মুক্তি বললে আমার চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে খোলা আকাশ। অনেকখানি আকাশ দেখতে পাওয়া। একটা দুটো গাছের মাথা আর মেঘ। হয়তো সেই যে চার বছরের বন্ধ থাকা, আকাশ দেখতে না পাওয়া চার বছর ধরে, সেই তৃষ্ণা কোথাও আমার মাথার ভেতরের খোপে ‘মুক্তি’ শব্দের সঙ্গে আকাশের চাবিটা লাগিয়ে দিয়েছে। আজ আকাশ দেখতে পাই ছাদে গিয়ে, গভীর রাত্রে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, ভোরের আকাশ সন্ধ্যার আকাশ অন্ধকারে একটিমাত্র পাখির ডাকের আকাশ ….
জাল ছিঁড়ে যায় আর মনে পড়ে এই যে আমি আমার ঘরে বসে আমার গৃহের নিরাপত্তার মধ্যে মুক্তি বললে আকাশ দেখি, যেই মেয়েটি হেঁটে আসছিল দিনের পর দিন পায়ের নিচে রুক্ষ মাটি তেষ্টার জল নেই, কী খাবে কী খেতে দেবে সন্তানদের, সঙ্গে থাকা মানুষদের, পরদিন- এই চিন্তার ওপর ভর রেখে হাঁটছিল মাইলের পর মাইল, তার মুক্তিভাবনা কোথায় রূপ নিয়েছিল? কোন মুক্তির কথা ভাবছিল সেই সব মেয়েরা বিভিন্ন বড় প্রজেক্ট এর জন্য ঘর গ্রাম জঙ্গলের অভ্যস্ত আশ্রয় থেকে উচ্ছেদ হয়ে পুনর্বাসনের নামে যারা ছিটকে পড়েছিল নিজেদের এলাকা থেকে অনেক অনেক দূরে? কোয়েনা বাঁধের জন্য উচ্ছেদ হওয়া তিনশ পরিবারের মধ্যে একজন, কেশরবাই, ন’দিন না-খেয়ে থাকবার পর কোনওক্রমে জোগাড় করা একটা রুটি খাবার চেষ্টা করে মরে যায়, তার প্রিয় কুকুরের আঁচড়ের অনেকগুলো দাগ ছিল তার অশক্ত শরীরে কেন না একটাই রুটি আপ্রাণ দখল করার চেষ্টা করেছিল তারা দুজনেই। মুক্তি বলতে কোন ছবি ভেসে উঠেছিল কেশরবাইয়ের শেষবারের মত বন্ধ হতে যাওয়া মনের চোখে? একথালা খাবার, নাকি তার ঘরের কোনে মরে পড়ে থাকা বৃদ্ধ স্বামীর চেহারা? গ্রাম ছেড়ে আসতে হয়েছিল তাদের, আরও অনেক লোকের মতোই।

নিজেদের গ্রাম-জঙ্গল ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে, আসতে হওয়া যেই আদিবাসী মেয়েটি খাকি উর্দি পরে আইনরক্ষকের চাকরি করে, অন্যদের ওপরে কিছু ক্ষমতা ফলানোর স্বাদ পায়, সে কি কোনওদিন হোস্টেলে শুয়ে স্বপ্ন দেখে তার জাহেরথানের, সহরাই পরবের, দং নাচের? কোন কথা ভাবে সে মুক্তির আনন্দ বললে? প্রধানমন্ত্রীর আসনে উজ্জ্বল বসে থাকা যে মহিলার কড়া প্রশাসনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ দুনিয়ার মন্ত্রী ও রাজন্যবর্গ, কেমন ছিল তাঁর মনে ‘মুক্তি’র নিভৃত স্বপ্ন? ববি স্যান্ডস আর তার চার সঙ্গী তরুণের আয়ার্ল্যান্ডের জেলে একুশদিনের অনশনে মৃত্যুবরণ যাঁকে টলাতে পারে নি, সেই নারীর? তাই, বোঝার চেষ্টা করছি ‘মেয়ে’ বললে কাদের বুঝি? একইরকম সব মেয়ে? একই মুক্তির স্বপ্ন সকলের?
মাইলের পর মাইল হাঁটছিলেন মেয়েরা, পুরুষদের পাশে পাশে। হাতে মাথায় সংসারের যথা সর্বস্ব। কাছে আঁকড়ে রাখা বাচ্চারা- ছেলে মেয়ে সব। ভাবছিলেন ঘরে ফিরছেন কিন্তু স্পষ্ট করে জানেনও না যে সত্যি কোথায় সেই ঘর। যুদ্ধে বিদীর্ণ সীমান্ত এলাকা থেকে পালাচ্ছে মানুষ। কোথাও একটু নিরাপত্তার সন্ধানে। সিরীয়া থেকে কাশ্মীর, পাকিস্তান থেকে আমাজনের জঙ্গল। মেয়েরাও আছেন সেই ভাঙাচোরা মানুষদের দঙ্গলে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সংসারের শব কাঁধে। বড় বড় রাস্তা ছুটে যাচ্ছে দেশ জুড়ে, নদীদের বুকের ওপর লক্ষ টন পাথর সিমেন্ট চাপিয়ে উঠেছে প্রকান্ড সব বাঁধ। ভাঙনে বেঁকে যাচ্ছে যে নদীর শরীর আর খসে যাচ্ছে তটভূমিতে নিশ্চিন্তে বসানো ছোটবড় গ্রাম।
নিজেদের গ্রাম-জঙ্গল ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে, আসতে হওয়া যেই আদিবাসী মেয়েটি খাকি উর্দি পরে আইনরক্ষকের চাকরি করে, অন্যদের ওপরে কিছু ক্ষমতা ফলানোর স্বাদ পায়, সে কি কোনওদিন হোস্টেলে শুয়ে স্বপ্ন দেখে তার জাহেরথানের, সহরাই পরবের, দং নাচের?
সেইসব জনপদ, ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠ জুড়ে যে লক্ষ লক্ষ মেয়েরা বাস করতেন, যাঁরা সেখানে জীবনজোড়া ভালোবাসায়, যত্নে গড়ে তুলেছিলেন লক্ষ লক্ষ সংসারের আশ্রয় আর সম্পদ, ‘পরিবেশ উদ্বাস্তু’ নামে চিহ্নিত হয়ে যাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশময় অতিরিক্ত জঞ্জালের মত, সেই সকল মেয়েরা…!
মেয়েদের মুক্তির প্রথমশর্ত হিসাবে আমরা বহুদিন থেকে শুনেছি ‘আর্থিক ক্ষমতা অর্থাৎ নিজস্ব ক্রয়ক্ষমতার কথা। ক্রয়ক্ষমতা থাকা মানুষ হল ক্রেতা, কাজেই বাজার তাকে গুরুত্ব দেয়। বিশেষত ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন মেয়েরা বাজারের আরও বেশি প্রিয়। কারণ বিরাট সংখ্যক মেয়ে একদিকে যেন বাজারের নানা উপাদানে বানিয়ে তোলা সৌন্দর্যের মডেল পুতুল। তাদের নিজেদের কাছে নিজেদের প্রথম পরিচয় সৌন্দর্যে সে কতখানি ‘আকর্ষণীয়া’। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সারাদিন ধরে তাকে সেই ‘আকর্ষণীয়া’ হয়ে ওঠার কৌশল শেখায়। তাকেই প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি মেয়ের অস্মিতা বলে। তাকে গান গাইবার জন্য গৌরাঙ্গী হতে হয়, চাকরিতে উন্নতি করার জন্য স্লিম হতে হয়, অফিস ও সংসারের খাটনি সামাল দেবার জন্য খেতে হয় হেলথ ড্রিংক। অন্যদিকে অসংখ্য ক্রয়ক্ষমতা থাকা মেয়ে হয়ে উঠতে পারে বাজারের মহা বিজ্ঞাপিত আসলে তত-সত্য-নয় বস্তুগুলোর ক্রেতা। ঘর ভরে ওঠে বস্তুতে আর বাইরে ভরে ওঠে অপ্রয়োজনীয় নিত্য ফেলে দেওয়া আবর্জনায়। এই কথাটি এত স্বপ্রকাশ যে তার কোনও প্রমাণপত্রও লাগে না। এই ’সুন্দরী সাজানোর’ প্রবণতাকে মাঝে মাঝে পুরুষতান্ত্রিকতার নজর বলে দোষ দেওয়া হয় কিন্তু সেই দোষের প্রকৃত ব্যবস্থাপক, ফাঁদ ও শিকার- কারও বিষয়েই কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এমন কি, নেবার চেষ্টাও দেখা যায় না তেমন ভাবে। বরং অতি সরলীকৃত ভাবে বিষয়টা নেমে আসে মেয়ে বনাম পুরুষ- এই সংঘাতের ভঙ্গীতে। সকলেই জানি- মেয়েরা সবাই এক নয় পুরুষরাও সবাই নয় একরকম। তবু, পুরুষতান্ত্রিকতা আর পুরুষ এক নয়- এই জানা কথাটাও যায় ঘুলিয়ে আর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে থাকে সেই আপাত সরলতার বিন্দুতেই।
এই নানারকম মেয়েদের মাঝখানে কোন মেয়ের মুক্তির কথা তাহলে ভাবব আমি? মুক্তি ভারি আশাবাদী সদর্থক ভাবনা। এই দেশের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংখ্যক যে মেয়েরা, তাদের মুক্তি-ভাবনাকে বাদ দিলে এই সুন্দর বিষয়টি নিয়ে সামগ্রিক কোনও চিন্তা সম্ভব নয়। আমার সহজ বুদ্ধিতে মনে হয় মুক্তির মত এত বড় একটা বিষয় ভাবতে হলে সমাজকে বাদ দিয়েও সেটা ভাবা অসম্ভব।

এই যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মেয়ে, বিভিন্ন ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দূরে যাদের অবস্থিতি, সেই কয়েক কোটি মেয়ের মুক্তি-ভাবনাকেই আমি দেখবার/আন্দাজ করবার চেষ্টা করি আমার নিজের জায়গা থেকে। আমি সত্যিই জানিনা মুক্তির কোন ভাবনা ভাবে সেই মেয়েটি যে জীবিকা হিসেবে প্রতিদিন খুব কম দামে নিজের শরীরকে ভাড়া খাটাতে বাধ্য হয়। বিশেষত, যার পেছনে আছে একটি পরিবারের স্থানচ্যুত হয়ে বা অভ্যস্ত জীবিকা হারিয়ে বাজারে বিক্রি হতে আসার ইতিহাস। যেমন জানিনা উচ্ছেদ হয়ে আসা জনপদের মায়েদের কথা, কর্ণাটকের খনির কারণে উচ্ছেদ হওয়া রঙ্গাম্মা নিজের নয় বছরের মেয়ে নাগাম্মাকে দু হাজার টাকার বিনিময়ে অচেনা দালালের সঙ্গে যেতে দেয় শহরে কাজ করার জন্য। রঙ্গাম্মা কিংবা রুকনাম্মার মতো আরও অসংখ্য মায়ের কথা যারা নিজের ছোট ছোট মেয়েদের অচেনা লোকের হাতে বেচে দেন, ট্রাফিকিং বন্ধ করতে আসা’ স্বেচ্ছাসেবকদের বলেন, ‘তোমরা কি ভাব আমরা ভালোবাসিনা আমাদের মেয়েগুলোকে? জন্ম দিয়ে দুধ খাইয়ে বড় করিনি ওকে?’ বলেন পরিবারকে ক্ষুধা থেকে মুক্ত রাখার জন্য আর কোনও উপায় অবশিষ্ট নেই তাদের হাতে। যে সব প্রতিশ্রুতির শেষে তাদের পরিবারগুলি এসে পড়েছিল ওইসব জায়গায়, সেই ব্যবস্থাপনার কোনও চিহ্ন দেখা যায় নি কাজ মিটে যাওয়ার পরে। কতদিন সেই ক্ষুধামুক্তির আয়ু! আমি ভাবতেও পারিনা কোন মুক্তির স্বপ্ন সত্যি দেখেন সেই আদিবাসী সমাজের মেয়েরা রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাদের হাড় ভাঙে পাথর খাদানের ক্রাশার বেল্টের নিচে, যাদের পুরুষরা ঘরে ফেরে নেশায় টলতে থাকা ভাঙ্গা যন্ত্রাংশের মত আর সকালে উঠে বাসি রাত্রি কাটতে না কাটতেই চলে যায় খাদানে ছিন্ন হতে। কোন আকাশের কথা ভাবেন সদ্যোজাত শিশুর মা, দিন শেষ হয়ে আসা বৃদ্ধা। যাদের কালকের খাবারের সংস্থান থাকেনা, পৃথিবীজুড়ে সেই লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষ যাদের পায়ের নিচে মাটির কোনও স্থিরতা নেই, সেই সংসারের মেয়েরা। হাজার হাজার আয়লান তেহরিনার মা। শুধু পরদিন ভোরে ঘরের মানুষগুলোকে চোখে দেখতে পাওয়াই যাদের একমাত্র ভবিষ্যতের আশা।
এই ভালোবাসার প্রধান প্রকাশ হল নানাভাবে পরিবারের পুষ্টিবিধানের চেষ্টা করে যাওয়া। এই চেষ্টার মধ্যে দিয়ে পুরনো সমাজের মেয়েরা এক জ্ঞান-সাম্রাজ্য আবিষ্কার করেছিলেন যাকে আমরা চলতি কথায় বলি রান্নাবান্না। নিজেদের আশপাশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে নিজেদের বুদ্ধি, ক্রিয়াশীলতা আর কুশলতা দিয়ে মেয়েরাই অসাধারণ সব স্থানিক পুষ্টি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত রাখতেন।
অথচ এইসব মানুষ ছিলেন বিভিন্ন গোছানো পরিবারের অংশ। এই মেয়েরা ছিলেন বুক দিয়ে তৈরি করা সযত্নে লালিত সংসারের গৃহিণী। এদের হাত থেকে চলে গিয়েছে এদের পুরনো বসতি অঞ্চল এদের পুরনো জীবিকা এদের পুরনো জঙ্গল নদী পুকুর গ্রাম ক্ষেত। বহু প্রজন্ম ধরে অনেকের যত্নে গড়ে তোলা অভ্যস্ত গৃহস্থালি ছেড়ে, অজানা জায়গায় অমিত্র পরিবেশে না-জানা কাজের অমর্যাদায় যে মেয়েদের নিরুপায় সংসারগুলি এসে আছড়ে পড়ে, সেইখান থেকে তারা প্রায় সবসময়ই দেখেন নিজের ঘরে ফিরে যাবার মুক্তির স্বপ্ন। নিজের দরিদ্র কিন্তু গোছানো গৃহস্থালীতে প্রিয়জনকে দু’মুঠো দুবেলা আদরের অন্ন বেড়ে দেবার, মানুষের ন্যূনতম মর্যাদায় দিন কাটাবার স্বপ্ন।
মাসের পর মাস বছরের পর বছর কোটি কোটি মেয়ে, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে বঞ্চিত হচ্ছেন সেই ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য আর মর্যাদা থেকে। অনেক দূরে থাকা অন্য মানুষদের তৈরি এক ব্যবস্থা তাদের গৃহহীন মর্যাদাহীন ছুঁড়ে দিচ্ছে চূড়ান্ত বিপন্নতার মধ্যে। সেই ব্যবস্থা যারা অতি সক্ষমভাবে কায়েম রাখে তারা পুরুষ না মেয়ের শরীরে বাস করে, কিইবা আসে যায় তাতে!

আমাদের মত প্রাচীন সভ্যতা ও প্রাকৃতিক সমৃদ্ধির দেশে বাজারই আজকে পুরুষতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত চেহারা। বাজার চায় চূড়ান্ত একচেটিয়া কেন্দ্রিকতা – যেখানে কোনো বস্তু বা পরিষেবা স্থানিক হবে না। স্থান বিশেষত্ব ভিন্ন হবে না। এইভাবে বাজারই শেষ পর্যন্ত মেয়েদের নিজেদের অধিকার ও শক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। সেই বিরোধিতাকে বাজার অতি সূক্ষ্মভাবে সাংস্কৃতিক পথে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করে, অনেক সময় মেয়েদেরই সাহায্য নিয়ে। ‘আধুনিকতা’ নামের নিদালি দিয়ে বিশ্বাস করায় পুরোন মানে ‘সেকেলে’। অর্থাৎ অচল। হাস্যকর। ফাঁদ পাতে। প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে বহু প্রজন্মের জ্ঞান-অর্জিত কুশলতায় সন্তর্পণে ব্যবহার করার যে বিদ্যা মেয়েদের নিজস্ব ছিল, ‘আধুনিকতা’র সংস্কৃতি তাকে একেবারে মুছে ফেলে স্থানিক প্রাকৃতিক সম্পদগুলির ওপর অধিকার থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েদের বঞ্চিত করছে। মেয়েদের অপুষ্টির যে ভয়ানক ছবি আমরা দেখি, মেয়েদের শারীরিক দুর্বলতা এবং দুর্দশার যে হিসাব পাওয়া যায়, তার প্রধান কারণ মেয়েদের সমাজ ইচ্ছে করে না-খাইয়ে রাখে, তা নয়। এর প্রধান কারণ দারিদ্র। পরিবার পিছু যতখানি পুষ্টি দরকার, তার তীব্র অভাব। পরীক্ষা নিলে দেখা যাবে দরিদ্র পরিবারের পুরুষদের শারীরিক দশা মেয়েদের থেকে খুব বেশি ভালো নয়।
সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়ে এখনও সংসার করতে ভালোবাসেন। পরিবারকে ভালোবাসেন। সেই ভালবাসাই তাঁদেরকে চালিত করে। এই ভালোবাসার প্রধান প্রকাশ হল নানাভাবে পরিবারের পুষ্টিবিধানের চেষ্টা করে যাওয়া। এই চেষ্টার মধ্যে দিয়ে পুরনো সমাজের মেয়েরা এক জ্ঞান-সাম্রাজ্য আবিষ্কার করেছিলেন যাকে আমরা চলতি কথায় বলি রান্নাবান্না। নিজেদের আশপাশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে নিজেদের বুদ্ধি, ক্রিয়াশীলতা আর কুশলতা দিয়ে মেয়েরাই অসাধারণ সব স্থানিক পুষ্টি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত রাখতেন। শিক্ষা স্বাস্থ্য গণতান্ত্রিকতার সমস্ত সুফল থেকে বঞ্চিত ভারতের সাধারণ মানুষ যদি নিজেদের অভ্যস্ত জীবিকাগুলিতে স্থিত থাকতে পারতেন, মেয়েরা যদি নিজেদের অর্জিত জ্ঞানকে অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন শিক্ষার সুযোগ পেতেন, তাহলে আজকের সমাজ এমন ভয়াবহ শূন্যতায় ডুবত না।

দেশ যে চরম দারিদ্র আর দুর্দশার মধ্যে দিয়ে চলেছে, তার দায় ধনের বৈষম্য, একথা আজ প্রকাশ্য। এই বৈষম্যের মূল হল সমস্ত প্রাণীর যাতে সমান অধিকার, সেই প্রাকৃতিক সম্পদগুলির ওপর অল্প কিছু মানুষের অস্ত্রের জোরে দখলদারি। সেই দুর্দশার মার সবচেয়ে বেশি পড়ে উৎপাদক সমাজের মেয়েদের ওপর। যে কোটি কোটি পরিবার নিজেদের এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে ছেঁড়া কাগজের মত অবহেলায় কোথাও-না কোথাও কোনওক্রমে টিঁকে থাকার চেষ্টায় লুটোচ্ছেন, কিংবা যারা অভ্যস্ত জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে অন্য কোনও কাজে শ্রম-বুদ্ধি-মেধা নিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিবারগুলি এ ধরনের চাপে সাধারণত ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে। উভয় ক্ষেত্রেই নতুন পরিবেশের প্রভাব আর ছিন্নমূল হবার নানাবিধ বিপন্নতা এদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে মুছে ফেলতে থাকে। এখানে সবচেয়ে বিপন্ন হন মেয়েরা। ব্যক্তিগত ভাবে পরিবারের অন্য সদস্যদের দরকারি রক্ষণাবেক্ষণ দিতে না-পারা, প্রায়ই, বিশেষত শিশু ও ছোটদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া, নিজের অভ্যস্ত জীবনযাপন ধ্বংস হবার ফলে অনভ্যস্ত শ্রম ব্যবস্থার শিকার হওয়া — নানাভাবে বিকৃত বা ধ্বংস হয়ে যায় এদের জীবন।
নিজেদের আয়ত্তের বাইরের শক্তির চাপে দেশের বিরাট সংখ্যক মেয়ে বঞ্চিত হন সহজপ্রাপ্ত জলের ওপর, ফসলের ওপর, সুস্থ বাসস্থান আর বন, ঝোপঝাড়, পরিছন্ন পরিবেশের অধিকার থেকে। এর বেশির ভাগটাই করা হয় ‘কর্মসংস্থানের নামে। যে কর্মে বহু মানুষের দীর্ঘকালের কুশলতা ছিল, যেমন কৃষি ও হস্তশিল্প, সেই সব কাজের মূল আধার প্রাকৃতিক সম্পদের সহজ অধিকার দেশের মানুষের হাত থেকে ক্রমে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হয়ত এই সকলের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে সহজ ব্যবহারের অধিকার থাকলেই হয়ত শহরের আর গ্রামের কোটি কোটি অধিকারহীন মেয়ের জীবনে প্রকৃত মুক্তি থাকত। যেখানে তাঁরা নিজেদের বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা দিয়ে সাধারণ প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে নিজের সংসারের, বড় পরিসরে সমাজের অনেকটার, প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিলেন। সেই সক্ষমতার সৌন্দর্যই সেই বিশালসংখ্যক মেয়ের মুক্তি ছিল।

সেই মেয়েটিকে মনে পড়ে খুব- একটি মহিলা গোষ্ঠির উৎসবে নেচেছিল, হলুদ শাড়িজড়ানো তার শরীরটি দুলে উঠছিল শেখানো নাচের ছন্দে- ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…’। শুনলাম ঘরে তার ছেলে পঙ্গু। স্বামীও অসুস্থ এক্সিডেন্টে। বলেছিল, ‘দুঃখ তো আছেই। যতটা পারব, করতে তো হবেই। তাবলে কী আনন্দ করব না, বলো? সবসময় কি কাঁদব? তাইলে ঘরের লোকগুলো টিঁকবে কি করে?’ নিজের ভাঙা ঘরটি থেকে বেরিয়ে অন্য মেয়েদের সঙ্গে অনেকদূর সে এসেছিল, নিজের জোরেই।
জয়া মিত্র বাংলা ভাষার এক জনপ্রিয় কবি ও গদ্যকার। সত্তরের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রাজনৈতিক বন্দীদশাও কাটিয়েছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, এই সমস্ত মাধ্যমেই তাঁর অনায়াস যাতায়াত। লেখালেখি করেন ছোটবড় একাধিক সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায়।জল, প্রকৃতি, পরিবেশ, নারী ও শিশু বিষয়ে ওঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। 'হন্যমান', 'জলের নাম ভালোবাসা', 'রূপুলি বেতের ঝাঁপি', 'মাটি ও শিকড়বাকড়' জয়া মিত্রর কিছু জনপ্রিয় ও সমাদৃত বই।