অর্থনৈতিক গবেষণা দেখায় নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষই পারতপক্ষে অনিশ্চয়তা পছন্দ করেন না। অর্থাৎ, প্রথম দু‘মাস কোনো টাকা না পেয়ে পরের দু‘মাসে হাজার টাকা করে পাওয়ার থেকে এঁরা হয়ত পছন্দ করবেন প্রতি মাসে চারশো টাকা পেতে। সামগ্রিক ক্ষতি মেনে নিতে এই মানুষগুলি রাজি, কিন্তু দৈনন্দিন অনিশ্চয়তা নয়। দৈনন্দিন অনিশ্চয়তা বেড়ে গেলে প্রথমেই ভেঙে পড়বে মানসিক স্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গতবছরেই জানিয়েছে ২০১২ থেকে ২০৩০ এর মধ্যে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভারতবর্ষের ক্ষতি হতে পারে এক ট্রিলিয়ন ডলারের-ও বেশি! এই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কথাও কিন্তু শেয়ার মার্কেটের উত্থানপতন বা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের তারতম্যের লেখচিত্রগুলি ধরতে পারে না। উন্নত যেসব দেশে অক্ষম, অপারগ মানুষদের জন্য সরকারি ভাতার বন্দোবস্ত আছে সেখানে আরো অনেক বেশি মানুষ ওই ন্যূনতম ভাতাতেই বেঁচে থাকতে চাইবেন। নিশ্চিত ন্যূনতম ভাতা অনিশ্চিত বেশি ইনকামের থেকে অধিক কাম্য, একাধিক অর্থনৈতিক গবেষণা তা দেখিয়েছে। এবং এর ফলে সংসারগ্রহণ, সন্তানধারণ, বা সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষাদান এরকম বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। বদলে যেতে পারে চেনা সামাজিক চালচিত্র।
[the_ad id=”270088″]
নীতিনির্ধারণের প্রশ্নে যাওয়ার আগে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায়শই উপেক্ষিত প্রশ্ন নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানো উচিত্। প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষগুলির কথা কি সরকার আদৌ ভাবেন? মানুষগুলির অর্থনৈতিক মূল্য (ব্যবসায়িক নয়) ঠিক কী? সরকারের কাছে এঁদের একমাত্র পরিচয় যদি সুলভ শ্রমজীবী হয় তাহলে এই নৈরাশ্য থেকে বেরোনোর সত্যিই কোনো পথ নেই। বিশেষত ভারতের মতন জনবহুল দেশে। তাই রুগ্ন, অশিক্ষিত, নির্জীব শ্রমশক্তিই আমাদের ভবিষ্যৎ। যে করুণ ছবি লকডাউনের সময়ে বারবার টিভির পর্দায় বা কাগজের প্রথম পাতায় ভেসে এসেছে, সেই একই ছবি আরো বহু বছর ধরে ভেসে আসবে। যত দিন যাবে, মানুষ বিশেষত তরুণ-তরুণীরা, ন্যূনতম পারিশ্রমিকে সবথেকে ঝুঁকিবহুল, পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে চাইবেন স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য। এই মুহূর্তে আড়াই থেকে তিন কোটি ভারতীয়, যাঁদের বয়স কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে, কোনোরকম চাকরি না পেয়ে বসে আছেন। তরুণ শ্রমশক্তির এই দুর্দশা একাধিক ভাবনা নিয়ে আসে। মনে করিয়ে দেয় যে তারুণ্যের ওপর নির্ভর করে আমরা উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম তার অপমৃত্যু ঘটেছে। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড‘* ঘরে তুলতে আমরা মোটের ওপর ব্যর্থ। এবং এই ব্যর্থতার একটা বড় কারণ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যথেষ্ট শিক্ষা, যথেষ্ট কর্মদক্ষতা আমরা দিতে পারিনি। ন্যূনতম শিক্ষা, ন্যূনতম কর্মদক্ষতার ফলে একটা অর্থনৈতিক ধাক্কাই তাদের জীবন এবং ভারতীয় অর্থনীতিকে বেসামাল করে তুলেছে।

সরকারের সামান্য শুভচেতনা থাকলেও এই শিক্ষা এবং কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটা সার্বিক প্রচেষ্টা দরকার। কোভিড-১৯ নামক অতিমারী কতদিন চলবে সে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, এ কথা মাথায় ঢুকিয়ে নেওয়া ভাল, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক উষ্ণায়ণ ইত্যাদির দরুণ আরো অতিমারী, আরো অর্থনৈতিক ধাক্কা অবশ্যম্ভাবী। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না নিয়ে শুধু কোভিড নিয়ে মাথা ঘামালে আখেরে কোনো লাভই নেই। আর এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সম্পদ পুনর্বণ্টন ছাড়া কার্যকরী করা সম্ভব নয়। এমন এক অসাম্যের পৃথিবীতে আমরা বাস করি যেখানে বিশ্বের প্রথম পঁচিশ জন ধনী ব্যক্তির হাতে রয়ে যায় প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। তাঁরা যত চাকরি সমাজের জন্য তৈরি করেছেন তা কোনোমতেই এই অবিশ্বাস্য এবং অশ্লীল পুঁজিকে যুক্তিযুক্ত করতে পারে না। এই অসীম সম্পত্তির এক-দুই শতাংশও যদি প্রান্তিক বা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর হাতে আসে তা দিয়ে শিক্ষা এবং কর্মদক্ষতা বাড়ানোর কাজে অসাধ্যসাধন করা যেতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদির প্রেক্ষিতে যে গভীর অসাম্য একবিংশ শতকে তৈরি হয়েছে তা আর্থিক অসাম্যের থেকেও বড় হয়ে দাঁড়াবে অদূর ভবিষ্যতে এবং সেখান থেকে বাঁচবার জন্যও সম্পদ পুনর্বণ্টন একমাত্র পথ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ধাঁচে পুনর্বণ্টনের কথা বলছি না, উদার গণতন্ত্রেও যথাযথ করের মাধ্যমে কাজটি করাই যায়। আজ থেকে দশ বছর আগেও এ কথা বললে অলীক প্রলাপ মনে হত কিন্তু পুঁজিবাদের পীঠস্থান আমেরিকাতেই নতুন রাষ্ট্রপতি জোসেফ বাইডেন জানাচ্ছেন তিনি ক্ষমতায় এসেই অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুক জাতীয় কোম্পানিগুলিকে পঁচিশ শতাংশেরও বেশি কর দিতে বাধ্য করবেন। এবং শুধু আমেরিকা নয়, চিন, ভারত, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে করবৃদ্ধির প্রস্তাব আসছে। এখন দেখার পালা এই বর্ধিত কর প্রান্তিক মানুষদের হাতে কিছু তুলে দেয় নাকি পুঁজিবাদীদের বদলে পকেট ভারী করে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারদের।
[the_ad id=”270086″]
হয়ত আশাবাদী হওয়া যায়। যেকোনো অতিমারীর পরপরই ধাক্কা সামলানোর জন্য যা করা দরকার তা প্রায় সব সরকার করেছেন, কেউ কম, কেউ বেশি। সরকারি খরচ বাড়ানো, সরকারি ভর্তুকি বাড়ানো। কিন্তু এভাবে কিছু মাস বা বড় জোর একটা বছর অবধি লড়া যায়, তার বেশি নয়। ব্রিটেনে যেমন জাতীয় ধার এত বেড়ে গেছে যে সে ধারের পরিমাণ জাতীয় সম্পদের থেকে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এহেন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমেরিকান সরকার প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও আর সামাল দিতে পারছেন না, প্রায় সব বিশেষজ্ঞই জানাচ্ছেন দরকার আরো টাকার। পৃথিবী জুড়ে সুদের হার তলানিতে ঠেকেছে বলেই বিভিন্ন দেশ বাজার থেকে এতটা টাকা তুলতে পেরেছে, নাহলে সরকারি টাকার যোগানেও সমস্যা দেখা দিত। কিন্তু সমস্যা তো এখানেই শেষ নয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক — গোটা ইউরোপেই এখন মোটের ওপর অত্যুচ্চ জাতীয় ধার, সঙ্গে স্বল্প অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সরকারের কপালে ভাঁজ ফেলে প্রৌঢ় জনসংখ্যা প্রবল ভাবে বাড়ছে। এশিয়ায় প্রায় একই সমস্যায় ভুগছে আর এক বড় দেশ জাপান। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতনই অবস্থা। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে দরকার পারস্পরিক সহযোগিতা। অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে যে সহযোগিতার মর্মার্থ আরো বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ানো বা দেশসীমানার গণ্ডী পেরিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির বিনিময় চালু রাখা। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদায় নিলেও যে রক্ষণশীল রাজনীতি শেষ সাত আট বছর ধরে ঝড় তুলেছে বিশ্বজুড়ে তাতে এহেন অর্থনৈতিক সহযোগিতা কতটা সম্ভব সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন চিনের সঙ্গে ঠিক কতটা সহযোগিতা করবেন, ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন এবং অবশিষ্ট ইউরোপ বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রশক্তি হবে না ঘোরতর অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, চিন-ভারতের বিবাদ চলতেই থাকলে জাপান বা অস্ট্রেলিয়া ভারতের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যচুক্তি ঘোষণা করবে কিনা এরকম বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের ওপর নির্ভর করছে আগামী কয়েক বছরের বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি। প্রশ্নগুলোর উত্তর সদর্থক হলে ধরে নেওয়া যায় কিছু সুফল অবশ্যই আসবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না মৌলিক সমস্যাগুলির উত্তর অন্যত্র। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মাত্র, প্রলেপ দিতে পারে, ক্ষণিকের জন্য ব্যথা কমাতে পারে কিন্তু তার সাধ্য কী ক্যান্সারের পচনকে থামায়।
*ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড – ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ডের ব্য়াখ্য়া অনুযায়ী, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবনার এমন একটি পর্যায় যখন কর্মক্ষম নাগরিকের সংখ্য়া– অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্ত জনসংখ্য়ার সমষ্টির চেয়ে বেশি।
কোন পথে কোভিডোত্তর বিশ্ব-অর্থনীতি : পর্ব ১
প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক। অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন সংবাপত্রে অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবীরেন্দ্র। এছাড়াও লিখেছেন একাধিক কল্পবিজ্ঞান ও রহস্যকাহিনী। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি হল 'বাইট বিলাস', 'ক্যুইজ্ঝটিকা', 'পরিচয়ের আড্ডায়', 'আবার ফেলুদা, আবার ব্যোমকেশ', এবং 'চার'।