(World Tea Day)
ধূমায়িত এক কাপ চা, সঙ্গে দুটি থিন অ্যারারুট বিস্কুট– এই পরিচিত ছবি আমাদের অনেকেরই সকালবেলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সারা পৃথিবীতে অ্যালকোহল বর্জিত পানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়তার প্রথম স্থানে জল, আর তার পরেই চা। চা-গাছ বা ক্যামেলিয়া সিনেনসিস একধরণের চিরসবুজ গুল্ম যার পাতা জারণ করে তৈরি হয় চা। শুধু পানীয় নয়, সারা বিশ্বে চা আতিথেয়তার অন্যতম প্রতীক। প্রাচীন কিংবদন্তি থেকে রাজনৈতিক বিপ্লব– নানা দেশের চায়ের কাপে ছড়িয়ে আছে গল্প। (World Tea Day)
একটু উষ্ণতার জন্য: অরিজিৎ মৈত্র
পানীয় রূপে চায়ের জন্ম চীনদেশে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। কথিত আছে যে চীনের সম্রাট শেনং একদিন জল ফোটাচ্ছিলেন; এমন সময় কিছু চা পাতা “উড়ে এসে” সেই পাত্রে পড়ে। সেই গরম পানীয়টি সম্রাটের ক্লান্তি দূর করে এবং তার ভেষজগুণ আবিষ্কার করে তিনি চমৎকৃত হয়ে যান। চীনে চা পানের রীতি ছড়িয়ে পড়ে ও সারা বিশ্বে তারা একচেটিয়া ব্যবসা করতে শুরু করে। (World Tea Day)

চীনের প্রতিবেশী জাপানে চা পান এক সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে, জাপানি সামুরাই তোয়োতোমি হিদেওশির অধীনে কাজ করতেন এক চা-বিশেষজ্ঞ, নাম তার সেন নো রিকিউ। সন্দেহপ্রবণ হিদেওশি কোনও কারণে রিকিউর আনুগত্যের চরম পরীক্ষা নেবেন ঠিক করলেন– তাঁকে আদেশ দিলেন সেপ্পুকু (আনুষ্ঠানিক আত্মহত্যা) করতে। প্রভুর আদেশ পালন করার পূর্বে রিকিউ তাঁর অনুরাগীদের নিয়ে শেষবারের মতো চা অনুষ্ঠান করেন। তোয়োতোমি যখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, রিকিউ ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন। রিকিউর সমাধি আছে কিয়োটোর জুকো-ইন মন্দির চত্বরে। সেখানে চা অনুরাগীরা অনুষ্ঠানের সব নিয়ম মেনে চা তৈরি করে তাঁকে উৎসর্গ করেন।
সতেরশো শতাব্দীতে স্থলপথে উটের পিঠে সাইবেরিয়া পেরিয়ে চা পাড়ি দিত চীন থেকে এগারো হাজার কিলোমিটার দূরে রাশিয়ায়। ষোল মাস পেরিয়ে যেত পথে। Great Tea Road নামে বিখ্যাত এই পথ জন্ম দিল একটি নতুন স্বাদের চায়ের, নাম তার রাশিয়ান ক্যারাভান চা। প্রতি রাতে ক্যারাভানের ক্যাম্পে আগুন জ্বালিয়ে রান্না হত, সেই ধোঁয়া শুষে নিত চায়ের পেটিগুলো, এক নতুন স্বাদ গন্ধ আরোপিত হত এই চায়ে। আবিষ্কার হল সামোভার, যাতে একসঙ্গে অনেক চা তৈরি করা যায় এবং বারবার পান করা যায়। এই রাশিয়ান ক্যারাভান চা টলস্টয় ও দস্তয়েভস্কির খুব প্রিয় ছিল। (World Tea Day)

এরপর ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের জাহাজে চড়ে সাগরপাড়ি দিল চা। ইউরোপের বড় বড় শহরের কফির দোকানে ভেষজগুণ সম্পন্ন অত্যাধুনিক পানীয় রূপে তাকে দেখা গেল। অন্যদিকে ভারতে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে প্রচলিত ছিল আখের রস থেকে চিনি তৈরি করার পদ্ধতি। পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদীরা আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা দাসদের দিয়ে আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানে শুরু করল আখের চাষ। ঘরে ঘরে জনপ্রিয় এই ঈষৎ তিক্ত চায়ে মিশে গেল দু’চামচ চিনি। পরে তাতে দুধ মেশানো শুরু হয়। (World Tea Day)

ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যত আধিপত্য বিস্তার করে তত তাদের চা ব্যবসা রমরমিয়ে চলতে থাকে। চীন থেকে আমদানি দ্রব্যের তালিকায় প্রথম ছিল চা পাতা। কিন্তু পরিবর্তে চীনকে তারা বিশেষ কিছু বেচতে পারত না যা চীনদেশের লোক চায়। অন্যদিকে আমেরিকার কলোনির লোকজন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে ক্রমে ক্রমে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হুকুম জারি করল বিনা শুল্কে আমেরিকায় তারা চা আমদানি করবে। বিদ্রোহী আমেরিকানরা রেড ইন্ডিয়ান সেজে বস্টন বন্দরে ব্রিটিশ জাহাজ ডার্টমাউথ থেকে ৩৪২টি চায়ের পেটি জলে ফেলে দিয়েছিল। প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠা চায়ের এই পর্বকে বস্টন টি পার্টি আখ্যা দেওয়া হয়। (World Tea Day)
১৭৮৪তে ব্রিটেনে চায়ের আমদানি-শুল্ক এক ধাক্কায় ১১৯% থেকে ১২.৫% এ নামিয়ে দেওয়া হয়। ফলে অভিজাতদের বসার ঘর থেকে সব শ্রেণীর মানুষের ঘরে চা পৌঁছে যায়। ব্রিটেনের মানুষের চা পানের সংস্কৃতিতে এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
একদিকে কলোনিগুলোতে বিদ্রোহ, অন্যদিকে দেশের লোকের চা-প্রীতির ঠেলায় দেশে তৈরি হওয়া আর্থিক সমস্যা। এমন সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবিষ্কার করল একটি দ্রব্য যা চীনের লোকজন চায়– আফিম। বাংলার উর্বর ভূমিতে শুরু হল আফিম চাষ ও তা রপ্তানি হতে লাগল চীনে। চীন যখন আফিমের বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করল, তখন কোম্পানির লোক ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে নিলামে বেচে দিত, আর চোরাইপথে তারা আফিম চালান দিত চীনে। চীনের সম্রাট আপত্তি জানালেন যে দেশজুড়ে লোকজন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, এবং ১৮৩৯ সালে তিনি কুড়ি হাজার পেটি আফিম বাজেয়াপ্ত করলেন। তখন ব্রিটিশরা যুদ্ধে নেমে পড়ল। তাদের আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে তারা সহজেই জিতল এবং চীনকে বাধ্য করল অত্যন্ত অপমানজনক শর্তাবলী মেনে আপোষ করতে। (World Tea Day)
হংকং চলে গেল ইংরেজদের দখলে এবং চীনের সব বন্দর ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের খুলে দিতে বাধ্য করা হল। এইভাবে চা এবং আফিমের বাণিজ্যের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। চীনকে আফিমের নেশায় বুঁদ রেখে বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ড্রাগ ডিলার হয়ে উঠেছিল। (World Tea Day)

চায়ের বাজারে কোনও যোগানের সমস্যা যাতে দেখা না দেয় সেইজন্য আগে থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৩০ সালে ভারতের আসামে ও দার্জিলিঙে এবং পরে কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য উপনিবেশগুলিতে চা চাষ শুরু করেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা। চীনের একচেটিয়া ব্যবসা ক্ষুণ্ন করতে ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ রবার্ট ফরচুন ব্যবসায়ী সেজে চোরাইপথে চা গাছের চারা নিয়ে এলেন চীন থেকে ভারতে। পার্বত্য অঞ্চলে উচ্চ জমিতে উপযুক্ত জল-হাওয়া-রোদ পেয়ে সবুজ গালিচার মতো চা বাগান তৈরি হল। (World Tea Day)
এদিকে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে চা বাগানের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম কে করবে? দাসদের বদলে নতুন এক শ্রেণীর শ্রমিক চা বাগানে কাজ করতে শুরু করল– চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। সাধারণ মানুষ, যারা দাস নয়, তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যেত; তাদের অবস্থা দাসদের থেকে খুব একটা উন্নত ছিল না।
ভারতীয় চায়ের সুনাম খুব শীঘ্রই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ভারতীয় চা পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বসল। WTO জমানায় দার্জিলিঙের চা ভারতের প্রথম Geographical Indication Tag এবং Logo পেল, যা দেখে ক্রেতা নিশ্চিত হবে এই চা দার্জিলিঙের চা বাগান থেকেই এসেছে। এখন অবশ্য চায়ের বিশ্ববাজারে চীন, শ্রীলঙ্কা এবং কেনিয়া ভারতকে পেরিয়ে গেছে রপ্তানি ক্ষেত্রে। (World Tea Day)

নানা দেশে নানাভাবে চা পান করা হয়। উত্তর আফ্রিকার মরোক্কোতে পুদিনা-চা দিয়ে অতিথিকে স্বাগত জানানো হয়, পেট ভরা থাকলেও তা প্রত্যাখ্যান করা ঘোর অসভ্যতা। দুধ-চিনি-আদা-ছোট এলাচ দিয়ে ফোটানো চা তৈরি হয় বেনারসের রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে। তিব্বতের হাড় হিম ঠান্ডায় দিনে বিশ-তিরিশ কাপ চা পান করেন মনাস্টরির বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। কালো চায়ে নুন আর চমরী গাইয়ের দুধ থেকে তৈরি মাখন মিশিয়ে এই জীবনদায়িনী পানীয় তৈরি করা হয়। (World Tea Day)
১৯০৪ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইতে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাজারে চায়ের দোকান খুলে বসেছিলেন চা-বিক্রেতা রিচার্ড ব্লেকাইনডেন। গরমে কেউ চা খাচ্ছে না দেখে তাঁর তো মাথায় হাত। গ্লাসে বরফ দিয়ে তার ওপর চা ঢেলে দিলেন, খদ্দেরদের পরিবেশন করলেন সেই চা। যুক্তরাষ্ট্রের Iced Tea এর জয়জয়কার শুরু হল। (World Tea Day)

তুরস্কের প্রিয় পানীয় ছিল কফি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কফির যোগানে ভাঁটা পড়ল। দেশনেতা আতাতুর্ক ঘোষণা করলেন কালো চা তাদের জাতীয় পানীয়। তারপর থেকে তুরস্কের মানুষ চায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আধুনিক পৃথিবীতে সর্বাধিক চা-পান করে তুর্কিরা– বছরে মাথাপিছু গড়ে সাড়ে তিন কিলোগ্রাম। (World Tea Day)
বিশ্বের ইতিহাসকে চা নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। চোরাকারবার, বিদ্রোহ, সামাজিক অনুষ্ঠান, আতিথেয়তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতি, সর্বত্রই চায়ের উপস্থিতি। চায়ের কাপে তুফান কথাটি তার্কিক মহলে চায়ের উপস্থিতি ঘোষণা করে।
২০০৫ সালে দিল্লিতে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব চা দিবস। তারপর থেকে প্রতি বছর ২১শে মে বিশ্ব চা দিবস পালিত হয়। আসুন আমরা সকলে এই অসাধারণ পানীয়টি কে আজ অভিবাদন জানাই। (World Tea Day)
কৃতজ্ঞতা:
https://www.bbc.com/news/world-asia-india-36781368
Wikipedia
ছবি সৌজন্য- লেখক
বিশাখা ঘোষ পেশাগত বাঁধনে বাঁধা অর্থনীতির সঙ্গে। কিন্তু মন চায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, আর অজানা পৃথিবীকে চিনতে। তাতে নিজেকেও তো চেনা হয়। আপনাকে জানাতে তাঁর ভারী কৌতূহল। ছাত্রাবস্থা কেটেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাস আর আইএসআই-তে। এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্য়ালয়ে অধ্যাপনা করেন। ভালোবাসেন আড্ডা মারতে।
2 Responses
অসামান্য লেখনী।
অসামান্য লেখনী