[১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১][১২][১৩]
ছোটবেলায় সেই কবে ঠাকুরমার ঝুলি পড়েছিলাম বলা যেতে পারে উপভোগ করেছিলাম, কতদিন স্বপ্নে ঘুম পাড়ানি মাসি পিসির মতো সেইসব কাহিনির চরিত্রদের দেখতাম। স্বপ্নে কথা বলতাম। শিশু মনের প্রতিক্রিয়া গেঁথে আছে এখনও। সেই বই কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না, আমার কন্যা একটু বড় হতেই ওকে জন্মদিনে কিনে দিলাম সেই বই। কী আশ্চর্য্য, প্রকাশক বইটির যে চরিত্র ছিল হুবহু একরকম ভাবে ছেপেছে। একই রকম বাঁধানো। এমবস করা নাম। আর ভিতরে দক্ষিণারঞ্জনের ছবির সঙ্গে তাঁর পেনে লেখা স্বাক্ষর। মনে হবে এই বইটা তিনি সই করে দিয়েছেন, হুবহু সেই রঙের কালিতে ছাপা। মনে হয়েছে আমি নিজেই শৈশবে ফিরে গেছি।(Wood block)

বইটির কথা উল্লেখ করছি তার কারণ এর লেখার সঙ্গে সঙ্গে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে তার অধিকাংশ ছবিই কাঠ খোদাই পদ্ধতিতে। অল্প কয়েকটা হাফটোন পদ্ধতিতে ছাপা যা ওই সময় শুরু হয়। যদিও আমায় ওইসব ছবি খুব একটা আকর্ষণ করেনি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তিনি দিনের পর দিন গাঁ-গঞ্জের ঘরে ঘরে ঘুরে ঠাকুমা ঠাকুরদাদাদের কাছ থেকে এইসব শিশু ভোলানো গল্পকে রেকর্ড করে আনতেন। কখনও মনের মধ্যে রাখতেন বাড়ি এসে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। তখন মোমের তৈরি সিলিন্ডার রেকর্ডিং যন্ত্র ছিল। সেটা হাতে করে ঘুরতেন। ওঁর এমন লেখা ও সংগ্রহ দেখে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন এমন লেখা আমি কোনদিনই পারতাম না। জানিয়েছিলেন বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে। এমন বইয়ের প্রকাশক পাচ্ছিলেন না, তাই নিজেই ছাপবেন বলে ঠিক করেন। এমন কী একটা প্রেস খুলবেন বলে ঠিক করেছিলেন। যদিও তা করতে হয়নি।
একজন লেখক এমন যত্ন করে বই গড়ছেন শতাধিক বছর বাদেও অবাক লাগে। প্রতিটি পাতা কেমন হবে তিনি আগেই তার নকশা করে নিয়েছিলেন। প্রতিটি ছবির খসড়া তিনি নিজেই করেছিলেন। সূচিপত্র, চ্যাপ্টার হেডিং, নামপত্র, টেলপিস সহ সব পাতার চারদিকের নকশা। লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হয়েছে কিন্তু আজও হ্যারি পটারের পাশে উজ্জ্বল।

প্রিয়গোপাল দাসের কন্যার কাছ থেকে শোনা যে তাঁর বাবার কাছে দিনের পর দিন বসে থেকে ওঁর ছবি থেকে কাঠ খোদাই করিয়ে নিতেন দক্ষিণারঞ্জন। লেখক একদিকে শিল্পীর ভূমিকায় অন্যদিকে সামগ্রিক বইটির শিল্পসম্মত উপস্থাপনার দায়িত্বে। শিশুরা ও তার অভিভাবকরা যাতে বইটি হাতে নিয়ে ভাবতে পারেন তাঁরা এক কল্প জগতের বাসিন্দা হতে চলেছেন।
প্রতিটি কাঠ খোদাই ছবি শিশু মনকে জাদুবলে আকর্ষণ করে রাখার ক্ষমতা রাখত। ভাল কাঠ খোদাই ছবি করিয়ের সংখ্যা কমে এসেছে অনেক। সবাই মেটাল ব্লক করবার জন্য ছুটছেন। কিন্তু কাঠ খোদাই ছবির কাছে মেটাল ব্লক বড্ড বেমানান। ভালো কাঠ খোদাই শিল্পীরা মেটাল ব্লকের চাপে হতাশ হচ্ছেন। যোগীন্দ্র নাথের হাসি খুশি সহ আরও কিছু শিশুপাঠ উপযোগী সহজ সরল লেখা ও কাঠখোদাই ছবির জন্য আজও স্মরণীয়। উনি নিজেই প্রকাশনা (সিটি প্রেস) খুলে নিয়েছিলেন, কারুর উপর ভরসা করেননি। উনিশ শতকের আটের দশক থেকে বই পত্র পত্রিকায় ছবি নিয়ে প্রকাশক সম্পাদকরা যথেষ্ট যত্নশীল হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবাসী প্রকাশনীর বই বা পঞ্জিকা সেইসময় যথেষ্ট উঁচু মানের ছিল। ওরা ছবির জন্য নিজস্ব স্টুডিও গড়ে নিয়েছিলেন। কিছুদিন প্রিয় গোপালের মতো শিল্পীরা ওই স্টুডিও থেকে ওঁদের কাজ করতেন। যদিও পরে প্রিয় গোপাল নিজেই নিজের জন্য স্টুডিও গড়ে নিয়েছিলেন। আর্ট স্কুলের থেকে পাস করা শিল্পীরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের কাজ দেখলেই বোঝা যেত কেমন পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ত্রিমাত্রিক বাস্তব চেহারার সব চরিত্ররা, আলো ছায়া পার্সপেক্টিভ এসব এসে গেছে ছবিতে। ফটোগ্রাফির ম্যাজিক সবাইকে মোহিত করে রেখেছে।

দক্ষিণারঞ্জন কিন্তু এর ধারে কাছে গেলেন না। উনি আরব্য রজনীর গল্পের মতো চরিত্রদের স্বর্গ মর্ত পাতাল সর্বত্র নিয়ে গেলেন। কল্পনাকে দিলেন প্রশ্রয়। কাঠ খোদাই ছাড়া আমরা এমন যেন ভাবতেই পারি না।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।