পায়ের ঘা আবার টাটিয়ে উঠছে, জ্বরটাও ফিরে আসছে যেন, তার মানে ক্যালপলের এফেক্ট শেষ হচ্ছে। টুনু অল্প খুঁড়িয়ে বাগানে আসল। বাড়ির ভেতর একতলায় লোকজন থাকলেও তার দিকে মন কেউই দেবে না। নির্ধারিত জায়গাটিতে, মানে বেলগাছের কাছে পাঁচিলে কোথাও কেউ নেই। ভাঙা পাঁচিলের ওপর কোনওদিন বসেনি কেউ এখানে, এবং বেলগাছের ঝুপসি অভ্যন্তরেও গা মিশিয়ে নেই। টুনু চোখ চালাল তন্নতন্ন করে। শুধু মরা শামুকের খোল, আর শুকনো পাতার গুচ্ছ, আর ভেজা মাটির করুণ শীত। তাহলে কি মাঠ দিয়ে হেঁটে চলে গেল? কিন্তু তাহলে চোখে পড়ত, কারণ এত দ্রুত এত বড় মাঠ অতিক্রম করা কঠিন, যদি না মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে লোকালয়ের দিকে চলে যায়। কিন্তু তাহলে সুতনু বেলগাছে উঠতে চাইছিল কেন? নাকি এটা কোনও নতুন খেলা, একানড়ে তাকে কিছু বলতে চায়?
ছোটমামার ঘরে ঢুকলেই কেন অদ্ভুত সব জিনিস ঘটে? যেন একটা ধাঁধার অনেকগুলো টুকরো এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে, যার কোনওটায় প্রাচীন গম্বুজ, কোনওটায় দেওয়ালের গায়ের ছোপ, আবার কোনও টুকরোয় হাত দিলে ঝিকিয়ে ওঠে সুতনু সরকার। একটা করে চিঠি, আর একটা করে ভাঙা ধাঁধার টুকরো তার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। সবকটাকে মেলাবে কেমন করে?
রীণামামিমাকে কাল থেকেই ওখানে শুতে দেয়নি দিদা, বাড়ির একতলায় এনে রেখেছে। মড়ার মাথার মতো নিস্তব্ধ এই অন্ধকার বাগানের ভেতর হাঁটলে মনে হয় বহু পুরনো দিন ফিরে ফিরে আসবে, অনেক ভুলে যাওয়া কথা ও মুখেদের দল। কিন্তু এর আগে কখনও অলৌকিক সুতনুর দেখা পায়নি টুনু। সে ভুল দেখেছে, জ্বরের ঘোরে উত্তপ্ত মাথা তাকে খোয়াব দেখিয়েছে, অথবা হারানো সুতনু ফিরে আসেনা কোনওদিনই।
অথবা একানড়ে তাকে এই দৃশ্য দেখিয়েছে। প্রশ্ন হল, কেন? কী থাকতে পারে বেলগাছে? বিশ্বমামাকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলবে?
একটা হালকা শব্দ হল পাঁচিলের অন্যপাশে। টুনু দেখল মাঠের বুকে জগদ্দল কুয়াশা চাপ চাপ, একটা দুটো মিটমিটে আলো দূরে কোথাও। ধীরে ধীরে সেই অস্বচ্ছ ভেদ করে উঠে দাঁড়াল একটা মাথা। দাড়িওয়ালা, জটাজুটভর্তি, নোংরা। বাড়ি থেকে ছিটকে আসা টিউবলাইটের আলো ভাঙা পাঁচিলের ইটে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে ছত্রখান হয়ে যতটা ছড়িয়ে পড়ছে, সেটুকুতে টুনু দেখল জ্বলজ্বলে চোখ। একটু কেঁপে গেল, কিন্তু সেটা নেহাতই ঠাণ্ডায়।
হঠাৎ পাগলটার চোখে তীব্র আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখল টুনু। তাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো কাঁপছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল ‘আঁ আঁ !’ টুনু আরেক পা এগোল, এবং পিছিয়ে গেল অন্যজন।
মুর্তিটা সটান দাঁড়াতে তার কোমর পর্যন্ত দেখতে পেল টুনু। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। টুনু এক পা এগিয়ে গেল, তখন পাগলটা ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিল একবার।
‘তুমি চিঠিগুলো পেয়েছিলে?’
নীরবে তাকিয়ে আছে, বোঝবার উপায় নেই শুনছে কি না।
‘আমাকে ধরে নিয়ে যাবে তুমি, না? ঠিক যেভাবে অন্যদের নিয়ে গেছিলে?’ কথাগুলো গুছিয়ে বলতে বলতেই অবাক হয়ে টুনু ভাবছিল, নিজেকে এত শান্ত লাগছে কী করে।
‘ছোটমামাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলে যেমন? তারপর ওই তালগাছের মাথায় রেখে দিয়েছ, তাই দিদা গিয়ে ভাত রেখে আসে।’
হঠাৎ পাগলটার চোখে তীব্র আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখল টুনু। তাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো কাঁপছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল ‘আঁ আঁ !’ টুনু আরেক পা এগোল, এবং পিছিয়ে গেল অন্যজন। টুনু নিজের মনেই হাসল অল্প। জ্বর তাহলে তাকে সাহসী বানিয়ে দিল !
‘বেলগাছের মাথায় কী আছে?’
পাগলটার চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে। মুখ থেকে যেন লালা গড়িয়ে পড়বে, ঝুলে গেছে জিভ, যেরকম যেত প্রফেসর ক্যালকুলাসের। অস্ফুটে কিছু একটা বলল, হাত তুলে হয়ত দেখাতেও যেত, কিন্তু তখন তার কাঁধে এসে পড়ল অন্য একজনের হাত। বিশ্বমামা। ঘুরেঘারে এতক্ষণ পর শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। সঙ্গে গ্রামের আরও দুইজন।
পাগলটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাচ্ছিল, যাবার পথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল বারবার, সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে টুনুকে দেখল বিশ্বমামা, এবং ধমকে উঠল, ‘এত রাত্রে তুমি বাগানে কেন? এর সঙ্গে কেন কথা বলছিলে?’
‘তুই এখানে?’ বিস্মিত স্বরে বিশ্বমামা জিজ্ঞাসা করল।
হাসবার চেষ্টা করল পাগলটা, এবং টুনু দেখল বিশ্বমামার চোখে তিরতির করে বাড়তে থাকা কষকষে ক্রোধ, যেন কালীপটকার লম্বা ল্যাজ বেয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে বিস্ফোরণের নাভিমূলের দিকে। কাঁধে হাত শক্ত করে খামচে ধরল বিশ্বমামা, ‘তুই আগেও গুবলুর খোঁজে এ বাড়িতে ঢুকেছিলি! শুওরের বাচ্চা! কোথায় রেখেছিস আমার ছেলেকে?’
পাগলটা অবোধ্য ভাষায় গ্যাঁ গ্যাঁ করে কিছু উত্তর দিল, যেটা তার চোখের দুর্নিবার ভয়ের জলরঙকে কিছুতেই মাটিচাপা দিতে পারছিল না। দুম করে বিশ্বমামা তার গলায় দুইহাত দিয়ে টিপে ধরল, আর চিৎকার করে উঠল বিকৃত কণ্ঠে, ‘কোথায় রেখেছিস আমার ছেলেকে! বল তুই! আজ পুঁতে ফেলব তোকে। তোর জন্যে আজ এতকিছু! শুধু তোর জন্য!’
পাগলটা ছটফট করছিল আর আকস্মিক বিস্ফোরণে টুনু বাকরুদ্ধ, তখন বিশ্বমামার সঙ্গীরা দুজনকে ছাড়াল, ‘আরে করো কী! শেষে কি খুনের দায়ে পড়বে? এ পাগল ছাগল মানুষ, অত প্ল্যান করে করবার সাধ্য এর আছে নাকি? আর ছেলে তো হারিয়েছে দুপুরবেলায়। দুপুরবেলা করে এ বাজারে দীনু মোড়লের দোকানঘরের সামনে বসে থাকে রোজ, জানো না? ভিক্ষে করে তো ওখানে বসে!’
জ্বলন্ত স্বরে বিশ্বমামা বলল, ‘জ্যাঠাইমা তালগাছের নীচে খাবার রেখে আসে, সেই লোভে আসে। জানি না ভেবেছ? আমার বউ বলেছিল, একদিন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছিল–‘
‘আরে ছাড়ো। এত কিছু করবার সাধ্য এর আছে না কি? তার চে বরং পুলিশে জানাও, তারা যা করবার করুক একে নিয়ে। এই, তুই যা তো এখন! ফের যদি এখানে আসিস তো ঠ্যাং ভেঙে দেব!’
একটা হালকা শব্দ হল পাঁচিলের অন্যপাশে। টুনু দেখল মাঠের বুকে জগদ্দল কুয়াশা চাপ চাপ, একটা দুটো মিটমিটে আলো দূরে কোথাও। ধীরে ধীরে সেই অস্বচ্ছ ভেদ করে উঠে দাঁড়াল একটা মাথা। দাড়িওয়ালা, জটাজুটভর্তি, নোংরা।
দুজন মিলে বিশ্বমামাকে ছাড়ালেও সে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল, ‘তোকে আমি ছাড়ব না। তোর পাপে আজ এই দশা !’ পাগলটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাচ্ছিল, যাবার পথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল বারবার, সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে টুনুকে দেখল বিশ্বমামা, এবং ধমকে উঠল, ‘এত রাত্রে তুমি বাগানে কেন? এর সঙ্গে কেন কথা বলছিলে?’
‘কথা বলিনি! আমার পেন্সিল পড়ে গিয়েছে জানালা দিয়ে, খুঁজতে এসে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে।’ গলা সামান্য কাঁপাল টুনু, চোখ একটু বিস্ফারিত।
‘রাতবিরেতে বাইরে থেকো না বাবা! দেখছ তো, সময় ভাল যাচ্ছে না এখন’। বলল বিশ্বমামার এক সঙ্গী।
বিশ্বমামা সামলে নিল নিজেকে, তারপর টুনুর কাঁধে হাত রেখে ধীর গলায় ‘ঘরে চলো। দিদা বলেছিল না তোমাকে, মাঠ বা তালগাছের কাছে যাবে না? রাতবিরেতে অন্ধকারে একা একা ঘুরবে না? কথা শোনো না কেন!’
বাগান ঘুরে দুজনে বাড়ি ঢোকবার মুখে টুনু জিজ্ঞাসা করল, ‘বিশ্বমামা! পাপ কেন? পাগলটা কী করেছিল?’
‘মানে?’
‘তুমি যে বললে ওকে, তোর পাপে আজ এই দশা! কী করেছিল? ও কি ছোটমামাকে ধরে নিয়ে গেছে?’
‘কেন মনে হল তোমার?’ ভুরু কুঁচকে গেল বিশ্বর।
‘ও যদি গুবলুর খোঁজে বাড়িতে ঢোকে, তাহলে হয়ত ছোটমামার খোঁজেও এসেছিল, আসতেই পারে, না?’ ল্যাপাপোঁছা গলায় বলে গেল টুনু, যেহেতু বা চরাচরে এই সমাধানের বাইরে আর অন্য কোনও জটিলতাই ছিল না।
থমকে গিয়ে কিছু একটা ভাবল বিশ্বমামা। তারপর মাথা নাড়ল, ‘তুমি ছোট, এসব বুঝবে না।’
‘কিন্তু ও কি ছোটমামাকে–‘
তীব্র গলায় ছিটকে উঠল বিশ্ব, ‘কতবার বলব, এসব কথা এখন তুলো না? হ্যাঁ, ওর জন্যেই তোমার ছোটমামা–‘ আবার সামলে নিল, ‘যাক। শোনো টুনু, আমার মন ভাল নেই এখন। সবারই খুব মন খারাপ। এখন এসব কথা থাক।’ বিরক্তভাবে কাঁধ ঝাঁকাল, যেন নিজের ওপরেই রেগে যাচ্ছে, ‘আর এসব শুনে তোমার লাভটা কী বলতে পারো? দুদিনের জন্য ঘুরতে এসেছ, আবার চলে যাবে। ছোটমামাকে নিয়ে কথা বলতে আগেও বারণ করেছিলাম তো, না কী?’
কখনও এত বিরক্ত দেখেনি বিশ্বমামাকে। হতাশভাবে বিশ্বমামা ভেতরে ঢুকল, কাঁধ ঝুলে গিয়েছে, বসে গেছে চোখ। টুনু দেখল এক ঝলক, সে চোখের বসে যাওয়া কোটরে মণি নেই, শুধুই দলা দলা অন্ধকার।
ছবি সৌজন্য: সুজয় বাগ
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৬ মার্চ ২০২১
আগের পর্বের লিঙ্ক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।