ইতিমধ্যে আমি প্রিয়গোপাল দাস (Priyagopal Das) কে নিয়ে কিছু কিছু করে তথ্য সংগ্রহ করছি। আগেই বলেছি কাঠখোদাই শিল্পীদের নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না, যে কারণে কোনও শিল্পীরই ব্যক্তিগত তথ্য পাওয়া যায় না। বটতলা নিয়ে হই চই নানা সময়ে হয়ে চলেছে, কিন্তু বটতলার এইসব অন্ধকারে থাকা শিল্পীদের অবদানের কথা কেউ বলার চেষ্টা করেনি, শুধু তাদের কাজ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে গেছেন। অবশ্য বাইরের দেশের শিক্ষিত মানুষজন এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল বলে আমরা বেশ কিছু ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি ওদের সংগ্রহশালার দৌলতে। তারা অনেকেই এইসব ছবি নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছেন তাদের বইতে, কিন্তু তারাও হদিস দিতে সক্ষম হননি এইসব শিল্পীদের নিয়ে। যেমন, শ্রীরামপুরের পঞ্চানন কর্মকারকে নিয়ে কেউ খুব বেশি আলোচনা করেননি কেবল কয়েকজন বিদেশি ব্যক্তি ছাড়া। ওঁর স্বীকৃতি অনেক পরে এসেছিল। একই সঙ্গে ওঁর একমাত্র জামাই মনোহর কর্মকার ও তাঁর ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার— এঁদেরও অক্ষর গঠনে ও কাঠখোদাই ছবির জন্য স্বীকৃতি এসেছে কিছু বিদেশি ব্যক্তির হাত ধরে। অথচ এঁরা না থাকলে আমরা শিক্ষার দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকতাম। আমাদের উদাসীনতায় আমরা হারিয়ে ফেলেছি ইতিহাস গড়ার এইসব কুশীলবকে। আমাদের লোকজ শিল্পটাই এমন আমরা কেবল দেখি তাঁদের কাজটিকে, দেখি না তাঁদের কুশলী শিল্পী সত্তাটিকে।

এই প্রিয়গোপাল দাসকে (Priyagopal Das) নিয়ে কাজ করতে করতে বারবার আমার এই কথাগুলো মনে এসেছে। গ্রাম থেকে আসা এক বালক এই বটতলা চত্বরে খুঁজে নিয়েছে তার ভবিষ্যৎকে। কলকাতা তাঁকে খুঁজে আনেনি। তিনি এসেছেন এবং একটা অধ্যায় গড়েছেন তাঁর হাতের জাদুতে। প্রয়োজন পড়েনি কোনও কেতাবি শিক্ষার আলোতে নিজেকে আলোকিত করার।
কয়েক বছর বাদে আবার যখন আমি খোঁজ করলাম সেই অ্যালবামটির, শুনলাম সেটা কেউ একজন নিয়ে গেছেন বই করবেন বলে, তারপর আর ফেরত দেননি। কি ভয়ংকর! এবং যিনি নিয়ে গেছেন তাঁর নামটা কেবল তাঁরা জানেন, আর কিছু জানেন না। জানি না হাত বদল হতে হতে সেটি এখন কোথায়! ভাগ্যিস, আমি পুরো বইটির একটা স্ক্যান কপি করে রেখেছিলাম নিজের কাছে। সেটা থেকে আরও ডিটেইল বার করার জন্য আমি দিনের পর দিন কম্পিউটারে কাজ করে গেলাম। হ্যাঁ, ততদিনে এই যন্ত্রটি এসে গেছে এবং এটাই উদ্ধার করে দিচ্ছে একের পর এক ছবিকে। তাঁর মাত্র ১৮ বছর বয়সের কাজ দেখে অবাক হয়ে গেছি, যেকোনও ইউরোপিয়ান খোদাই শিল্পীর সমকক্ষ হবার যোগ্য তা।

উনিশ শতকের যে সময় (১৮৮২ থেকে ১৮৮৬) তিনি বটতলায় এসেছেন সে সময় প্রকাশনার বাজার বেশ জাঁকিয়ে আছে সারা বটতলা জুড়ে। গরানহাটায় আর্ট স্কুলের পত্তন হয়েছে। সেখান থেকে পাশ্চাত্য কায়দায় শিল্প শিখে ছাত্ররা বাজার দখল করছেন, কাঠখোদাই শিল্পীদের রমরমার যুগ। পত্রপত্রিকায় তাঁদের দেখা যাচ্ছে। প্রিয়গোপাল যখন এমন বাজার দেখলেন, তখনই ঠিক করে নিলেন ওঁর ভবিষ্যৎকে, ওইসব ভিড়ের মধ্যেই নিজেকে ক্রমে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন এবং একটা সময় আসবে যখন ওঁকে ছাড়া প্রকাশনা জগৎ যেন অন্ধকার দেখে।

প্রিয়গোপাল (Priyagopal Das) হয়ে উঠেছিল প্রকাশনার কুলীন শিল্পী। কলকাতার যত প্রথম শ্রেণীর পত্রপত্রিকা আছে, সব পত্রপত্রিকাতেই ওঁর ছবি থাকবেই। একটা সময় আসে যখন তিনি নিজে একাই স্টুডিও গড়ে কাজ করে গেছে। সেখানেই সবাইকে আসতে হত। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার থেকে শুরু করে পি এম বাগচীর কিশোরীমোহন বাগচী আসতেন বসে থেকে কাজ করিয়ে নিয়ে যাবেন বলে। প্রয়োজনে সারারাত জাগতেন ওঁরাও ওঁর সঙ্গে। আমরা আজও দেখি ঠাকুমার ঝুলিতে ওঁর করা ইলাস্ট্রেশন। এমনকি কোনও এক স্বদেশি বিপ্লবী বিডন স্ট্রিট পোস্টমাস্টারকে হত্যা করে টাকা লুট করে পালায়, সেই মৃত পোস্টমাস্টারের ছবি পরের দিন কয়েকটি দৈনিক ছাপবে বলে সারারাত শিল্পীকে ওই মৃত ব্যক্তির সামনে বসে একের পর এক পোট্রেট করে দিতে হয়েছিল পত্রিকা সম্পাদকদের। এঁরা সবাই সারা রাত বসে থেকেই কাজ করিয়ে নিয়ে গেছেন। ওঁর লোহার সরু তুলিতে ছবির চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে উঠত। ভারতীয় ও অভারতীয় ব্যক্তির চোখের মণির রঙের তারতম্য সাদা কালো রেখা দিয়েই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন।

আমি খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম ওঁর বড় মেয়েকে। তখন তাঁর বয়স ৮০-র কোঠায়। পিতৃবিয়োগের সময় ওঁর বয়স তখন ছিল ১৩, সেই সময়ের স্মৃতি রয়েছে তাঁর মনে ছবির মতো। ওঁর কাছ থেকে যতটা পেরেছিলাম ওঁর স্মৃতিকে নথিবদ্ধ করেছি। সেটা ব্যবহারও করতে পেরেছিলাম আমার বইতে। পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম কিছুই জানত না তাদের পরিবারের এমন এক শিল্পীর কথা।
একজন কাঠখোদাই শিল্পী কতটা সফল হলে কলকাতার মতো জায়গায় পাঁচটি বাড়ি গড়ে যেতে পেরেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। একাধিক সন্তানকে মানুষ করতে পেরেছিলেন!
অবশেষে ওঁকে নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশ করে যেতে পারলাম। ইতিহাসের পাতায় অন্তত তিনি বেঁচে থাকুন।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।