“কাকাই আজকে আমরা ওজন করিয়েছি জানো? আমার ওজন ৩৫ কেজি,” পাপাই বলে।
“আর আমার ওজন ২৯ কেজি। তোমার ওজন কত কাকাই?” রুমকি জিগ্যেস করে।
কাকাই বাগানে ডাম্বেল ভাঁজছিল। ডাম্বেলগুলো রেখে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে, “৬৮ কেজি ছিল কদিন আগে। তোদের খেলা হয়ে গেল?”
পাপাই আর রুমকি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। কাকাই ইশারায় ওদের বাগানের ধার ঘেঁষে যে বাঁধানো বসার জায়গাটা আছে সেখানে বসতে বলে, ঘরের ভেতর থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে আসে। তারপর ওদের পাশে বসে পড়ে প্রশ্ন করে, “ভর কাকে বলে জানিস তোরা?”
” হ্যাঁ, ঐ তো, মা বলে, ওটা পলকা, বেশী ভর দিস না। মানে চাপ দেওয়া তাই তো?” পাপাই জানতে চায়।
“দেখ, আমরা চলতি কথায় যে শব্দগুলো যা বোঝাতে ব্যবহার করি, বিজ্ঞানের ভাষার সাথে মেলে না অনেকসময়ই। মানে, বিজ্ঞানে কিছু পরিভাষা ব্যবহার করা হয়, যেগুলো ধর কোন ব্যাপারকে ছোট করে আর নির্দিষ্ট করে বুঝিয়ে দেবে। এই যেমন ধর, আগেরদিন তোদের বলছিলাম না জাড্য নিয়ে, এখন জাড্য বললে তোরা বুঝতে পারবি কীসের কথা বলা হচ্ছে। ওটা হচ্ছে একটা পরিভাষা। এরকম অন্যান্য বিষয়েও পরিভাষা ব্যবহার হয়,” একটু থেমে একঢোক জল খায় কাকাই।
“তাহলে, ভরও একটা পরিভাষা? এর মানে কী?” রুমকি প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ, ভর বলতে বিজ্ঞানে একটা নির্দিষ্ট ব্যাপার বোঝানো হয়। একটু আগে ওজনের কথা বলছিলি না? আসলে তোরা নিজেদের ভর মেপেছিস, যদিও সেটা মাপতে ওজনের সাহায্য লেগেছে।”
“কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না কী বললে,” পাপাই বলে।
“আচ্ছা, আগে বল, কীভাবে মাপলি?” কাকাই জানতে চায়।
“ঐ তো, মাঠের পাশে একজন নিয়ে বসেছিল ওজন মাপার যন্ত্রটা। উঠে দাঁড়ালাম, কাঁটা ঘুরে দেখালো ৩৫।”
“হুঁ। আমরা চলতি ভাষায় যেটাকে ওজন বলি সেটা বিজ্ঞানের ভাষায় হল ভর। কোন বস্তুর মধ্যে কতটা পরিমাণ পদার্থ আছে সেটার হিসেব। তোর ভর ৩৫ কেজি মানে তোর দেহে হাড়, মাংস, চর্বি, রক্ত, ঘিলু সব মিলিয়ে ঐ পরিমাণ জিনিস আছে। এক কেজি ভর কতটা জিনিস বোঝায় সেটা ঠিক করা আছে, সারা পৃথিবী জুড়ে লোকজন সেটা মেনে চলে, তোর দেহের ভর তার ৩৫ গুণ। আবার বিজ্ঞানে ভার বা ওজন মানে হল, পৃথিবী কোন বস্তুকে কতটা জোরে নিচের দিকে টানছে তার হিসেব। পৃথিবী সব জিনিসকে নিজের দিকে টানে সেটা জানিস তো?”
“হ্যাঁ, সেই জন্যই সব কিছু নিচের দিকে পড়ে,” রুমকি বলে।
“ঠিক। এবার পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে জিনিসের ভর যত বেশী তাকে পৃথিবী তত জোরে টানে। আমার ভর যদি ৭০ কেজি হয়, তাহলে আমাকে পাপাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে টানবে পৃথিবী। রুমকির ভর ২৯ কেজি, তাই রুমকিকে পৃথিবী এক কেজি আলুর চেয়ে ২৯ গুণ জোরে টানবে। মানে যার ভর যত গুণ তাকে তত গুণ জোরে টানবে। তোরা যে যন্ত্রটায় ভর মেপেছিস সেটা এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে যাতে এক কেজির বাটখারা চাপালে কাঁটা ঘুরে ১ দেখাবে। তোরা ঐ যন্ত্রর ওপর দাঁড়ানোয় তোদের ভার ঐ যন্ত্রের ওপর পড়েছে। যত বেশী জোর পড়বে ঐ যন্ত্রর ওপর, সেই অনুযায়ী কাঁটা ঘুরবে। ওটার ওপর না দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরলেও দেখতিস কাঁটা ঘুরছে।”
“সব গুলিয়ে যাচ্ছে, কাকাই।”
“আচ্ছা, ধর তোরা ঐ যন্ত্রটা নিয়ে মহাশূন্যে গেলি, যেখানে পৃথিবী কেন কোন কিছুই তোদের আকর্ষণ করছে না মানে নিজের দিকে টানছে না, তখন ঐ যন্ত্রটার ওপর দাঁড়ালে দেখবি কাঁটা ঘুরছে না। কারণ ওজন শূন্য।”
“তার মানে তো যন্ত্রটা ওজন মাপছে। ওখানে ওজন শূন্য বলে ০ দেখাচ্ছে।”
“সব যন্ত্রেরই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এই যন্ত্রটার ওপর ওজন পড়লে এটা কত ভরের জন্য সেই ওজন সেটা বলে দেয়। যেখানে ওজন নেই সেখানে এই যন্ত্রটা দিয়ে ভর মাপা যাবে না। কিন্তু তা বলে মহাকাশে গেলে তোদের শরীরে যে পরিমাণ পদার্থ আছে সেটা উবে যাচ্ছে কি? তোদের হাড় ক’খানা, মাংস, রক্ত, মাথার ভেতরে গোবর সবই তো একই থাকছে। মানে ভর সব জায়গাতেই এক। অবশ্য আর একটু জটিল কিছু ব্যাপার আছে যেটা এখন বলছি না। যাই হোক, ওজন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হতে পারে। অনেকটা ওপরে উঠে গেলে বা মাটির নীচে চলে গেলে ওজন কমে যায়। ভর কিন্তু একই থাকবে।”
এবার পাপাই বলে ওঠে, “তাহলে পাহাড়ের ওপরে এরকম যন্ত্র দিয়ে মাপলে তো ভর আলাদা দেখাবে এখানের থেকে।”
“ভেরি গুড। সেইজন্য এরকম কোন জায়গায় গেলে যন্ত্রটাকে সেইমত অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। যেটাকে বলে ক্রমাঙ্কন বা ক্যালিব্রেশন। মানে ধর জানা ভরের কতগুলো বাটখারা চাপিয়ে সেইমত সেট করে নিতে হবে। যাতে পাঁচ কেজি চাপালে ৫ দেখায়, দশ কেজি চাপালে ১০। সাধারণ দাঁড়িপাল্লার একটা সুবিধে আছে। ওখানে একদিকে জানা ভর চাপিয়ে তার সাথে তুলনা করে অজানা ভর মাপা হয়, কোনদিকে ভর বেশী হলে পাল্লা সেদিকে ঝুলে যায়। ভর সমান হলে তখন দুটো দিক সমান-সমান থাকে। এক্ষেত্রেও দু’দিকের ওজনের তুলনা করেই ভর মাপা হচ্ছে কিন্তু কোন জায়গায় ওজন কম বা বেশী হলে সেটা দুদিকেই একইরকম কমবে বা বাড়বে। ওজন শূন্য হলে অবশ্য এই দাঁড়িপাল্লাও কাজ করবে না। বুঝলি?”
“তখন কীভাবে ভর মাপা যাবে কাকাই?” রুমকি জানতে চায়।
“আছে, উপায় আছে। পরে বলবো। এখন, খুব খিদে পেয়েছে রে। চ, একটু ঘুগনি খেয়ে আসি।”
(ভার ও ভর-এর বাকিটা আগামী শনিবার)
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভাটপাড়ায়, স্নাতক স্তরের পড়াশোনা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বর্তমানে বোস ইন্সটিটিউটে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। সিনেমা, গান এবং ফুটবল নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
One Response
Darun, e bhabe Jodi keu physics bojhato!