জনপ্রিয় হয় ১৯৫২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আধিঁয়া’ ছবিতে। পণ্ডিত নরেন্দ্র শর্মা রচিত এই গানগুলির মাধ্যমে আশা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে এই ধরনের প্রয়োগে তিনি কতখানি স্বচ্ছন্দ। নিবেদিত হয়েছিল— ‘দর্দ বঁট রাহা হ্যয় কিসে দর্দ চাহিয়ে’ ও ‘দিল কা খাজানা খোল দিয়া খুশিয়াঁ লুটানে আই হুঁ’। হিন্দি শায়েরির মুখ্য অঙ্গ হিসেবে অলঙ্কারের বিশেষ প্রয়োগ ও অসাধারণ ব্যবহার এই গানদুটিকে করে তুলেছিল চমকপ্রদ। শচীনকর্তার গানের ভুবনে আশার প্রবেশ রবীন্দ্র দাভে পরিচালিত ‘লাল কুঁওর’ (১৯৫২) ফিল্মের মাধ্যমে। এই ছবির গান আশাকে দু’বার গাইতে হয়েছিল, একবার ফিল্মের জন্য ও আরেকবার রেকর্ডের জন্য। ‘দিল কা ভেদ জান লো’ এবং ‘আওয়াজ দেতা হ্যায় সোলা কা দিন’ তৎকালীন দিনে রেডিওর জনপ্রিয় গান। সংগীত জগতের মহীরুহ রাইচাদঁ বড়ালের সুরে আশার গাওয়া— ‘প্যায়ার হো গ্যয়া মুঝে প্যায়ার হো গ্যয়া’, ‘দর্দ-এ-দিল’ (১৯৫৩) ছবিটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এছাড়া, পঞ্চাশ দশকের প্রথম ভাগে যে সকল গুণী সংগীত পরিচালকদের সুরসৃষ্টি আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ঝংকৃত হয়েছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাজ্জাদ হুসেন, শ্যামসুন্দর, নৌশাদ, অনুপম ঘটক, রবীন চ্যাটার্জি, অনিল বিশ্বাস, গুলাম মহম্মদ, সি রামচন্দ্র, ও পি নাইয়ার, রোশন, মদনমোহন, চিত্রগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, ভি বালসারা, মান্না দে, হেমন্তকুমার, সর্দার মালিক, বুলো সি রাণী, সুধীর ফাড়কে, জামাল সেন, নাশাদ, কে দত্তা প্রমুখ ।

আশা ভোঁসলের গান যেন আকাশে ইন্দ্রধনুর ছটা, একাধারে মায়াময়, রঙিন, অন্যদিকে অননুকরণীয়, অতুলনীয় । আর সেই প্রাণচঞ্চলতায় ভর করে আপাত শান্ত, সমাহিত মানুষটি গেয়ে ফেলেছেন কয়েক হাজার গান । যে বিপুল বৈচিত্র্য তিনি তাঁর গায়নে ধরে রেখেছেন, তাঁর সাধনা ছুঁয়ে ফেলল সুরের আকাশের সমস্তটা । আশা ভোঁসলে তাই মহারাষ্ট্রে জন্মেও, আসলে ভারতবর্ষ নামক দেশটিরই এক উজ্জ্বল রত্ন । এই দেশের সামগ্রিক সঙ্গীতের ইতিহাসই সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁকে পেয়ে, তাঁর কণ্ঠ-ঐশ্বর্য লাভ করে । তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত গানের অবিরাম ধারা সঙ্গীতপিপাসু মনকে আজীবন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সুখের সাগরে । গানের মর্ম আতস্থ করার মুনশিয়ানায় বরাবরই সুদক্ষ আশা ভোঁসলে । এর নেপথ্যে তাঁর শাস্ত্রীয় তালিমের অবদান অনস্বীকার্য । উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতচর্চাই তাঁকে শিখিয়ে ছিল কিভাবে কন্ঠস্বরে নাটকীয়তা তৈরি করতে হয়, আবেগে গলা ভাসিয়েও কীভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয় সুরের উপর । তাঁর একাধিক কালজয়ী গানে এই সংযমবোধকেই আশ্রয় করেছেন অনুপম কণ্ঠের অধিকারিণী আশা । তাঁর সঙ্গীতে আমরা খুঁজে পেয়েছি প্রকৃত প্রেমের কাতরতা । সেই কারণেই তাঁর গানকে এত কাছের এত আপন মনে হয়েছে শ্রোতাদের । ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিকে আধার করে শ্রোতাদের সঙ্গে এমন সংযোগস্থাপন আর কজনই বা করতে পেরেছেন ! তাই তাঁর গাওয়া গান একটা গোটা জাতির অনন্য সম্পদ হিসেবে রয়ে যাবে । তাঁর গানে স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের শ্রোতারা, শিখেছেন ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে । আর তাই আনন্দে, বিরহে বারবার আশা ভোঁসলের গাওয়া গানের আশ্রয় খোঁজেন সকলে । শিল্পী হিসেবে তাঁর ব্যাপ্তি ভাষায় বর্ণনা করা দুরূহ । তিন সপ্তক জুড়ে বিরাজ করেছে তাঁর কণ্ঠ । শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত হলেও, সঙ্গীতজীবনে তিনি সবচেয়ে বেশি গান প্লে-ব্যাকেই গেয়েছেন । আমাদের উপমহাদেশের এই বহুমুখী প্রতিভা কে জানাই আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম ।
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।