ছোটবেলা থেকে দেখেছি পাড়ায় পাড়ায়, এমনকি অনেক বাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়। দেখেছি নেতাজীর জন্মদিনে ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে পাড়ায় পাড়ায় পরিক্রমা করে ছেলের দল, বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বাজে। বিদ্যাসাগরের জন্মজয়ন্তী দেখিনি বিশেষ। বিদ্যাসাগর মানে বর্ণপরিচয় প্রথম আর দ্বিতীয় ভাগ, কথামালা, আর সীতার বনবাসের নির্বাচিত অংশ, সবই পাঠ্যবই, ব্যস, গল্প শেষ। আর, হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর ছিলেন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বন্ধ করেছিলেন, বিধবাবিবাহ চালু করেছিলেন, আর ছোটবেলায় রাস্তায় মাইলস্টোন দেখে ওয়ান টু থ্রি ফোর চিনেছিলেন, আর খুব মাতৃভক্ত ছিলেন, মায়ের ডাকে সাঁতরে দামোদর পেরিয়েছিলেন। মোটের ওপর এই। এই সব গল্পের ষোলো আনা সত্যি নয়, কিন্তু ওই যে ইমেজটা তৈরি হয়েছিল সেটা সত্যি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালির কাছের মানুষ নন, কোনও দিন কাছের মানুষ ছিলেন না। আবার অনেক দূরের মানুষের মতো তাঁকে দেখে বাঙালি প্রণামও করেনি, তিনি কখনও কারও গুরুদেব হননি। তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল না। সত্যি বলতে কী, তাঁকে দেবতা বানানোর চেষ্টা করলে তিনি নির্ঘাত রেগে আগুন হয়ে খুব বকুনি দিতেন, আর তার পরে আবার গলে জল হয়ে আদর-টাদরও করে দিতেন এবং বুঝিয়ে বলতেন, ও সব আদিখ্যেতা কেন একেবারে করতে নেই।
বিদ্যাসাগর কতটা বাঙালি, কতটা নন, তা নিয়ে কালে কালে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তো এই নিয়ে তাঁর নিজস্ব কায়দায় খবরের কাগজের পাতায় রীতিমত তুফান তুলেছিলেন। কিন্তু ওই তর্কটা আসলে অর্থহীন, অবান্তর কচকচি। ও রকম বাঙালি আর না-বাঙালি ভাগাভাগি বলে কিছু হয় না। তবে একটা কথা ঠিক। বহু বাঙালির মধ্যে, বিশেষ করে শহরের মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে যে ব্যাপারটা খুব কমন, সেই আদিখ্যেতা বস্তুটি ওই মানুষটির মধ্যে একেবারে ছিল না। তিনি সারা জীবন যা মনে করেছেন তাই বলেছেন এবং যা বলেছেন তাই করেছেন। মনে এক, মুখে এক, একে খুশি করার জন্যে দুটো মিষ্টি কথা বানিয়ে বানিয়ে বললাম, তার মনে ঘা দেওয়ার জন্যে চারটি বাঁকা কথা শোনালাম, এ সব তাঁর ধাতে ছিল না।
অথচ সত্যিই মানুষটি শিশুর মতো কাঁদতে পারতেন। ওই যে কথাটা তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, বোধহয় রবীন্দ্রনাথই প্রথম বলেছিলেন, ঠিক জানি না, যে, তাঁর বাইরেটা বজ্রের মতো কঠিন আর অন্তরটি কুসুমের মতো কোমল, এ বড় খাঁটি কথা বটে। এই কারণেও তাঁকে ঠিক চেনা ছকে মেলানো যায় না। আমরা তো জানি, যে বাইরে কাঠখোট্টা, কোনও কিছু নিয়ে ন্যাকামির ধার ধারে না, তার মনে কোনও দয়ামায়া থাকে না, সে হয়তো খারাপ মানুষ নয়, কিন্তু অন্যের দুঃখটুঃখ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, ওই সেই গীতায় যাকে বলেছে দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা আর সুখে বিগতস্পৃহ, সে হল বড়জোর ওই রকম কিছু। কিন্তু বিদ্যাসাগর সে ছকও পুরোপুরি ভেঙেচুরে দেন। তিনি কেবল অন্যের দুঃখে কাঁদেন না, সেই দুঃখ কী করে ঘোচানো যায় সেটা ভাবেন এবং সেই ভাবনা কার্যকর করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এই রকম একটা মানুষ সব দেশে সব যুগেই বিরল, কিন্তু এ যুগে বাঙালির মধ্যে মনে হয় বিরলতম। অথচ ঠিক এমনই একটা মানুষ এখন বাঙালির খুব দরকার। আমাদের স্বভাব থেকে যে ব্যাপারটা ভয়ানক ভাবে হারিয়ে গেছে সেটা হল নিজের ওপর একটা স্বাভাবিক বিশ্বাস। ছাতি ফুলিয়ে বড় বড় কথা বলার বিশ্বাস নয়, আমি সে ও সখা সমাজ তৈরি করে পরস্পরের প্রশংসা করে সেই প্রশংসাকেই সত্যি বলে মনে করার বিশ্বাস নয়, গভীর আন্তরিক প্রত্যয় যে, আমি এটা মনে করি, এই কারণে মনে করি এবং এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে আমাকে যা করতে হয় আমি তা করব, যত বাধাই আসুক। কিন্তু এই প্রত্যয় তখনই কার্যকর হতে পারে যখন নিজের জীবনের উদ্দেশ্যটা সৎ ভাবে, কোনও সস্তা প্রাপ্তিযোগের অঙ্ক না কষে নির্দিষ্ট করতে পারে কেউ। তা না হলে সেটা সুবিধাবাদীর কার্যসিদ্ধির ফিকির হয়ে দাঁড়ায়।
আর তাই বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর পূর্তি উৎসবে যখন বাঙালি মেতে উঠেছে, তখন সব কিছুর ওপরে তাঁর যে গুণটি আমাদের মনে রাখা দরকার সেটি হল তাঁর অগাধ সততা। তিনি মানুষের মঙ্গলসাধনকে নিজের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে নিয়েছিলেন। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য যা যা করা দরকার এবং তাঁর পক্ষে যা যা করা সম্ভব, তার ধারণাও নিজের মতো করে নির্দিষ্ট করেছিলেন। ব্যস, তার পর আর তাঁকে কেউ সেই লক্ষ্য পূরণের সাধনা থেকে বিচলিত করতে পারেনি। অনেক লক্ষ্যই অপূর্ণ থেকে গেছে তাঁর। সমাজ তাঁকে সহযোগিতা করেনি, বরং পদে পদে বাধা দিয়েছে, বিরোধিতা করেছে, এমনকি কুৎসা করেছে। শেষ জীবনে তিনি মানসিক ভাবে নিজেকে পরিচিত সমাজ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সেটা সমাজের লজ্জা এবং কলঙ্ক। আজও আমরা সেই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সমাজের চেহারা যা দাঁড়িয়েছে, কোনও দিন পারব বলে মনেও হয় না।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।