কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় জন্মের কারণে ছোটবেলা থেকেই হাজারও বইয়ের গন্ধ গায়ে মাখতে পেরেছি। অলিতে গলিতে প্রেসের কলতান ছিল পরিচিত। প্রেসের অন্ধকার ঘুপচি টুকুর রহস্যে নিজের কল্পনার জগতকে আপন মনে খেলতে দিতে পেরেছি। সিসের অক্ষরের উল্টোমুখ দ্রুত পড়ে ফেলার উত্তেজনা।
পায়ে পায়ে ঘুরতে ঘুরতে হ্যারিসন রোড হয়ে চিৎপুর এ আমার ভবিতব্য যেন অপেক্ষা করছিল। এখান থেকেই আমার উনিশ শতকের কাঠ খোদাই (wood carving in 19th century) অনুসন্ধানের পথ চলা শুরু। ওইসব ছোটো ছোটো ঘুপচি ঘর গুলো যেখানে এক নাগাড়ে কিছু মানুষ কাঠের উপর কাঠ রেখে বাটালি আর হাতুড়ির ঘা মেরেই চলেছে রাত দিন। চারপাশের চলমান জগৎ নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এখানে খদ্দেরের ভিড় তেমন নেই, অথচ খদ্দের আছে, সে আসবে সময় হলে। কাঠের উপর উল্টো অক্ষর কাটছে কোনও দোকান আবার কোনও দোকানে কাপড় ছাপার নকশা তোলা হচ্ছে। কোথাও আবার সন্দেশের জন্য কাঠের ছাঁচ কাটার কাজ চলছে। উত্তর কলকাতার এই রাস্তার নেশা আমায় আচ্ছন্ন করে তুলল অচিরেই।
বাড়িতে পঞ্জিকা আসত, দেখতাম কাঠের ব্লক থেকে ছাপা দারুণ সব ছবি, বিশেষ করে মনে ছাপ ফেলেছিল ফুল ফলের বীজের বিজ্ঞাপন– বড় লাল মূলা তার মধ্যে একটি, ফুলকপি, বাঁধাকপির ছবি, এসবই ছিল কাঠের ব্লক থেকে করা। আর ওইসব অন্ধকার ছোটো ছোটো ঘুপচি ঘর থেকে এইসব চমৎকার কাজগুলো বেরিয়েছে। লক্ষ লক্ষ পাঠককে আনন্দ দিয়েছে। বিজ্ঞাপনকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ঠিক এমনই খুশি হয়েছিলাম ঘরে ঠাকুমার ঝুলি পড়তে গিয়ে সেইসব গল্পের অবিস্মরণীয় সব ছবি দেখেচ এমনকি ঘুমের মধ্যেও ওইসব ছবির চরিত্ররা আমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করত, বিশেষ করে শয়তান বুড়ি আর রাক্ষসরা। আর সত্যি কথা বলতে আজও এইসব চরিত্ররা আমার সঙ্গে যেন কথা বলে। শৈশবেই ভূমিকা হয়ে গেছিল যে এদের কাজ এক অমোঘ টানে বার বার আমাকে এখানে নিয়ে আসবে।
পরিণত বয়সে এসে বুঝলাম, বইয়ের ছাপার জন্য কাঠের কাজ আর কাপড় ছাপার জন্য কাঠের কাজ একেবারেই ভিন্ন। ততদিনে আর্ট কলেজ থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে। ফলে এর মর্ম আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারছি। নিজেও তখন কাঠের উপর ছবির কাজ করছি। হ্যারিসন রোডের সেই সব দোকানের শিল্পীরা তখনও একইভাবে কাজ করে চলেছেন। এবারে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা আরও সহজ হল। কিন্তু আমি সহজ হলেও ওরা সহজে সহজ হল না। এই দূরত্ব আমার মনে যেন আরও জেদ চাপিয়ে দিল। আমি এই শিল্পটিকে জানতে চাই বুঝতে চাই সে যে ভাবেই হোক। কেতাবি বিদ্যা ওদের যেমন নেই আমার তেমনই কেতাবি বিদ্যা আছে কিন্তু বাস্তব জ্ঞান নেই, যা আমার চাই। এদেরই পূর্ব পুরুষরা হয়ত তাজমহল বানিয়েছে কেতাবি জ্ঞান ছাড়াই।

আমার জেদ আমাকে ঠেলে দিল আস্ত একটি ওয়ার্কশপ বানাবার লক্ষে। কসবায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়লাম কাপড় ছাপার ওয়ার্কশপ (cloth printing workshop)। যদিও ওটা আমার গন্তব্য নয়। নারী সেবা কেন্দ্র থেকে কয়েকজনকে নিয়ে আসা হল নিয়মিত কাজের জন্য। এর খুঁটিনাটি জ্ঞান অর্জন করার জন্য বিশেষ টেকনিক্যাল মানুষজন খুঁজে নিলাম যাঁরা কেউই আমায় নিরাশ করেননি। তখন আমি কাঠের ব্লকের জন্য নিজেই একের পর এক ডিজাইন করছি। তারপর নকশা দিয়ে কাঠের ব্লক বানাবার জন্য সেই হ্যারিসন রোডের দোকানে দোকানে গেলাম– এবার তাদের চেহারায় কিছু পরিবর্তন এল। অগ্রিম দিয়ে কাজ করার বরাত দিয়ে এলাম। কিন্তু সহজে তাদের কাছ থেকে কাজ আর পাইনা। দিনের পর দিন ঘুরতে থাকি, পরে জানতে পারি আমার ডিজাইন নাকি ওরা হারিয়ে ফেলেছে। প্রথমেই ধাক্কা খেলাম। আসলে আমার ডিজাইন ওরা বিক্রি করে দিয়েছে অন্য জায়গায়, হয়তো কলকাতার বাইরে। কিন্তু আমি আবার ডিজাইন দিলাম এবং অনেক দিন বাদে হলেও কাজ ফেরত পেলাম।
এবার কাঠের কাজের দক্ষ কারিগরের জন্য শ্রীরামপুরে যেতে হবে। একজন পরিচিতকে সঙ্গে করে চলে গেলাম মিল্কি বাদামতলা নামের এক গ্রামে। সেই গ্রামের প্রতি ঘর থেকেই বাটালির আওয়াজ আসছে। প্রচুর কাজ এদের। ঘরের দাওয়াতে বসে বসে নারকোল মুড়ি খেতে খেতে কাঠ কেটে চলেছে অথবা কাঠের সারফেস প্রস্তুত করে চলেছে। সাদা চক খড়ির সঙ্গে আঠা মিশিয়ে কাঠের উপর লাগিয়ে ঘষে ঘষে সমান করার পর ট্রেসিং পেপারের ডিজাইন তার উপর রেখে পিন দিয়ে ফুটো করে করে পুরো নকশা টা কাঠে তুলে নেওয়া হয়; নকশায় একাধিক রঙের ব্যবহার থাকলে তার চারপাশে পিন মার্ক থাকে। এইসব কাজে মূলত শিশু বা সেগুন কাঠ দীর্ঘ সময় সিজন করিয়ে ব্যবহার করা হয়। তবে অসতর্ক থাকলে এখানেও ঠকিয়ে দেবার জন্য লোকে ওত পেতে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। সৌভাগ্যবশত আমার সঙ্গে ছিলেন এই শিল্পের একজন অভিজ্ঞ বয়স্ক শিক্ষক; তাঁর কাছ থেকেই অনেক শিক্ষা পেয়েছি এর খুঁটিনাটি বিষয়ে।
আমার হাত দিয়ে তখন একের পর এক ডিজাইন বেরোচ্ছে আর খোদাইকারদের জিম্মায় চলে যাচ্ছে। সূক্ষ্ম রেখায় যেমন কাজ হবে তেমনি মোটা রেখাতেও হবে। আমার মধ্যে বরাবর এক্সপেরিমেন্ট করার ঝোঁক আমাকে নানা ভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে যেমন একবার ঠিক করলাম মোটা রেখায় আমার ছবির বৈশিষ্ট রেখে এই ডিজাইন বানাব। কেমন লাগতে পারে তখনও জানি না– একেবারে এক রঙের নকশা হবে আর ওই ডিজাইন যে কেউ কাটতে পারবে। ডিজাইন তৈরি হয়ে এল। কালো রঙের মাধ্যমে ছাপলাম এবং আশ্চর্য্য হলাম এই দেখে, যে এক রঙের মোটা রেখার ডিজাইনের শাড়ির চাহিদা অবাক করার মতো। ছেপে কুলোতে পারছিল না আমার কর্মীরা। বুঝলাম একটা ডিজাইনের আবেদন নির্ভর করে তার নতুনত্বে। আর মৌলিক ভাবনাকে ঠিক ঠিক ভাবে যদি প্রকাশ করা যায় তবে তার ফল আশাপ্রদ হবেই। ডিজাইনে আমার পরীক্ষানিরীক্ষা যেমন চলছে তেমনি পোশাকেও চলছে নানা এক্সপেরিমেন্ট। কাজের সূত্রে আলো দত্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। ওঁর কাজের মধ্যেও ছিল নানা নতুনত্ব। আমদারে দুর্ভাগ্য, ভীষণ জীবনীশক্তি অর্জন করেও স্বল্প আয়ু নিয়ে চলে গেলেন।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।