Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মুক্তির আলো

মৌ ভট্টাচার্য

আগস্ট ১৭, ২০২০

প্রতিকী ছবি
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

“মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,/ মুক্তি কোথায় আছে।” মুক্তি শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যে আবেগ, তাকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। মুক্তি মানে শুধুমাত্র বাঁধন মুক্ত হওয়া নয়, অন্যকে সেই বাঁধন-মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়াও। ২০০৮ সাল মাদ্রিদ শহরে “ওয়ার্ল্ড উইমেন কংগ্রেস” -এ পেপার পড়তে গেছি । শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত যে বিশাল হল ঘরটিতে এর সূচনা হবে সেখানে একসঙ্গে দু’ তিন হাজার মানুষ বসতে পারেন। সেই এক ঘর মানুষের সামনে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল যে মেয়েটির হাত ধরে সে নিজেই ছিল পাচারের শিকার।

ছোটখাট চেহারার কম্বোডিয়ার  মেয়েটির চোখে সেদিন এক মুক্তির আলো দেখেছিলাম। ঘোষক মাইকে বলে উঠলেন, এবার অনুষ্ঠানের সূচনা করবেন সমালি মাম, যিনি এখন পেশায় একজন আইনজীবি। মূলত মহিলা ও শিশুদের পাচারের কেস লড়ে থাকেন। তিনি নিজেই চৌদ্দ বছর বয়সে সেক্স ট্রাফিকিং -এর শিকার হন। তাঁর স্মৃতিকথা ”The Road of Lost Innocence” -এ এই কথাগুলোই লিখেছেন। সেখানে তিনি আরও বলেছেন, তাঁর দাদুর দ্বারা প্রথম যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা। পরে তাঁকে কোনও এক যৌন পল্লিতে বেচে দেওয়া হয়। কিন্তু জীবন তো একইভাবে থেমে থাকে না। বহতা নদীর মত এঁকেবেঁকে চলে। সেই জীবনের হাত ধরে তিনিও একদিন অন্ধকার থেকে মুক্ত হন। তারপর ওঁরই মত অন্য মেয়েদের সাহস দেওয়ার জন্য তাদের পাশে দাঁড়ান “চেঞ্জ মেকার” হিসেবে। ওঁকে সেদিন স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া মানুষরা। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সমালি মামের কাছে আমাদের মাখা হেঁট হয়ে গিয়েছিল।

এরকম মেয়ের গল্প বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। শুধু কম্বোডিয়াতেই তা থেমে থাকে না। কোনও কোনও গল্প শুনলে মনে হয় একেবারে সিনেমার মত। সেই রকমই একজন মুমতাজ (নাম পরিবর্তিত)। পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে। একদম বাংলাদেশ বর্ডারের পাশে তার গ্রাম। সে ছিল বাড়ির ছোট মেয়ে। খুব  আদর যত্নে বড় হচ্ছিল। তের-চৌদ্দ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়ার পথে একটি ছেলের সঙ্গে তার আলাপ হয়। গল্প গুজব চলতে থাকে। মুমতাজের বেশ পছন্দ হয় ছেলেটিকে। তাকে বিশ্বাসও করতে শুরু করে। আড্ডা, গান শোনা চলতে থাকে। পরস্পরের প্রতি অনুভূতিও বাড়তে থাকে। মুমতাজের চারপাশ, নদী, গাছপালা, সব নতুন করে ভালো লাগতে থাকে। এ ভালোলাগার ভাগ হয় না। ইমতিয়াজই বোঝে শুধু।

অনেক বাঙালি মেয়েকেই ওখানে  পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে ট্রেন্ড হল, সাজিয়ে গুজিয়ে বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের নাচাতে নিয়ে যাওয়া। আর বাদবাকি সময় তাদের ওপর যৌন নির্যাতন করা। মুমতাজের ওখানে গিয়ে আরও দুটো মেয়ের সাথে দেখা হয়। তারাও মুমতাজের জেলা থেকেই এসেছিল।

শেষে একদিন স্বপ্নার্দ্র চোখে ইমতিয়াজের হাত ধরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ে। বড় শহরে ঘর বাঁধার স্বপ্ন, সংসার গড়ার স্বপ্ন। ট্রেনে উঠে জল তেষ্টা পেলে জল খায় মুমতাজ। তারপর আর তার কিছু মনে নেই। যখন চেতনা এল ততক্ষণে পাশে ইমতিয়াজের বদলে একজন অচেনা মানুষ বসে। তার শরীর আর মাথা তখন অসাড়। স্টেশনগুলো একের পর এক চলে যাচ্ছে। সবকটার নাম হিন্দিতে লেখা। কলকাতা কোথায়? উঠে বসে মুমতাজ। পাশের লোকটিকে এক ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যায়। ট্রেন চলছে দ্রুত গতিতে। নামার উপায় নেই । কোথাও যাওয়ারও জায়গা নেই। বুঝতে পারে ইমতিয়াজের ফাঁদ। ততক্ষণে মুমতাজ হাত বদল হয়ে গিয়েছে। পরে জানতে পারে, ইমতিয়াজ তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় বেচে দিয়েছিল।

মুমতাজকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বালিয়াতে। অনেক বাঙালি মেয়েকেই ওখানে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে ট্রেন্ড হল, সাজিয়ে গুছিয়ে বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের নাচাতে নিয়ে যাওয়া। আর বাকি সময়টা তাদের ওপর যৌন নির্যাতন করা। মুমতাজের ওখানে গিয়ে আরও দুটো মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। তারাও মুমতাজের জেলার মেয়ে। মুমতাজ চুপচাপ ছিল। প্ল্যান করছিল কী ভাবে মেয়েগুলোকে নিয়ে পালানো যায়। হঠাৎই এক বিয়ে বাড়িতে মুমতাজের সঙ্গে একটি ছেলের আলাপ হয়, মুমতাজ বোঝে, ছেলেটা তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করছে। কিন্তু ততদিনে সে শিখে গেছে কীভাবে বিশ্বাস আদায় করে মানুষকে ব্যবহার করতে হয়। শেষ পর্যন্ত এই ছেলেটির সাহায্য নিয়ে অন্য একটি বিয়ে বাড়ি থেকে, ওই দুটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পালায় সে। বালিয়া থানাও পশ্চিমবঙ্গের আ্যন্টি ট্রাফিকিং ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের বাড়ি ফিরতে সাহায্য করে।

এ রকম মেয়ের গল্প বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে।

বাড়ির লোক মুমতাজকে ভালো ভাবেই গ্রহণ করেছে। মুমতাজ ফিরে এসে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কেস চলছে। সে পিছু হটে যাওয়ার মেয়ে নয়। গ্রামে ফিরে সে কিছুদিন নিজেকে তৈরি করেছে লড়ার জন্য। তারপর আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। এখন কলেজ শেষ করে নিজের একটা সংস্থা তৈরি করেছে, যাতে পাচার বিষয়টাকেই তার গ্রাম থেকে শেষ করে দিতে পারে। যারা পাচার হয়ে যাচ্ছে তাদের ফিরিয়ে আনাই তো একমাত্র কাজ নয়। পাচার যাতে আটকানো যায় সেটাও বড় কাজ। মানুষকে সচেতন করাও আর একটা কাজ। পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্য বিষয়গুলোও যে নির্যাতনের অংশ, সেটাকে তুলে ধরাও সচেতনতার অংশ। আরও একটা বড় কাজ হল পাচার হয়ে যারা ফিরে আসছে তাদের পুর্নবাসন করা। শুধু তো বাড়িতে ফিরিয়ে দিলেই হবে না। বাড়ি, সমাজ, সবার ভেতর এই মেয়েদের গ্রহণযোগ্যতার বাতাবরণ তৈরি করতে হবে।

সারা পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জালিক ফাঁদের মত ছড়িয়ে আছে পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক। চলছে বিশাল ব্যবসার লেনদেন আর হিস্যার বাটোয়ারা। যখনই কোনো মেয়ে বা বাচ্চা উদ্ধার হচ্ছে,  জানবেন কারওর না কারওর হিস্যায় কোপ পড়ছে।

কত মেয়েকে দেখেছি সমাজ আর পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা না পেয়ে নিজেরাই পাচারকারী হয়ে গেছে সবার ওপর প্রতিশোধ নিতে। সুমিতা কৃষ্ণনও তো এ রকমই এক জঘন্য অপরাধের শিকার। তারপর উনি তো উঠে দাঁড়িয়েছেন । প্রজ্বলা নামে একটা সংস্থা চালান এখন। শিশু ও মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছেন। সুমিতা সারা ভারতের এক উজ্জ্বল মুখ।

সমস্ত কিছুর মূলে আছে সুরক্ষা আর নিরপত্তার প্রশ্ন। সেই সুরক্ষা দেওয়ার কথা রাষ্ট্রের। প্রত্যেকটা মানুষের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে গিয়েও দেখেছি পাচারের সমস্যা একইভাবে রয়েছে। ২০১৩ সালে লাস ভেগাসের রিনোতে ছিলাম। সার্জেন চার্মসের কাছে শুনেছিলাম, কী ভাবে সেখানেও গ্রাম থেকে মেয়েদের নিয়ে এসে মোটেলগুলোয় বিক্রি করা হয়। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছিলেন, পিম্পরা অনেক সময় তাদের শরীরে ট্যাটু দিয়ে লোগো বানিয়ে দেয়, যাতে তারা পালাতে চেষ্টা করলে অন্যরা বুঝে যায় তারা কোথায় বা কার কাছে ছিল। ঠিক যেভাবে পশু সনাক্তকরন করা হয় সেই রকম। এ তো দাস প্রথার চেয়েও অধম!

সারা পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জালিক ফাঁদের মত ছড়িয়ে আছে পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক। চলছে বিশাল ব্যবসার লেনদেন আর হিস্যার বাটোয়ারা। যখনই কোনও মেয়ে বা বাচ্চা উদ্ধার হচ্ছে, জানবেন কারওর না কারওর হিস্যায় কোপ পড়ছে। লেনদেন, হিস্যা, ভাগ-বাঁটোয়ারা, প্ররোচনা, এত সবকিছুর মধ্যেও উঠে আসছে চ্যাম্পিয়নরা। তারা নিজেদেরকে যেমন অন্ধকার থেকে বের করে আনছে, তেমনি অন্যদেরকেও একটা মুক্ত আকাশের খোঁজ দিতে চেষ্টা করছে। ওমন এক আকাশ, যার নিচে দাঁড়িয়ে অনেক মেয়ে ভয় না পেয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারবে। সাহস সঞ্চয় করে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে অনেকে লড়ছেন। কিন্তু যুথবদ্ধতা ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। অনেক মানুষের সাহায্য নিয়েই তৈরি করা যাবে সেই অভীষ্ট রেখা, যাকে অতিক্রম করতে ভয় পাবে পাচারকারীরা। যেখানে সুরক্ষিত থাকবে প্রতিটি শিশু, প্রতিটি মেয়ে। আসুন, সেই আলোর পথ তৈরিতে আমরা সকলে সামিল হই। সেই আলোই দেখাবে অন্ধকার থেকে মুক্ত হওয়ার পথ।

গবেষক, নারী ও শিশু অধিকারকর্মী। চার্লস ওয়ালেস ফেলোশিপ পেয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে। আই ভি এল পি ফেলোশিপে আমেরিকা গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচার নিয়ে দু দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। ভ্রমণ ও কালিনারি কালচার নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত দুটি বই : ড্রিমস এর চিত্রনাট্য র বাংলা অনুবাদ “ড্রিমস” ঊর্বি প্রকাশনা। “বেশ্যা পাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ”, আনন্দ পাবলিশার্স।

Picture of মৌ ভট্টাচার্য

মৌ ভট্টাচার্য

গবেষক, নারী ও শিশু অধিকারকর্মী। চার্লস ওয়ালেস ফেলোশিপ পেয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে। আই ভি এল পি ফেলোশিপে আমেরিকা গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচার নিয়ে দু দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। ভ্রমণ ও কালিনারি কালচার নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত দুটি বই : ড্রিমস এর চিত্রনাট্য র বাংলা অনুবাদ “ড্রিমস” ঊর্বি প্রকাশনা। “বেশ্যা পাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ”, আনন্দ পাবলিশার্স।
Picture of মৌ ভট্টাচার্য

মৌ ভট্টাচার্য

গবেষক, নারী ও শিশু অধিকারকর্মী। চার্লস ওয়ালেস ফেলোশিপ পেয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে। আই ভি এল পি ফেলোশিপে আমেরিকা গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচার নিয়ে দু দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। ভ্রমণ ও কালিনারি কালচার নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত দুটি বই : ড্রিমস এর চিত্রনাট্য র বাংলা অনুবাদ “ড্রিমস” ঊর্বি প্রকাশনা। “বেশ্যা পাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ”, আনন্দ পাবলিশার্স।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস