(Falls)
কুর্গের পর ম্যাঙ্গালোরের কাছে সৈকত শহর উদুপিতে দুদিনের বিশ্রাম। বর্ষা ভ্রমণে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল যোগ। উদুপি থেকে ১৬০ কিলোমিটারের দীর্ঘ যাত্রাপথের অনেকটা অংশ জুড়ে ঘন অভয়ারণ্য সারাবতী। সূর্যের আলো পৌঁছতে পারে না এ গভীরে। টানা ৬০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে কোনও বসতির দেখা নেই। আকাশ কালো করা বৃষ্টি। অনামী কিছু ঝোরা। বৃষ্টি ধোয়া রাস্তায় ঘন কুয়াশা ভেদ করে, মাঝে মাঝে হেডলাইট জ্বেলে দু একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে।
আগের পর্ব পড়ুন: বৃষ্টিভেজা সহ্যাদ্রি – পর্ব ১
অরণ্য পাতলা হলে, ছোট্ট একটা গ্রাম। বেলা পড়ে আসে। ভুখা পেটের খিদে মেটায় সাদামাটা ঝুপড়ি হোটেল। আপ্যায়নে মিশে থাকে স্থানীয় ঘ্রাণ, দক্ষিণী ঘরোয়া স্বাদ। কী প্রয়োজন আড়ম্বরের! বাকি পথটুকু অরণ্য থাকলেও, অল্পবিস্তর বসতি আছে। যোগের কাছে পৌঁছোই বিকেল বিকেল। উত্তর কর্ণাটকের শিমোগা জেলার (অফিসিয়াল নাম শিভামোগ্গা) সারাবতী নদী অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে নেমেছে। সৃষ্টি হয়েছে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জলপ্রপাত, যোগ।

আমাদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা ছিল সরকারি লজে। জানালায় চোখ রাখলে জলপ্রপাতের একটা ধারা দেখা যায়। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল, বৃষ্টি হয়তো আজ আর ঘর থেকে বেরোতে দেবে না। সাদা মেঘের পর্দা ঢেকে রেখেছে গোটা পাহাড়টাকে। ঘড়ির কাঁটায় ছ’টা, বৃষ্টি ধরে এল। সন্ধ্যা নামতে তখনও ঢের দেরি। যোগ দেখার ভিউ পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে বহু লোক। লজ্জাবতী কখন পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে, সকলে সেই অপেক্ষায়!
শেষ পর্যন্ত কুয়াশামাখা মেঘ সরিয়ে যোগ দেখা দিয়েছিল। সবুজ বনানীর মাঝে তার অনন্য লাস্যময়ী রূপ! বর্ষায় তন্বী শরীরে মেদ জমে লাবণ্য যেন ফেটে পড়ছে! ৮৩০ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়েছে তার চারটি প্রধান ধারা – রাজা, রাণী, রোরার, রকেট। প্রথমদিকে আবছা, অস্পষ্ট। চারটে ধারা একসঙ্গে কিছুতেই পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল না।
কিন্তু, চিনবো কীভাবে! স্থানীয় পর্যটকরা বলাবলি করছে নিজেদের ভাষায়। রাজা, রাণী শব্দ দুটো কানে আসছে। এক ভদ্রলোক ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন। রাজা সবচেয়ে বড়, সোজাসুজি নেমে এসেছে। রাণী তুলনামূলকভাবে সরু, ধাপে ধাপে নেমেছে। প্রচণ্ড শব্দ করে নেমে আসা ধারাটি রোরার। আর রকেট সবচেয়ে সরু, কিন্তু দ্রুতগতিতে সোজা নিচে নেমেছে।
থকথকে কাদায় পা পিছলে যাচ্ছে অহরহ। সাবধানে পা টিপেটিপে চলেছি। অরণ্যের এমন লাবণ্য আগে কখনও দেখিনি। কান পাতলে শোনা যায়, বর্ষামুখর জংলি শব্দ। পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটা বনের গভীরে হারিয়ে গেছে।
যোগের পর আমাদের সহ্যাদ্রি সফরের শেষ গন্তব্য ছিল চিকমাগালুর। যোগে এক রাত কাটিয়ে পরদিন প্রায় দুশো কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঢুকেছিলাম চিকমাগালুর। শহুরে কোলাহল থেকে একটু দূরে আমাদের বাড়ি। ‘আমাদের বাড়ি’ বলছি এ জন্যই, দরজার বাইরে জুতো খুলে রাখার সময় বাড়ির মালিক মিঃ প্রবীন জোকিম গোনসা এমনটাই বলেছিলেন, “দিস ইজ ইয়োরস্ ফর টু ডেইজ”। ডাল, আলুভাতে, বড় আলু দিয়ে চিকেনের ট্যালট্যালে ঝোল রেঁধেবেড়ে, বাসন মেজে সত্যিই বাড়িটা যেন দুদিনেই ‘আমাদের’ হয়ে উঠেছিল।
প্রবীন এ বাড়িতে থাকেন না। কিন্তু সাজিয়ে গুছিয়ে যত্নে টিপটপ করে রেখেছেন। আমাদের চাবি দিয়ে চলে গেছিলেন। আবার ফেরার দিন চাবি নিতে এসে কত গল্প শুনিয়েছেন। ‘চিকমাগালুর’ শব্দের অর্থ ‘কনিষ্ঠ কন্যার শহর’। স্থানীয় কোনও এক প্রধান তাঁর কনিষ্ঠ কন্যাকে উপহার হিসেবে এই এলাকা দেন, সেই থেকে নাম হয়েছে চিকমাগালুর। একটা মজার কথা, পনেরো দিন অন্তর নাকি মেঘের নাম বদলায় আর এখানকার বাসিন্দারা আদর করে মেঘকে নানা নামে ডাকে।

এ অঞ্চলের প্রকৃতির একটা মায়াবী স্পর্শ আছে। হেব্বে ফলস দেখতে যাওয়ার পথে সেটা অনুভব করেছিলাম। বিস্তৃত ভ্যালি যেন প্যাস্টেল রঙে আঁকা ছবি। জঙ্গলের লম্বা গাছগুলোকে জড়িয়ে গোলমরিচের লতা। পথের ধারে ত্রিপল খাটিয়ে আগুনে ভুট্টা সেঁকছে কোনও বিক্রেতা। আর মাইলের পর মাইল, রাস্তার দুধারে কফি বাগান। (Falls)
ভারতে কফি চাষের সূচনা হয়েছিল এখানেই। ১৭শ শতকে বাবাবুদান নামে এক সুফি সাধক ইয়েমেন থেকে কফির বীজ এনে এখানে রোপণ করেন। আজও চিকমাগালুরকে ভারতের ‘কফি ল্যান্ড’ বলা হয়। বাবাবুদান পাহাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই কফি আনার কাহিনি। যদিও এ যাত্রায় ওপথে যাওয়ার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই। (Falls)

হেব্বে ফলস দেখতে আমরা দুপুর দুপুর পৌঁছেছিলাম অরণ্যে ঢাকা কেম্মানগুন্ডি পাহাড়ে। ৬২ কিলোমিটার পথ। ‘এলিফ্যান্ট করিডোর’, লেপার্ডের ছবি দেওয়া সাবধানবাণীর বোর্ড দেখেছিলাম আসার পথে। হেব্বে ফলস স্টার্টিং পয়েন্ট, বিশ্বনাথনের গাড়ি এ পর্যন্তই। এরপর জিপ সাফারির জন্য অপেক্ষার কিউ। সাফারির শেষ জিপটা ছাড়বে বিকেল সাড়ে তিনটেয়। একেকটা গাড়ি ফিরছে, আপাদমস্তক ভিজে ট্যুরিস্টরা নেমে আসছে। (Falls)
আমাদের সাফারি শুরু হয়েছিল দুপুর দুটোয়। বৃষ্টি কখনও জোরে, কখনও হাল্কা। কাদামাখা, কাঁচা রাস্তা। গোটা জঙ্গল ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। সেই অস্পষ্টতায় চারপাশ আবছা। ভর দুপুরে হেডলাইট জ্বেলে ঝাঁকুনি দিতে দিতে গাড়ি ছুটছে। পাতাবিহীন লম্বা লম্বা গাছগুলো ডালপালা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হরর মুভি যেন! (Falls)
১২ কিলোমিটার চলার পর জঙ্গলের মাঝে একটা জায়গায় জিপ থামল। সামনেই বনদপ্তরের ঘর, তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। জিপ চালক সবাইকে বললেন, এখান থেকে পায়ে হেঁটে ফলসের কাছে পৌঁছতে হবে। এক ঘন্টার মধ্যে ঘুরে আসতে হবে, নাহলে ১০০ টাকা ফাইন। (Falls)
ভেবেছিলাম, কতদূরই বা হবে! কিন্তু, অনেকটাই হাঁটা। পথটাও মোটে সহজ ছিল না। কাদায় পিছল। দু একজন আছাড় খেয়ে কাদা মাখামাখি অবস্থা। বৃষ্টি থামলেও, পাতা গড়িয়ে টুপটাপ জল পড়ছে অনবরত। কোনও ধারণা ছিল না, হাঁটতে হবে। আজ সঙ্গে রেইনকোটও নেই, ছাতাই ভরসা। (Falls)

চড়াই – উৎরাই পথে থকথকে কাদায় পা পিছলে যাচ্ছে অহরহ। সাবধানে পা টিপেটিপে চলেছি। অরণ্যের এমন লাবণ্য আগে কখনও দেখিনি। কান পাতলে শোনা যায়, বর্ষামুখর জংলি শব্দ। পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটা বনের গভীরে হারিয়ে গেছে। দুটো সেতু পেরোলাম। দ্বিতীয় সেতু পেরোনোর পর শুনতে পেলাম জলপ্রপাতের গর্জন, তাকে দেখার উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। (Falls)
কয়েক পা এগিয়ে পাহাড়ি বাঁকের আড়ালটুকু সরে যেতেই বোবায় পাওয়া বিস্ময়ে থমকে গেছি। ৫৫৩ ফুট উঁচু থেকে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হেব্বে। প্রচণ্ড দমকা হাওয়ায় আছড়ে পড়া জলবিন্দুগুলোর ঝাপটা যেন বৃষ্টির মতো। ছাতা উলটে যাচ্ছে। কাছে পৌঁছনোর আগেই ভিজে একসা হলাম। একই সময়ে আকাশের অকৃপণ বারিধারায় পুরো স্নান। (Falls)

ভিজে মাটিতে বনজ ঘাসপাতারা অকাতরে ভিজেছে। ফেরার পথে আর ছাতা খোলার চেষ্টা করিনি। তবে জোঁকের কবলে পড়েছিলাম। বর্ষার জঙ্গলে জোঁক ধরবে না, তাও আবার হয় নাকি! বিশ্বনাথনের গাড়ির কাছে যখন পৌঁছলাম, তখন বিকেল পাঁচটা। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। তাতে আক্ষেপ নেই। গাড়ির কাচ তোলা। গ্লাস ওয়াইপার মুক্তোর মতো জলকণাগুলো মুছে দিচ্ছে। ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া। চোখের পাতা বুজে আসছে। মনটা গুনগুনিয়ে উঠল, “এসো শ্যামল সুন্দর”। (Falls)
(সমাপ্ত)
ছবি ও ভিডিও: লেখক
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।
One Response
ভালো লাগলো। হেব্বে জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার পদব্রজ উপরি পাওনা।