পাঁচ বছর বয়স থেকে গানের সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়া। ধ্রুপদী মার্গসঙ্গীত থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অলিগলি ছুঁয়ে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গলে এসে পৌঁছে বাঙালি মধ্যবিত্ত কন্যের চিরকেলে স্টিরিওটাইপের মুখে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন তিনি।
অল্পবয়সী মেয়ে রেডিওতে কথা বলবে? বিজ্ঞাপনের গান গাইবে, যাকে বলে জিঙ্গল? এই শব্দটার সঙ্গেই পরিচিত ছিল না বাঙালি সমাজ। ফলে যে মেয়ে সব প্রথা ভেঙে, ভারী গলা নিয়ে, শাড়ি পরে, হাতে মাইক্রোফোনটি ধরে গান গাইতে গাইতে, কথা বলতে বলতে অনায়াসে ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন উচ্চ থেকে নিম্নবিত্তের শোবার ঘরে, তাকে কোনও একটি অভিধায় বেঁধে ফেলতে কম চেষ্টা করেনি তৎকালীন বঙ্গসমাজ। কিন্তু পারেনি। নিজের নামকে পৃথিবীর কাছে ধন্য করে ‘স্বনামধন্যা’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এককালের রেডিও আইকন, জিঙ্গল গার্ল শ্রাবন্তী মজুমদার।
ছকভাঙা, স্বতন্ত্র, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল সেই শ্রাবন্তীদিকে আমরা পেয়েছিলাম বাংলালাইভ আয়োজিত নারীদিবসের জ়ুম আড্ডায়। সঙ্গে ছিলেন বাংলালাইভের প্রধান সম্পাদক, নিউ ইয়র্ক নিবাসী মৌসুমী দত্তরায়, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস-এর অ্যাডমিন বিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিক শর্মিলা দত্ত চৌধুরী, চিকিৎসক-সাহিত্যিক দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত এবং বাংলালাইভের সম্পাদকীয় দফতরের কর্মীরা।
শ্রাবন্তী মজুমদার এখন থাকেন সুদূর ইউ.কে-তে… ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে ‘আইল অফ ম্যান নামক’ একটি দ্বীপে। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছেও যেন তিনি সেই সতেরোর কিশোরী বা সাতাশের তরুণীটি, যাঁর মুখে খই ফোটে অবিরল, গলায় আচমকা খেলে যায় সুর, চোখে ঝিকিয়ে ওঠে দুষ্টু হাসিটি। হাসতে হাসতে বলে দেন, ‘একদিন প্রস্তাব এল জিঙ্গল গাইবার। জিঙ্গল কথাটার মানেই তো জানতাম না আমি। শুনলাম বিজ্ঞাপনের গান। নতুন রকম চ্যালেঞ্জ নিতে বরাবরই আমার উৎসাহ। তাই এককথায় রাজি। বাড়িতে বললে তো কিছুতেই যেতে দেবে না। তাই কাউকে না বলে লুকিয়ে চলে গেলাম রেকর্ডিংয়ে। সেই শুরু বিজ্ঞাপনের যাত্রা।’ এবং সাফল্যের জয়যাত্রাও বটে!

ওয়েসিস হেয়ার ভাইটালাইজ়ারের সেই বিখ্যাত গান, ‘মাথার কালো চুল যখন মরুভূমি হয়ে যায়’ কিংবা ‘স্যালিকল স্যালিকল স্যালিকল মলম’… শ্রাবন্তীদির মাদকতাময় ভরাট গলায় সেসব গান ঢুকে পড়ল বাঙালির রোজকার জীবনে। এমনকী আজও তাদের আবেদন এতটুকু ম্লান হয়নি। তবে সব্বাইকে ছাপিয়ে শ্রাবন্তী মজুমদারকে বিশ্বজনীন বাঙালির কাছে পরিচিত করে তুলল একটি নাম – বোরোলিন। অদ্ভুত রহস্যময় গলায় খেলে যাওয়া কিছু কোমল স্বর আর স্পষ্ট উচ্চারণে ‘সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন’ … চিরকালের জন্য তাঁকে আইকনের আসনে বসিয়ে দিল। সঙ্গে আসতে থাকল বিবিধ ভারতীতে তাঁর নানাস্বাদের অনুষ্ঠান এবং রকমারি পুজোর গান।
আজও সেসব দিনের কথা মনে করতে গিয়ে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শ্রাবন্তীদির। হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমার তো তখন নাম ছিল পানের দোকান। কারণ পানের দোকান ছাড়া আর কোথাও নাকি বিবিধ ভারতী বাজত না। আমি কোনওদিনই ওসবের তোয়াক্কা করিনি। চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম পানের দোকানকে একদিন বাঙালির শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দেখাব। সেটাই ঘটল।’
পুজোর গানেও সঙ্গী কে? কখনও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘আয় খুকু আয়’, কখনও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘তুমি আমার মা’… সঙ্গীতজগতের দিকপালদের সঙ্গে তখন নিত্য যোগাযোগ। তবু তার মধ্যেও কখনও কাউকে অনুকরণ করার পথে হাঁটেননি তিনি। বরাবর নিজের অন্যরকম কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গান বেছেছেন, সুর তুলেছেন।
সমসাময়িক কোনও গায়িকার সঙ্গে তাঁর একটি গানেরও তুলনা করা যায় না, এতটাই ভিন্ন আঙ্গিকে, পৃথক তারে নিজের শিল্পবোধকে বেঁধে রেখেছিলেন শ্রাবন্তীদি। ‘মধুপুরে পাশের বাড়িতে তুমি থাকতে’ কিংবা ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ – সুর, কথা, যন্ত্রানুষঙ্গ, গাওয়ার ধরন… সবদিক থেকে যেন এক স্বকীয় স্টেটমেন্ট, যা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয় শ্রাবন্তী মজুমদারের আসন সমকালীন শিল্পীদের থেকে একটু তফাতে, একটু একটেরে।
তার পাশাপাশি তো আছেই ম্যাডোনার ‘পাপা ডোন্ট প্রিচ’ থেকে করা বাংলা গান ‘বাবা বোকো না’ কিংবা পিটার সেলারের অবিস্মরণীয় প্রেমের গান ‘বুমপুডি বুমপুডি’ থেকে করা বাংলা ‘ও ডাক্তার ভীষণ মুশকিল’, যার দোসর সে যুগে কেন, এ যুগেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
‘আমাকে তো লোকে বরাবর বলে আমি নাকি মেমসাহেব’… কেন, সে কথা জিজ্ঞাসা করবার দরকার পড়ে না। কারণ, যে মহিলা অনায়াসে বড়ে গুলাম আলি কিংবা হীরাবাঈ বরোদেকরের গাওয়া বন্দিশ থেকে জ্যাজ়-ব্লুজ়-কান্ট্রি-পপ-এর দুনিয়ায় স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারেন, হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে স্টেজে অনর্গল বলে যেতে পারেন চোস্ত ইংরেজি আর বিশুদ্ধ বাংলা, সাজে-গোজে-স্মার্টনেসে যাঁর পাশে বসানোর মতো একজন বাঙালিনীকেও পাওয়া যায় না সমকালে, তাকে ‘মেমসাহেব’ বলে দেগে না-দিয়ে আর কীই বা করা যেত? সে যতই তিনি শাড়ি পরুন আর বাংলা গান করুন না কেন… তিনি মেমসাহেব।

আজও, এত দীর্ঘ প্রবাসজীবন কাটানোর পরেও সেই ‘মেমসাহেব’ শ্রাবন্তীদি একটিও বিদেশি শব্দের প্রয়োগ না করে গড়গড় করে বাংলা বলে যান, বর্তমান এফএম প্রজন্মের দোআঁশলা বাংলা নিয়ে অকপটে নাক সিঁটকোন, আর বয়স নিয়ে কথা বললে একমুহূর্ত না ভেবে বলে ওঠেন, ‘এই আমাকে মাসিমা পিসিমা ঠাকুমা বোলও না প্লিজ়, আমি সবসময় তোমাদের দিদিভাই থাকতে চাই।’
শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে নারীদিবসের আড্ডা খুব শিগগিরই সম্প্রচারিত হবে বাংলালাইভের ইউটিউব চ্যানেলে। আপনারা শুনতে পাবেন নারীমুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর মতামত, তাঁর জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, নানা ভাবনার কথা, স্বয়ং তাঁরই মুখ থেকে। চোখ থাকুক বাংলালাইভের ফেসবুক পেজে। পড়তে থাকুন বাংলালাইভ ডট কম।
*ছবি সৌজন্য: dailymotion, facebook, soundcloud
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!
4 Responses
পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। ওনার দিকগুলোর কথা আমাদের প্রায় সবার ই জানা। কিন্তু ওনার যে আরও অনেক অনেক গুণ বা আছে সেগুলো কেউ তুলে ধরেন না। আশা করি ভবিষ্যতে সেই দিকগুলো তুলে ধরবেন
শ্রাবন্তী মজুমদার তো নিজেই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। তাঁর অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।
তার পপ গান আমি একটি ছোট বাগান করেছি।1970এর পূজার গান।
অসাধারণ! নারী দিবসের আড্ডার অপেক্ষায় রইলাম।।