বছর দশেক পরে কি আপনার ৫০তম বিবাহবার্ষিকী? একটা এমন কিছু করতে মন চাইছে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে? সকলে হিংসে আর বিস্ময়ে মুখের হাঁ বন্ধ করতে পারবে না? এক কাজ করতে পারেন! সস্ত্রীক একবার মহাকাশে ঘুরে আসুন না কেন? ভাবছেন রসিকতা? আজ্ঞে না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই রসিকতাকে সত্যি করবার ব্যবস্থা একরকম পাকাপোক্ত করে ফেললেন মহাকাশ-গবেষকদের দল। তার প্রথম ধাপ সাফল্যের মুখ দেখল রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১-এ! এবং তার সঙ্গে চিরতরে জুড়ে গেল দু’টি ভারতীয় নাম – রতন টাটা এবং শিরীষা বান্ডলা।
সাধারণ বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী মহাকাশযান, যাকে ইংরিজিতে বলা হচ্ছে commercial passenger carrying spacecraft, আজ থেকে চালু করল মার্কিন সংস্থা ভার্জিন গ্যালাকটিক। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার স্যর রিচার্ড ব্র্যানসন প্রথমবার বাণিজ্যিক মহাকাশযানে সওয়ার হয়ে ঘুরে এলেন মহাকাশে এবং তাঁর সঙ্গী থাকলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী শিরীষা বান্ডলা। উপরন্তু, এই মহাকাশ-অভিযানের ‘গ্রাউন্ড ভেহিকল’ হিসেবে যুক্ত রয়েছে টাটা মোটর্সের অধীনস্থ সহযোগী সংস্থা ল্যান্ড রোভার। এই গাড়িগুলি শুধু যে যাত্রীদের মহাকাশযান পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, টোয়িং-এর জন্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে। টাটা সংস্থার চেয়ারম্যান, এন চন্দ্রশেখরন আজ সোশ্যাল মিডিয়াতে এই সাফল্যের খবর জানিয়ে ব্র্যানসনকে অভিনন্দন জানান।

প্রসঙ্গত, ল্যান্ড রোভারের সঙ্গে গ্যালাকটিকের পার্টনারশিপ অবশ্য আজ থেকে নয়। ২০১৪ সাল থেকে তারা পরস্পরের কাজের অংশীদার। এবং এই বাণিজ্যিক মহাকাশ-অভিযান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে গ্যালাকটিক ও ল্যান্ড রোভার। মহাকাশযান একজায়গা থেকে আর একজায়গায় টেনে নিয়ে যাওয়া (towing), যন্ত্রপাতি পরিবহণ, এমনকী টেক-অফের ঠিক আগে রানওয়ে পরিষ্কারের কাজেও ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ল্যান্ড রোভারের তৈরি এসইউভি গাড়ি। এবার বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ-সফরের প্রথম ধাপ হিসেবে যে অভিযান হল, তার সঙ্গেও নাম জুড়ে গেল টাটা মোটর্সের। এখানে বলে রাখা ভাল, যে মহাকাশযানটি ব্র্যানসনকে নিয়ে মহাকাশে ঘুরে এল, তার নাম স্পেসশিপ টু ইউনিটি (SpaceShipTwo Unity)। আর যে গাড়িতে তিনি মহাকাশযান পর্যন্ত গেলেন, সেটি ছিল ল্যান্ডরোভারের ‘রেঞ্জ রোভার অ্যাস্ট্রোনট এডিশন’। এর আগেও তিনবার মহাকাশে যান পাঠিয়েছে গ্যালাকটিক। তবে বাণিজ্যিক মডেলে কেবিন ক্রু, পাইলট ও যাত্রী-সহ মহাকাশ-সফর এই প্রথম। আর প্রথমবারেই অভূতপূর্ব সাফল্য!
এবারের মহাকাশযানে ক্রু হিসেবে ছিলেন চারজন মহাকাশ-বিশেষজ্ঞ এবং দু’জন পাইলট। নিউ মেক্সিকোর মহাকাশ-বন্দর থেকে তাঁরা উড়লেন এবং নেমেও এলেন সুস্থ শরীরে। নামার পর ‘ল্যান্ড রোভার ডিফেন্ডার ১১০’ গাড়ি ব্যবহার করে মহাকাশযানটিকে ‘টো’ করে নিয়ে আসা হল। যাত্রীরা জানালেন, এই সফরে তাঁদের শুধু যে ভারশূন্যতার অভিজ্ঞতা হয়েছে তা-ই নয়, মহাকাশ থেকে পৃথিবীর অসাধারণ সৌন্দর্যও উপভোগও করতে পেরেছেন তাঁরা।

ভারতের জন্য এটা নিঃসন্দেহে দারুণ গর্বের মুহূর্ত। মহাকাশ-সফরকে সহজ ও সুগম করে তুলতে যে দীর্ঘ গবেষণা চলছিল তার সঙ্গেও প্রতিমুহূর্তে জড়িয়েছিল টাটার নাম। ভার্জিন আটলান্টিক নামে যে উড়ান সংস্থা রয়েছে, তাদের ডিজিটাল ও সফটঅয়্যার সহযোগী হিসেবে সতেরো বছর ধরে কাজ করে টাটারই আর একটি সংস্থা টিসিএস বা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস। এবার মহাকাশ-সফরের সঙ্গেও যুক্ত হল ভারতের অন্যতম এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম। টাটা মোটর্সের তরফে জানা গিয়েছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত তারা গ্যালাকটিকের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবে এই বাণিজ্যিক মহাকাশ-সফরকে সাধারণের হাতের কাছে নিয়ে আসার লক্ষ্যে। ইতিমধ্যেই গ্যালাকটিকের আরও একটি বাণিজ্যিক মহাকাশযান (Spaceship Three) পরীক্ষামূলক স্তরে রয়েছে এবং তার সহযোগী গ্রাউন্ড ভেহিকল হিসেবে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে ল্যান্ড রোভারের ‘ভিএসএস ইম্যাজিন’ গাড়িটি নিয়েও।
ফলে বুঝতেই পারছেন, মহাকাশে বেড়াতে যেতে চাইলে গোড়া থেকেই আপনার সঙ্গী থাকবে ল্যান্ড রোভার। নিউ মেক্সিকো থেকে মহাকাশে যাবার ন্যূনতম প্রশিক্ষণ নিয়ে আপনি যে গাড়িতে করে স্পেস টার্মিনাল থেকে মহাকাশযানের দিকে ছুটে যাবেন, সে গাড়ি তাদেরই তৈরি। কাজেই ভারতীয় হিসেবে আপনার বুক গর্বে দশহাত হলে, কারও কিচ্ছু বলবার থাকবে না। টাটা মোটর্স সূত্রে জানা গিয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার মোহাভে মরুভূমিতে গ্যালাকটিকের যে গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে সেখানে, এবং নিউ মেক্সিকোর মহাকাশ-বন্দরে ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যক গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ল্যান্ড রোভার। তৈরি হচ্ছে ‘Base Fleet’। ইতিমধ্যেই মার্কিন বিলিওনেয়াররা মহাকাশের অভিজ্ঞতা নিতে লাইন লাগিয়েছেন ব্র্যানসনের সংস্থার দরবারে। আর ব্র্যানসন নিজে কী বলছেন? তাঁর কথায়:
“আমার স্ত্রী জোয়ান তো উড়োজাহাজে চড়তেও ভয় পায়। ফলে ও যে এতে ভয় পাবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে আমার মনে শুধুই ছিল রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা। ছেলেমেয়েরাও খুব উৎসাহী ছিল। ভাবতে পারেন, সতেরো বছর ধরে অপেক্ষা করেছি এই মুহূর্তটির? নিজেকে চিমটি কেটে দেখে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল, যে এসব সত্যি ঘটছে! ৭১ বছরের জন্মদিনে এর চেয়ে ভাল উপহার আর কীই বা পেতে পারতাম!”

সত্যি বলতে কী, এই মহাকাশে বেড়াতে যাওয়া বা ‘Space Tourism Business’ নিয়ে গবেষণা এবং পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে বেশ কয়েকটি মার্কিন সংস্থা, যার মধ্যে রয়েছে এলন মাস্কের ‘স্পেস-এক্স’ এবং জেফ বেজ়োস-এর ‘ব্লু অরিজিন’। সকলেই অপেক্ষায় রয়েছেন সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের। অনেকেই ভেবেছিলেন আমাজ়ন ডট কমের কর্ণধার জেফ-ই সকলকে টেক্কা দিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশ-সফর করবেন তাঁর ‘নিউ শেপার্ড’ নামক সাব-অরবাইটাল মহাকাশযানে। কিন্তু শেষমেশ কেবল ন’দিনের ব্যবধানে জেফকে পেছনে ফেলে প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশযাত্রীর মুকুটটি মাথায় তুলে নিলেন ব্র্যানসন। আর তার সঙ্গে চিরকালের মতো জুড়ে গেল ভারতের নামও।
*ছবি সৌজন্য: Techcrunch, The Guardian, space.com
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!