(World Cycle Day) সাইকেলওয়ালা দেখেছিলাম বটে। দিশি সাইকেলে চেপে বসা এক আশ্চর্য মানুষ সে। জলপাইগুড়ি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে জুবিলী পার্ক পার করে হাঁটা লাগিয়েছি তিস্তার সাদা বালিকে বাঁয়ে রেখে। চড়া রোদ না বলে সূর্য একেবারে ঘাড়ে চড়ে বসেছে বললে ভালো হয়। যাব বোদাগঞ্জ। সে চাট্টিখানি দূরে নয়। পায়ে পায়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। দুপুর যখন এক্কেবারে দুই-কুড়ি তখন সামনে এলো এলোমেলো পথে বয়ে চলা সেই নদী, যাকে শেষ দেখেছিলাম জলপাইগুড়ি শহরের শেষ সীমানায়। (World Cycle Day)

নদীর নাম করলা। তার উপাস্য তিস্তা। জলে কাঁপন আছে। তবে আকুলতা নেই। শোলার তৈরী ছোট্ট ভেলায় নদী পার করে বাঁধে উঠে আসি। সবুজ ছাওয়া পথের দুই পাশে নিকোনো উঠোনে গ্রামের ঘর-বাড়ি। কেমন এক অজানা তৃপ্তি ঘরগুলোকে আগলে রেখেছে। এক, দুই, তিন করে চার নম্বর বটগাছ পার করা গেল। গাছ শেষ, ছায়াও শেষ। সাইকেলের ঘন্টি বাজেনি তবে হরেক মাল বিশ টাকার ঘোষণায় ক্লান্ত শরীর হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। আমার সঙ্গী বেলাকোবার প্রাক্তন বন কর্মী বিজয়দা হাঁক ছেড়ে বলে,
– কী হে…. সাইকেলটাও কী বিশ টাকার?
সাইকেলওয়ালা থামে। মোক্ষম জবাব এল বলে যখন মুহুর্ত গুনছি ঠিক সেই সময় ঘটল অঘটন। হাসি মুখে বলে,
– দ্যান, বিশ টাকা। বউনি এখনই হোক।
– আর সাইকেলের ওপর চাপানো প্লাস্টিকের হরেক মাল? সেগুলো বইবে কে?
বিজয়দা মজা করে বলে।
– কে আবার আমি? যদি আমারেও বিশ টাকায় কিনতে চান, তাও সই।
ব্যালেন্স। তবে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নয়। দু’চাকার ব্যালেন্স। এতদিন ধরে সাইকেল নিয়ে ঘুরাফিরা করি। বারবার খানা-খন্দ সামনে এলে ব্রেক কষতে হয়
এই সাইকেল সওয়ারি সইয়ে নিতে পারে দেখি। হাফ হাতা রঙ জ্বলা শার্ট, আর প্রাচীন কালের ট্রাউজারে ঢাকা কালো শরীরে করলার দূষণ লেগেছে। তবে দৃষ্টিতে হাজার তারার সংঘবদ্ধ উজ্জ্বল আলো। হয়ত এমন ‘রেশম ফিরিরি’ করতে করতে জীবন কাটবে বলে আশঙ্কা করেনি। এতক্ষন ছিলাম শ্রোতা। এবার হলাম কবিয়াল। তবে শব্দের অন্তমিলে গান বাধিনি। বরঞ্চ বলা শব্দের শেষে একটা তিরতিরে বয়ে চলা জলের নিশ্চয়তা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, (World Cycle Day)
– আপনার নাম?
– হিতেন সরকার।
– আপনার দেখি সবকিছুই বিক্রি যোগ্য। নিজের জন্য কী রাখলেন?
ভেবেছিলাম হিতেন এমন ব্যাঁকা প্রশ্নের সোজা জবাব দিতে পারবে না। আমাদের দু’জনকে পুনরায় জবাব দিয়ে বলে,
– কেন? ব্যালেন্স। তবে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নয়। দু’চাকার ব্যালেন্স। এতদিন ধরে সাইকেল নিয়ে ঘুরাফিরা করি। বারবার খানা-খন্দ সামনে এলে ব্রেক কষতে হয়। ভালো লাগে না। থেমে গেলে পড়ে যাওয়ার ভয় লাগে। এর থেকে ভালো, টাকা নিয়ে সেই ভয় আপনাদের বিক্রি করে দেওয়া। আমার ভয় এখন থেকে আপনাদের হবে।(World Cycle Day)

বিজয়দা আর আমি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। অতলান্ত দর্শনে ডুবতে শুরু করলে এমন দুপুর মিছে মনে হয়। মনে হয় সব মায়া-মায়া।
– আপনি তো চমৎকার কথা বলেন।
– না বলে আর উপায় দেখি না। হরেক মাল আনার হিসেব থেকে টাকায় বিক্রি করতে করতে হরেক মানুষও দেখলাম। আর সেই দেখা তো আর শুধুই দেখা না, জন্মের শিক্ষা। সারাটা দিন সাইকেল চালাই আর মালপত্র বিক্রি করি। লেনদেনের দুনিয়াতে কথা শেখা যায় খুব।
– বাড়িতে ফেরার পর কথা বলতে ইচ্ছে করে?
– করবে না? সংসার থেকে আর কোন মস্ত হাট-বাজার আপনি দেখেছেন? সেখানে ভরসা, অভিমান, হিংসা, লোভ সবকিছুর কেনাকেটা চলে। কখনও আমি ক্রেতা আবার কখনও বিক্রেতা। সাবধানে কথার চালে দরদাম না করলে পুরোটাই লস। (World Cycle Day)
আরও পড়ুন: সচেতনতার অভাব আর লাগামহীন দূষণে ধুঁকছে মহাসাগর
আমি ওর বলা প্রতিটা শব্দে রোমাঞ্চিত হই। কোন মরমিয়া সাধুর পাঠশালায় পড়াশুনা করেছে? এমন উপলব্ধির কথা কী বেদেও এত সহজে লেখা আছে? অন্ধকার আকাশের গায়ে যে আলোর রোশনাই চলাচল করে তার সবটুকু এই সাইকেলওয়ালা জমিয়ে রেখেছে বুকে। আর যাই হোক, বিদ্বান হলে এমন উপলব্ধির কথা বলতে পারত না। এ হল প্রজ্ঞানের শব্দ রূপ। (World Cycle Day)
আমি জিজ্ঞাসা করি,
কবে থেকে সাইকেলে চেপে দুনিয়া দেখলেন?
– সেই পনেরো বছর বয়স থেকে। বাবার লাইন আমি পেলাম। উত্তরাধিকার সূত্রে পেলাম মৃত বাবার অন্তিম সৎকারের দায়িত্ব, এই সাইকেল আর কাস্টমারের সহানুভূতি। বয়স এখন আটত্রিশ। গত তেইশ বছরে যে দুনিয়া দেখলাম তার এদিকেও তিস্তা ওদিকেও তিস্তা। এর বাইরে যে দুনিয়া আছে তার খোঁজ আমার কিন্তু নেই। (World Cycle Day)
– বাহ্। যে দুনিয়াদারির কথা আপনি শোনালেন তার মধ্যমণি তো সাইকেল। সেই সাইকেল বেচে দিতে কষ্ট হল না?

– নাহ্, হল না। আপনি শুধু ওই পুরোনো লোহাটুকুই কিনতে পারবেন। আমার শরীরের হাজার হাতির বল, মনে বর্ষা রাতের বিদ্যুৎ চমক কিনতে পারবেন? ওই সব আমার সাইকেল থেকে পাওয়া। রোদে পুড়েছি, জলে ভিজেছি। শরীরে মরচে ধরেনি একফোঁটা। প্রতিদিন সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কত কিলোমিটার যে সাইকেল চালাই তার হিসেব রাখিনি। যদি গুনে রাখা যেত তবে দেখতেন সসাগরা পৃথিবীকে এক চক্কর লাগিয়ে ফেলেছি। (World Cycle Day)
সাইকেলওয়ালার থেকে সাইকেল কেড়ে নেওয়া যায়, কিনে নেওয়া যায়, এমনকি চুরি করে বেকায়দায় ফেলা যায়। তবে ব্যালেন্স কেড়ে নেওয়া যায় না। ঠিক সময়ে থেমে যাওয়ার শিক্ষাটুকু সরিয়ে ফেলা যায় না। আজকালের ছেলে মেয়েরা কী আর এত কিছু বোঝে? ওরা ভাবে সাইকেল হল গিয়ে প্যাডেল চাপা যন্ত্র। মোটর বাইক কিনে ফেললে সেই যন্ত্র তখন ওদের কাছে যন্ত্রনা। তাই বলছি, দুই চাকা গেঁথে গেছে শরীরের ভিতরে থাকা কুন্ডলিনীর সঙ্গে। এও এক ধরণের যোগ। সাইকেল যোগ।(World Cycle Day)
না ভাই হিতেন, তোমার ওই সাইকেলের ভার বইবার ক্ষমতা আমাদের নেই। তুমি ছাড়া ওই চাকা গড়িয়ে নেওয়ার ছাড়পত্র তিস্তা-করলা জুটি আমাদের দেবে না
কথা শেষ করে হিতেন সরকার হো হো করে হাসতে থাকে। আমরা দু’জন অপ্রতীভ মুখ নিয়ে ওকে দেখতে থাকি। এতদিন জানতাম, বাইসাইকেল পৃথিবীতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট তৈরী করে না। আজ জানলাম মনের গভীরে যে লুকনো উপত্যকা থাকে সেখানেও মানবিক দূষণের কালো গুঁড়ো জমতে দেয় না। নিঃসন্দেহে এ এক আশ্চর্য উত্তরণ। (World Cycle Day)
আজ যখন পুরো পৃথিবীতে ইলেকট্রিক সাইকেল বনাম প্যাডেল চাপা সাইকেলের ভয়ঙ্কর বিরোধ বেঁধেছে, সেই সময় এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাইকেল হকার জীবন দর্শনের সেরা বইটুকু নদীর পাশে দাঁড়িয়ে পড়িয়ে দিল। (World Cycle Day)

– না ভাই হিতেন, তোমার ওই সাইকেলের ভার বইবার ক্ষমতা আমাদের নেই। তুমি ছাড়া ওই চাকা গড়িয়ে নেওয়ার ছাড়পত্র তিস্তা-করলা জুটি আমাদের দেবে না।(World Cycle Day)
বিজয়দা বলেন।
হিতেন হাসি মুখ চওড়া করে বলে,
– ভেবে দেখেন একবার। জলের দরে সাইকেলের মালিক হতে যাচ্ছিলেন। হেলায় হারাবেন?
আমি ভাবছি, এমনতর হার মানাতে সুখের ভাগ বেশি। ওই ঘর্মাক্ত শরীরে যে স্বেদ বিন্দু জমেছে, চোখের কোনায় শ্বাশ্বত প্রাপ্তির আনন্দাশ্রু জমেছে তার দর বেঁধে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের মত শহুরে
ভবঘুরেদের নেই। আরও কিছু সাধারণ প্রশ্ন করা যেতেই পারত। কিন্তু এক অসাধারণ মুক্ত মানুষকে বিব্রত করা উচিত কাজ হবে বলে মনে করি না।
– একটি বারের জন্য সাইকেলটা ছুঁয়ে দেখতে পারি?
আমার প্রশ্নে প্রথম বারের জন্য উদ্ভাসিত চোখে হিতেন গম্ভীর মুখে বলে,
সাইকেল আমার পরশ পাথরে মোড়া। ছুঁয়ে দেখুন না হয়। মনের জগতে সোনার ঝিলিক দেখতে পারবেন
সাইকেল আমার পরশ পাথরে মোড়া। ছুঁয়ে দেখুন না হয়। মনের জগতে সোনার ঝিলিক দেখতে পারবেন। তবে এখন নয়। রাত নামলে। যখন তিস্তার চরে রাত পাখি ডাকাডাকি করে, তখন। লাভ-লোকসানের হিসেব করা জীবনের অনেক বাইরে অন্য এক পৃথিবী আছে। সেখানে শুধু রাত নামলে, একলা হলে, তিস্তার কথা ভাবলে যাওয়া যায়। ছুঁয়ে দেখুন। হিতেন সরকার মিথ্যা বলে না। (World Cycle Day)
নাহ্, হিতেন সরকার মিথ্যা বলেনি। আজ রাতে তিস্তার চরকে চোখে রেখে দেখতে পারছি, আকাশে সোনার রঙ লেগেছে এক ফালি। সোনালী রাজপথে হিতেন তার সাইকেলে চড়ে যাচ্ছে আকাশগঙ্গায় হরেক মাল বিশ টাকায় বিক্রি করবে বলে। (World Cycle Day)
ছবি: মৌসুমি দত্তরায়, boisoi.com, flickr.com
সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘুরে দেখছেন ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীব্যবস্থা, জানছেন ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া- পাঁচটি দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার একা ভ্রমণ করেছেন দু চাকায় সওয়ার হয়ে। এছাড়াও প্রায় দু দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম,অজানা পাহাড় ও জঙ্গল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের স্নাতক সম্রাটের শখ প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের ছবি তোলা। প্রথম প্রকাশিত বই 'দাগ'।