এখন আমি চিৎপুর আর বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছি সেই শীতলবাবুর কাঠখোদাইয়ের ছোট্ট কর্মস্থলে। তিনি আপন মনে একা সারাদিন ধরেই খোদাই করে চলেছেন। শীত গ্রীষ্ম কোনও বিরাম নেই। একটু এগিয়ে গেলেই দেখা মেলে সেই শতাব্দীপ্রাচীন ডায়মন্ড লাইব্রেরির। সেও আজ মলিন মুখে রয়েছে। দোকানের মালিকের সঙ্গে আলাপ হতে জানলাম তাদের অতীতের গৌরবময় ইতিহাস। বটতলায় তাদের দোকানের বইয়ের চাহিদা ছিল দারুণ নজরকাড়া। নিত্যদিনই বই প্রকাশ হতো। ঝাঁকা মুটের মাথায় করে সেই বই চলে যেত গ্রাম গঞ্জে। এই ঝাঁকা মুটেদের দৌলতে বটতলা ছিল লক্ষ্মীর কৃপাধন্য। এই ব্যবসা তারা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পুরুষানুক্রমে, তিনি সম্ভবত তৃতীয় প্রজন্ম। এখনও তাঁরা যাত্রার জন্য বই প্রকাশ করেন নিয়মিত।
তবে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেলেও ডায়মন্ড লাইব্রেরির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। একইরকমভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আজও। আমি এরপরেও একাধিকবার ওদের দোকানে এসেছি, কেবল দেখতে। পুরনো বইয়ের অন্দরসজ্জার জন্য করা কাঠখোদাই ইলাস্ট্রেশন, তিনি আগ্রহভরে দেখিয়েছেন একের পর এক। তারপর একদিন চমকে দিলেন কিছু কাঠখোদাইয়ের ইলাস্ট্রেশনের অরিজিনাল কাঠের ব্লক এনে! নানা যাত্রা বইয়ের নামের জন্য করা ঢেউ তোলানো সব কাঠের অক্ষর। আহা এই অক্ষর থেকে কত চমকে দেওয়া অক্ষর পরবর্তী সময়ের মহান শিল্পীরা জন্ম দিয়েছেন। হাতের তালুর মতো আকৃতির কাঠের মধ্যে কোটি কোটি রেখার সমন্বয়ে একসময় এই বটতলার শিল্পীরা হাজার হাজার ছবি করেছেন! এই কাজের অরিজিনাল ব্লক যে কখনও দেখতে পাব, কল্পনাও করিনি। স্পর্শ করা তো দূর।

ডায়মন্ড লাইব্রেরির সাধু শীল কেন জানিনা আমার উপর সদয় হলেন। আমি ওঁকে অনুরোধ করেছিলাম সব ব্লকের থেকে কাগজে প্রিন্ট তুলে রাখা খুব জরুরি। কতদিন আর তিনি আগলে আগলে রাখবেন। তিনি রাজি হলেন। আমি একদিন এইসব ব্লক নিয়ে অনেক খুঁজে ভালো ছাপার মেশিন আছে এমন এক প্রেস পেলাম; নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ব্লকের নকশা কাগজে ছাপিয়ে নিলাম। যেদিন ব্লকগুলো ফেরত দিতে গেলাম উনি আমায় আরও অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার মনে হয় এগুলো আপনার কাছেই সযত্নে লালিত হবে, এখানে থেকে কেবল ধুলো খাবে। আর আপনার এই বিষয়ে যখন এত আগ্রহ, আশা রাখি এর প্রকৃত মূল্যায়ন একদিন আপনার হাত ধরেই হবে। এখানে অনেকেই আসে, কিছু পেলে হাতিয়ে নিয়ে চলে যায়, তারপর আর তার কোনও হদিস পাওয়া যায় না। বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। বললাম আপনি যখন আমায় এতটা ভরসা করেছেন আশাকরি এর মর্যাদা রাখতে সক্ষম হব। এরপর অনেকবার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে ডায়মন্ড লাইব্রেরিতে গেছি। অনেক পুরনো বই যা ওদেরই প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, দু-এক কপি করে আছে, কয়েকটি আমার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। যেতেই হাতে তুলে দেন।
একদিন শীলবাবু কাঠখোদাই শিল্পীদের নিয়ে অনেক কথা নিজে থেকেই বলছিলেন (Wood block printing history) যা শুনে রীতিমত বিস্মিত হয়ে গেছি। এর পাশের রাস্তা গরানহাটায় থাকতেন এমন এক খোদাই শিল্পী যার কাজ একসময় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। সেই শিল্পী একসময় কারেন্সি নোট জাল করার জন্য এই কাঠেতেই সূক্ষ্ম রেখায় নোটের ডিজাইন বানিয়েছিলেন যা থেকে জাল নোট ছাপা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ধরাও পড়েন। প্রমাণও হয় যে তিনিই এই জাল নকশার মূল কারিগর। এই খবর সেই সময়ের খবরের কাগজে বেশ চর্চার বিষয় ছিল। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট নিজেও বিস্মিত হন ওঁর এই দক্ষতা দেখে এবং আঙুল কেটে নেবার সাজা মকুব করে দেন। তবে জেলে থাকতে হয়েছিল বেশ কয়েকবছর।

আমি এই শিল্পীর কথা আরও কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম। যখন শুনলাম ওঁর পরিবারের কেউ কেউ আছেন এখনও, আমি সাধু বাবুর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে গরানহাটায় চলে গেলাম। পাশের রাস্তা দিয়ে হেটে পৌঁছে গেলাম এক পুরনো বাড়িতে। সেখানে ওঁর নাতিরা আছেন তবে তারা অন্য পেশায় নিযুক্ত। দাদুর কথা তাঁরা অনেকটাই জানেন তবে তাঁর কাজ কিছুই তেমন রাখেনি। নোট জালের প্রসঙ্গ তুললে কিছুটা বিব্রত হলেন; বেশি গভীরে না গিয়েও অনেক কিছুই জানলাম। ওঁর ব্যবহৃত একটা যন্ত্র ওঁর নাতিরা আমার হাতে তুলে দিলেন। আর দিলেন উই পোকায় খাওয়া একটা পুরনো অ্যালবাম, যেখানে তিনি নিজের কাজের এবং ওই সময়ের কিছু অন্য বিজ্ঞাপনচিত্রের নমুনা সেঁটে রাখতেন। বহু প্ররিশ্রমে ওই অ্যালবাম আমি সংস্কার করে ডিজিটাল কপি করে রাখতে পেরেছি। এই শিল্পী ডায়মন্ড লাইব্রেরির প্রকাশনার জন্য এক সময় অনেক কাজ করে দিয়েছেন।
এমনই অনেক তথ্য ক্রমে আমার ভাণ্ডারে জমতে থাকে। আর ক্রমেই আমারও আগ্রহ বাড়তে বাড়তে আরও গভীরে পৌঁছনোর রাস্তা খোঁজে।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।