দুপুর গড়িয়েছে। শীতবেলার ফিকে রোদ্দুর। সূর্য পশ্চিম আকাশে পাড়ি দিয়েছে। সবে ধলডাঙা মোড় পেরিয়েছি। মাইল-ফলকে লেখা জাতীয় সড়ক ৬০এ। দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তিতে খানিক অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “আর কতদূর!” গাড়ি চালাতে চালাতে দিব্যেন্দুদার উত্তর, “আর বেশি দূর নয়। এই তো! পুয়াবাগান বাজার এসে গেছি! এরপর পুরুলিয়া ঢুকে যাব। ডানদিকে হাইওয়ে ধরে হুড়া, লধুরকা হয়ে আবার ডানদিকে কাশীপুর যাওয়ার রাস্তা ধরে ৩ কিলোমিটার এগোলেই শালডিহা মোড়। তারপর বাঁদিকে আর মাত্র দু কিলোমিটার।”
পথনির্দেশিকার এমন জিলিপি প্যাচের বিবরণে সব যেন কেমন গুলিয়ে গেল। পথের দৃশ্যে মন দিলাম। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝেই একটা বোর্ড নজরে আসছে, ‘খেজুর গুড় পাওয়া যায়’। চোখের পাতা লেগে এসেছিল। ঘুম যখন ভাঙল, দেখলাম বড়সড় এক গেটের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। ‘ফুটিয়ারি রিট্রিট’-এর সিংহদুয়ার। (Futiary)

আমার কটেজটা একেবারে শেষপ্রান্তে। লাগোয়া ফালি জমিটায় ধান গাছের খেত, গোবিন্দভোগের চারা। বারান্দা থেকে ফুটিয়ারি লেকের একচিলতে ভিউ। লেকের ধার ঘেঁষে তাল গাছগুলোর মাথায় দিনান্তের আলো পিছলে যাচ্ছে। শীতের হাওয়ায় নাচন লেগেছে গাঁদা ফুল গাছে। আহা! গোটা চত্বরটাই ঝাঁকে ঝাঁকে গাঁদা ফুলে হলুদ হয়ে আছে।
আরও পড়ুন: পাহাড়ের কোলে ঝান্ডি-সুনতালে
দিব্যেন্দুদার স্বপ্নের খামারবাড়ি। বললেন, “১২ বিঘা জমি! আজ সন্ধে হয়েছে। কাল দিনের আলোয় সব ঘুরিয়ে দেখাব। অনেক শাকসবজি চাষ করেছি, সব অর্গ্যানিক।”
চাষবাস না হয় কাল দেখব, কিন্তু নিজে নিজেই একটু চত্বরটা ঘুরে দেখা যাক। বেশ কয়েকটা কটেজ ছাড়াও অনেকগুলো তাঁবু রয়েছে। চত্বরের ঠিক মাঝখানটায় কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে একটা লম্বা দেওয়াল রাখা আছে— ওয়াল ক্লাইম্বিং প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা। এছাড়াও নানান অ্যাডভেঞ্চারস্ স্পোর্টসের শিক্ষার আয়োজন। ক্যাম্পিং-এর জন্য আদর্শ। পর্যটকরাও ইচ্ছে করলে একটু অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে পারবেন।

কটেজটা আমার একার পক্ষে যারপরনাই বড়। গড়ের মাঠের মতো বিছানায় এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত খানিক গড়াগড়ি দিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। ঠান্ডা জাঁকিয়ে পড়েছে। কয়েক পা হাঁটব বলে বেরোলাম। মূল ফটকের পাশেই সহদেব আর সুপর্ণার ঘর। মুখ বাড়িয়ে বলল, “টর্চ সঙ্গে রাখবেন”। হেড টর্চটা যদিও নিয়েই বেরিয়েছি। সুইচ অন করার প্রয়োজন হচ্ছে না। মাথার উপর একথালা জ্যোৎস্না পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। সেই আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে রাতের উল্লাস।
অনেক দূর থেকে ধামসা-মাদলের শব্দ ভেসে আসছে। কোথাও হয়ত কোনও উৎসব চলছে। লজে ফিরে জানতে পারলাম, কোথাও কোনও উৎসব হচ্ছে না। তবে আজকাল নানান উৎসব-অনুষ্ঠানে, পর্যটনে আদিবাসী নাচের কদর বেড়েছে। ছোট ছোট নাচের দল এখন পারফর্মার। তারই মহরা চলছে।
সকাল হতেই কটেজের পাশে জোতের আলপথ ধরে চলে এলাম জলের ধারে। নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছে পাখির কুজন। সুবিশাল জলাশয়ের ওপরস্তরে কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে। ফলে এর বিস্তার পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, ওপারটাও অস্পষ্ট। তবে কুয়াশার আস্তরণের ওপাশে আবছাভাবে উঁকি দিচ্ছে একটা টিলা।

শীতের শিরশিরানি, জলের হালকা ঢেউ এসে লাগছে শালুকের গায়ে। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি, জলে তার প্রতিচ্ছবি। দুটো ডিঙি নৌকো প্রস্তুত হচ্ছে মাছ ধরতে যাবে বলে। টিলার নাম জিজ্ঞেস করায় উত্তর এলো, ওটা তিলাবনি পাহাড় আর তার পায়ের কাছে কলাবনি গ্রাম।
শালুকের রং–বাহার দেখতে দেখতে মেঠো পথ ধরে হাঁটছিলাম। নৌকো থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “সাবধানে যাবেন দিদি, সাপখোপ আছে”। পানকৌড়ির দল ডুবসাঁতার দিতে দিতে মাঝে মাঝে মুখ তুলছে। তাল গাছের মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ওঁৎ পেতে বসে আছে মাছরাঙা। হঠাৎ সে ঝাঁপ দিল জলে, ছোঁ মেরে তুলে আনলো শিকার। পক্ষীসম্মেলন দেখে বুঝলাম, এই এলাকা পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য।

দিব্যেন্দুদার সবজি বাগান দেখে থ বনে গেছি। কী নেই সেখানে! ফুলকপি, বাঁধাকপি, কড়াইশুঁটি থেকে শুরু করে ব্রকোলি, ক্যাপসিকাম। স্বাদ তো গতকাল রাতের ডিনার প্লেটেই টের পেয়েছি। এছাড়া, দেশি হাঁস-মুরগি পালন করা হয়েছে। এক ঝুড়ি ডিম এনে রিসর্টকর্মী পরিমল জানালো, “রাতে হাঁসের ডিমের কষা খাওয়াব”।
প্রাতরাশের পর সাড়ে নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। বাঁধের ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য থামলাম। ফুটিয়ারি নদীতে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে ফুটিয়ারি ড্যাম। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলাশয়ের গভীরতা প্রায় ৯০ ফুট। জলের ওপরস্তরের ধোঁয়াশা যেন কিছুতেই কাটছে না। ঘোলাটে, আবছা, অস্পষ্ট। সারা শীতকাল জুড়ে এরকমই চলে। নীল টলটলে জল দেখা পাওয়া যায় না। এসময় পরিযায়ী পাখির দল ভিড় জমায়।
২ কিলোমিটার এগোতেই হিড় গ্রাম। সাঁওতাল পাড়া। সরু, কাঁচা পথ। দুপাশে মাটির ঘরদোর। কোনওটার দেওয়ালে আলপনা আঁকা। পরিচ্ছন্ন, নিকোনো উঠান। গ্রামজীবনের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। বাচ্চারা স্কুলের পথে।

৬ কিলোমিটার পরেই তিলাবনি পাহাড়। কুয়াশার পর্দার আড়ালে একেই তো দেখেছিলাম সকালে। উল্টোদিকে সিন্দুরপুর আর পাঞ্জনিয়া পাহাড়। সবগুলোই গ্রানাইট পাথরে তৈরি। ঝোপে ঢাকা, বড় বড় পাথর নেমে এসেছে। বেশ একটা রুক্ষতা আছে টিলাগুলোর। একটা পাথরের ওপর আরেকটা পাথরের ব্যালান্সিং। চেহারাটা এমন, যেন হাত-পা মুড়ে একটা শিশু হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে আছে।
আবার চলা শুরু। ৮ কিলোমিটার দূরে দুর্গাসিংডাঙায় এসে গাড়ি থামল। দুর্গা প্রসাদ সিং নামে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর নামেই জায়গার নাম। তাঁর স্মৃতিতে একটা বেদিও আছে। এ জায়গাটাকে দ্বারকেশ্বর নদীর উৎসস্থল বলা হয়। শীর্ণকায়া জলধারার বেশিরভাগটা জুড়ে আছে শালুকবন। বর্ষায় এর লাবণ্য খোলে। গ্রামের মহিলারা ধোয়া-কাচা সেরে স্নান করতে নেমেছে।

ফিরে চললাম। দিঘির জলে টিলার প্রতিচ্ছবি। হাঁসেদের জলকেলি, ছোটদের হুটোপাটি চলছে। খড় বোঝাই গরুর গাড়ি পথ আগলে দাঁড়াল। গরুটার কী হয়েছে, কে জানে। কিছুতেই সে নড়ছে না। দশ মিনিট ধরে চালকের অনেক চেষ্টার পর তাকে সরানো গেল।
দুপুরের মেনুটা একেবারে জমে গেছে— ভাত, লালশাক, শুক্তো, ডাল, আলুভাজা, পেঁয়াজকলি দিয়ে মৌরলা মাছ, মাছের মাথা দিয়ে বেতোশাক আর রুই মাছ ভাজা, চাটনি, পাপড়। বলে রাখা ভালো, সবজির পদগুলো সবই এই বাগানের চাষ আর মাছগুলো ড্যামের।
এমন এক ভুরিভোজের পর আলস্য চেপে ধরল। হাই তুলতে তুলতে আবার বেরোলাম। খৈড়িপিহিড়া, ধানেড়া হয়ে কামারকুড়ি মোড়। সেখান থেকে সিমলা হয়ে রঞ্জনডিহ পৌঁছলাম। এ পথটা বেশ সুন্দর। দুপাশে ঘন সবুজের ঠাসবুনট। রিসর্ট থেকে দূরত্ব প্রায় ২৭ কিলোমিটার। গামারকুড়ি মোড় থেকে কাশীপুর হয়ে চার কিলোমিটার রাস্তা কম পড়ে। কিন্তু, সে রাস্তাটা শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

রঞ্জনডিহ ড্যামের আরেক নাম যোগমায়া সরোবর। চারপাশে সবুজ বনে ঘেরা, নির্মল জলাধার। মনোরম পরিবেশ। বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। স্থানীয় মানুষেরা চড়ুইভাতির আসর জমিয়েছে। জলের ধার ঘেঁষে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। একধারে অতিথিশালা। বোঝা যাচ্ছে, খুব শিগগিরই রঞ্জনডিহ পুরুলিয়ার পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নেবে। কাশীপুর রাজবাড়িতে সংস্কারের কাজ চলছে। আপাতত পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই ওপথে না গিয়ে ফিরে এলাম রিসর্টে। দিনের শেষ আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ফুটিয়ারির জলে ভেসে আধঘণ্টার নৌকাবিহার। পশ্চিম আকাশে হোলি খেলার পর লাল টিপের মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল।
সকাল হতেই ব্যাগপ্যাক শুরু। ঘরে ফেরার পালা। ফুটিয়ারিকে বিদায় জানিয়ে প্রায় দশটা নাগাদ যাত্রা শুরু হলো। লধুরকা, লালপুর মোড় হয়ে এলাম হাতিমারা গ্রামে। একে আলপনা গ্রামও বলা যেতে পারে। প্রতিটা বাড়ির দেওয়াল অপূর্ব নকশায় শোভিত। এই মুগ্ধতাকে ফ্রেমবন্দি করে এবার কলকাতার পথে। পিছনে ফেলে এলাম সবুজবন, পাহাড়, ছায়াসুনিবিড় শান্ত গ্রাম, সহজ সরল কিছু মুখ।

যাতায়াত: পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে গাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায় ফুটিয়ারি।
থাকা: ফুটিয়ারিতে সুন্দর অবস্থানে থাকার জায়গা ‘ফুটিয়ারি রিট্রিট’।
যোগাযোগ নম্বর: ৯৮৩০২ ৫৩৫৮৪, ৯০৫১১ ৬৬৫৬৩
ওয়েবসাইট: www.futiary.com
ছবি সৌজন্য : লেখক
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।