বর্ষার দিনে পুকুরের ওপারে মেঘের ছায়া যখন ঘনিয়ে আসত, সে ছায়া লুটিয়ে পড়ত আমাদের উঠোনেও। সেই আলোছায়ায় বসে বসে আমার ঠাকুমা ভাত খেতেন একলাটি। আলোচালের ভাত, পটল সেদ্ধ, তিতার ডাল, বেগুন ভাজা– এই সব মিলিয়ে নিরিমিষ হেঁশেলের গন্ধে আমাদের তখন মৌতাত লাগত। গরম ভাতে মরিচ ডলে ডলে পটল সেদ্ধ মেখে নিচ্ছে অশীতিপর হাত, দলা মেখে তুলে দিচ্ছে নাতি-নাতনিদের গালে– ছবিখান এখনও মনের মধ্যে অম্লান। দিদুর পাত থেকে দলা খাওয়ার লোভ আমাদের তাই ফুরত না। মনে হতো দিদুর মতো করে কেউ বুঝি সেদ্ধ মাখতে পারে না। হাতের উত্তাপে কি মায়া থাকে? হবেও বা। অথচ মেয়েলি হাতের উত্তাপ কত না সুখাদ্যের উত্তাপ শুষে নিতে পারে সেকথা কি ভেবেছি কোনওদিন! উকি চিদুই’য়ের (Yuki Chidui অথবা Yuki Chizui) গল্প আমায় তাই অবাক করেছে। রান্নার বিশ্বে বিস্ময় কি কম! সুশি’র রান্নাঘর ছিল পুরুষের। তাই না জাপানের তাবড় তাবড় সুশি রাঁধুনিদের দলে মেয়েরা ছিল ব্রাত্য। ঐতিহ্যগত ভাবে সুশি’র নির্মাণে মেয়েদের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল কত শতক আর দশক পেরিয়ে। পুরুষের তুলনায় মেয়েদের হাতের উত্তাপ বেশি, সুশি নির্মাণের মুন্সিয়ানায় মেয়েদের হাতে তাই তেমন করে স্বাদ খোলে না। এই ছিল তাদের বক্তব্য। এই রক্ষণশীলতার ওপারে দাঁড়িয়ে উকি চিদুই পৃথিবীর প্রথম মহিলা সুশি শ্যেফ। রান্না তো কেবল আবেগ দিয়ে হয় না, রান্নায় মিশে থাকে বিজ্ঞানের নিপুণতা। উকি সেই দরজার চাবিখানা খুলতে পেরেছে। টোকিও থেকে কিছু দূরে, Nadeshiko Sushi অথবা Nadeshiko Sushi– সেই যে রেস্তোরাঁয় উকি কাজ করে। কাজ শেখায়। উকির সুশি প্লেটগুলোর দিকে যখন চাই তখন দেখি, কী আশ্চর্য স্বপ্ন দিয়ে বোনা ওর রান্নাঘরখানা। ওর হাতখানিও বুঝি। তাই না ওর হাতে এমন করে সেজে ওঠে সুশির থালা! মনে হয় কোন সে কুরুশে বোনা উপকথা যেন।
এই পৃথিবীতে কেবল সুশি কেন, কত কিছুই তো মেয়েদের জন্য বারণ ছিল! চিত্রা দেব লিখেছিলেন মহিলা ডাক্তারদের যাত্রাপথের গল্প। উকির কথা পড়তে গিয়ে আমার কেবল মনে পড়ছিল সেই বইখানির কথা– ‘মহিলা ডাক্তার ভিনগ্রহের প্রাণী’। মনে পড়েছে কত না পেশার পুরুষালি আগ্রাসনের ছবি। সেসব আগ্রাসনের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে মৃদুভাষী উকি। উকির রান্নাঘর মেয়েদের উত্তাপ আর উষ্ণতায় বোনা। উকি সেখানে সুশি বানায়, বানাতে শেখায়। ভাবে, কেমন করে আরও নতুন কোনও পদ্ধতির উদ্ভাবন সম্ভব। কত লোক আসে ওঁকে জরিপ করতে। রবীন্দ্রনাথ ‘স্ত্রী’র পত্র’ গল্পে দেখিয়েছিলেন পুরুষের জরিপ কেমন হয়! একুশ শতকের উকি মেল গেজ-কে কেমন করে দেখে? উকি তো আসলে ঠিক রাঁধুনি নয়, ও শিল্পী। আর্ট স্কুলে পড়েছিল উকি। গ্রাফিক ডিজাইন আর বিবিধ ছবির মন্তাজে মোড়া ওর মগজখানা। Nadeshico Sushi’তে কাজে যোগ দেওয়ার আগে অন্য একটি রেস্তোরাঁয় কিছুদিন কাজ করেছিল ও। দেখেছিল লিঙ্গ রাজনীতির নানা অন্ধিসন্ধি। মেনুর অর্ডার নেওয়া, পানীয় দেওয়া, ক্যাশ বাক্স সামলানো এইটুকুই ছিল ওর কাজ। ভাত অথবা সামুদ্রিক মাছের স্পর্শ ওর জন্য ছিল নিষিদ্ধ। কেবল তো ও নয়, মেয়েদের জন্যেই বারণ ছিল ওসব। উকি এসব ভোলেনি, ভোলা তো সহজ নয়! Nadeshico Sushi’তে ও যোগ দিয়েছিল ম্যানেজার পদে। ক্রমে ক্রমে সুশির দুনিয়ায় ওর আবির্ভাব। কত মানুষ যে কত কথা বলেছে! কেউ বলেছে, মেয়েদের হাত গরম, কেউ বলেছে ঋতুস্রাবের দিনে ওসব সূক্ষ্ম রান্না ছুঁলে তাতে স্বাদ-গন্ধের হেরফের হয়। উকি এসব শুনে দুঃখ পেয়েছে নিশ্চয়ই কিন্তু ভেঙে পড়েনি। বরং ও বলেছে – “সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাকে নিয়ে কত সমালোচনা হয়েচে, আমি নাকি অবুঝ। নানাভাবে হেনস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলো পেরিয়ে এসেছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, যেসব মগিলা সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে লড়ে যাচ্ছে, আমি তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারি। আমি যদি চাপের মুখে পড়ে সরে আসতাম, লোকে বলতে সুশি শ্যেফ হতে চাওয়া আমার ঠিক হয়নি। আমি সারা পৃথিবীর মহিলাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইনি।” (“I was criticised on social media for being unreasonable. I was even the victim of a serious stalker. But I overcame it. I did it because I believe that I am a unique example for women who are fighting in society. If I gave up, people would say: ‘I knew it wasn’t right for a woman to be a sushi chef.’ I don’t want to betray the support of women all over the world.”)

উকি এই লড়াইয়ে যাকে সবচেয়ে বেশি করে পাশে পেয়েছে সে ওর মা। তিনি নিজেও একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং রাধুনি। আমাদের দেশ গায়ে প্রতিদিন তো দেখছি, কত না মেয়ে-প্রতিভা ঝরে যাচ্ছে, নিভে যাচ্ছে। কত কত মায়েরা সেসব টেরও পাচ্ছেন না। তারা ভাবছেন বা তারা ভাবেন, তাদের সন্তান কেবল মেয়ে হয়েই জন্মেছে। মেয়ে হয়েই তাদের মরে যেতে হবে একদিন। সেসব মায়েদের যদি উকি’র গল্প শোনানো যেত! এই প্রতিদিনের সংসারে এক চিলতে রান্নাঘরেই রাজনীতি কি কম! অথচ এই বৃহৎ সংসারে একা একটা মেয়ে কেবল তার ভাবনা গুলো নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য এবং কী অপূর্ব!
উকির এই লড়াইটাকে তাই ছোট করে দেখলে অন্যায় হবে। বিশ্বের রান্নাঘর বার বার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়, ও মেয়ে। ও এসব পারে না। কিন্তু উকি এখন একা নয়, জাপানের সুশি-দুনিয়ায় নারী বিপ্লবের গান ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন। বিপ্লব আসলে অনেক রকম। দূর থেকে তার সবটা বোঝা যায় না। যেটুকু বোঝা যায় তার প্রান্তে বসে বসে বরং চলুন, উকিকেই দেখি আরেকটু। ও বলে, ওর কাছে সুশি একটা আর্ট। গ্রাফিক ডিজাইনার উকির হাতে সুশি তাই সেজে ওঠে প্রতিদিন। মাছের রঙ, তার গড়ন এই সব মিলিয়ে একেকটা থালা ওর কাছে হয়ে ওঠে শিল্পীর ক্যানভাস। উকির কাজ মানুষের স্নেহ আর ভালোবাসার উত্তাপে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন। ও তো কেবল মেয়ে হতে চায়নি, মানুষ হতে চেয়েছিল। সূর্যোদয়ের দেশে না হয় ভোরগুলো অন্যরকম হোক। উকি বলেছে, ওর জন্য প্রতিরোধ নানা দিকে। মাছ বাজার থেকে শুরু হয় সে লড়াই। এ লড়াই তো আসলে থামবার নয়। তাও ২০১০’য় আমরা একজন মেয়েকে পেয়েছি, আমরা উকি’কে পেয়েছি যে সুশির রাজ্যে বদল ঘটিয়েছে। এই বদলগুলো ঘটুক। ছোটবড় আরও অনেক অনেক স্তরে। Thank you Yuki Chidui. তোমার জন্য অফুরান ভালবাসা আর শুভকামনা।
ছবি সৌজন্য: উকি চিদুই-এর ফেসবুক
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।